৬ দফার পক্ষে, বিপক্ষে
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। লাহোর। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবন। সম্মিলিত বিরোধীদলের সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা দাবিনামা উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, কিন্তু তখনো আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে ছয় দফা অনুমোদন দেয়নি। এর আগে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট (এনডিএফ) থেকে বের হয়ে আওয়ামী লীগকে এককভাবে পুনর্গঠিত করতে গিয়ে পুরনো পন্থী নেতাদের বিরাগভাজন ছিলেন তিনি।
স্বভাবতই সম্মেলনে