আমাদের মানদণ্ড কি হিরো আলম-কাকলী ফার্নিচার?
হিরো আলম, সেফুদা, হেলেনা জাহাঙ্গীর, কাকলী ফার্নিচার- এই হলো আমাদের ভাইরাল কনটেন্ট এবং ক্যারেক্টার। অনেকটা মোটের উপর বলা চলে। হিরো আলম নিজেই নিজের নাম রেখেছেন ‘হিরো’। যিনি কোনো প্রকার শুদ্ধ উচ্চারণ জানেন না, অভিনয় জানেন না, চিৎকার করেন।
সেফুদা বিকৃত মস্তিষ্ক। লাইভে এসে অকথ্য ভাষায় যাকে ইচ্ছে তাকে গালাগাল করেন। মদ খান। চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানের ভাষায়- তিনি একজন পারভার্ট।
হেলেনা জাহাঙ্গীর সিআইপি। নিজেকে উদ্যোক্তা পরিচয় দেন। কিন্তু তিনি কী বলেন, কী করেন, নিজেই জানেন না। যিনি নিজের নামটিও সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারেন না। বলেন, ‘আমি হ্যালেনা জাহাঙ্গীর হ্যালেন’। আর কাকলী ফার্নিচার এই সময়ের সবচেয়ে মানহীন বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটিতে বারবার বলা হচ্ছে, ‘দামে কম, মানে ভালো কাকলী ফার্নিচার। দামে কম, মানে ভালো কাকলী ফার্নিচার’। ভালো জিনিসের কখনোই দাম কম হতে পারে না। অর্থনীতির সূত্রের বিপরীতে গিয়ে এমন বিজ্ঞাপন- অর্থহীন, প্রতারণামূলক প্রচারণা।
এখানেই শেষ নয়। এসব মানহীন কনটেন্টের সঙ্গে আর যা ভাইরাল তার মধ্যে রয়েছে এক ঝাঁক ‘তথাকথিত’ ইসলামিক ওয়াজ। এসব ওয়াজের বেশির ভাগের সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের আদৌ কোনো যোগাযোগ নেই। ইসলামের নামে তারা সবকিছুই জায়েজ করতে অস্থির। মানে তাদের স্বার্থ, অর্থ। অর্থ উপার্জনের জন্য রীতিমত মরিয়া এই ওয়াজকারীরা।
আমরা কী দেখছি, কেন দেখছি, কেন ছড়াচ্ছি এই প্রশ্নগুলোর উত্তরের মধ্য দিয়ে সামাজিক মনস্তত্ত্ব বেশ বোঝা যায়। যা নিজের জন্য ভালো নয় তা অন্যের জন্য ভালো মনে করি কী করে? তা মনে করার কোনো কারণ নেই নিশ্চয়ই। যে ভিডিও ভাইরাল করছি তা যে ভালো মনে করছি তাও তো নয়। যা কিছু তামাশার, যা কিছু মিথ্যে, যা কিন্তু মন্দ, যা কিছু অশ্লীল তা ছড়িয়ে দিচ্ছি। মজা পাচ্ছি। মজা পাচ্ছি অন্যের উপকারে নয়, অপকারে। ভালো বাদ দিয়ে মন্দ ছড়াচ্ছি।
মানহীন কনটেন্টের সঙ্গে আর যা ভাইরাল তার মধ্যে রয়েছে এক ঝাঁক ‘তথাকথিত’ ইসলামিক ওয়াজ। এসব ওয়াজের বেশির ভাগের সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের আদৌ কোনো যোগাযোগ নেই। ইসলামের নামে তারা সবকিছুই জায়েজ করতে অস্থির। মানে তাদের স্বার্থ, অর্থ।
আমাদের অনেক কিছুই ভালো। এই ভালোর তালিকা অতি দীর্ঘ। কিন্তু তা কি আমরা প্রচার করছি? এই বাংলাদেশের ছেলে এফ আর খান পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন তৈরি করেছেন। নাট্যকার সেলিম আল দীন প্রমাণ করেছেন বাংলা নাটকের ইতিহাস ইউরোপের নাট্যধারার চেয়ে বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধ।
ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল সেই আমলে ইতালি-মিলান-ভোগ-ভ্যানিটি ফেয়ার মাতিয়েছেন। এই আগুন ছেলেমেয়েরা এখনো আছে, একজন নয়- অসংখ্য। আমাদেরই চারপাশে।
ইউরোপিয়ান গার্লস ম্যাথ অলিম্পিয়াডে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছে রায়ান বিনতে মোস্তফা অমি ও নুজহাত আহমেদ দিশা। অধ্যাপক সমীর সাহা ও তার মেয়ে সেঁজুতি সাহা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের জিন রহস্য উন্মোচন করেছেন। এশিয়ার ১০০ বিজ্ঞানীর তালিকায় এসেছে তিন বাংলাদেশি নারী বিজ্ঞানীর নাম।
আমেরিকায় সর্ব কনিষ্ঠা ডাক্তার হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন আসাহি হোসেন। লন্ডন ফটোগ্রাফি ফেস্টিভ্যালে চট্টগ্রামের তরুণ ফটোগ্রাফার ইমরান হোসাইন আর মোহাম্মদ তাসাওয়ার ইসলামের সাফল্য অনেকেরই জানা। যুক্তরাষ্ট্রে ড. কাজী রুশদী আহমদের নেতৃত্বে যক্ষ্মা নির্ণয়ে এসেছে সাফল্য। সে দেশে গলফার হিসেবে শতভাগ বৃত্তি নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন আফনান মাহমুদ চৌধুরী।
বাংলাদেশি তরুণী বকর ফারিহা সালমা দিয়া বাকের মাত্র ২০ বছর বয়সে হংকংয়ের আইন পরিষদে সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি শেখ গালিব পেয়েছেন সাইবার সিকিউরিটির সর্বোচ্চ সাফল্য, করপোরেট সাইবার সিকিউরিটি সার্টিফিকেট।
গুগল ও ইউটিউবের সহযোগিতায় সুজন পাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট ‘বঙ্গ’ আবিষ্কার করেছেন। নাসাতে কর্মরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাহমুদা সুলতানার যুগান্তকারী উদ্ভাবন পুরষ্কারের কথা অনেকেরই জানা। আর সম্প্রতি আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘আঁ সার্তে রিগা’ ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি নির্বাচিত হয়েছে। এটি সাফল্যের খণ্ডচিত্র মাত্র। পুরো চিত্রটি আরও ব্যাপক ও বিস্তারিত।
গুগল ও ইউটিউবের সহযোগিতায় সুজন পাল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট ‘বঙ্গ’ আবিষ্কার করেছেন। সম্প্রতি আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ চলচ্চিত্রটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘আঁ সার্তে রিগা’ ক্যাটাগরিতে অফিসিয়ালি নির্বাচিত হয়েছে। এটি সাফল্যের খণ্ডচিত্র মাত্র। পুরো চিত্রটি আরও ব্যাপক ও বিস্তারিত।
কেউ যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চায়, বাংলাদেশের কালচার হোক, গ্ল্যামার হোক, সে যদি সার্চ করে তাহলে কিন্তু এই হিরো আলম, হেলেনা জাহাঙ্গীর আর কাকলী ফার্নিচার মানের ভিডিওই আসবে সামনে।
কেউ হয়তো ভাবতে পারেন এটাই বাংলাদেশ। এটাই আমাদের সংস্কৃতি, রুচি; কিন্তু আসলে তা নয়। সমৃদ্ধ এক অতীত ও বর্তমান রয়েছে আমাদের। কিন্তু কিছু টাকার জন্য যে যা খুশি বানিয়ে আপ দিচ্ছি, ভাইরাল করছি। জাস্ট টু গেট মানি। শুধু টাকা আর কিছুই নয়। চারদিকে লুটপাটের নৃত্য। পুঁজির কাছে সমর্পিত বোধ-বিবেক-রুচি সবই।
সবকিছু শেষ হওয়ার আগে একবার উঠে দাঁড়ান, মাথা উঁচু করে। একটু হলেও প্রতিবাদ করুন অসভ্যতার, অশ্লীল রুচি-বিকৃতির, লাম্পট্যের যা আপনার বা আমার পরিচয় নয়।
জব্বার হোসেন ।। সম্পাদক, আজ সারাবেলা; সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র।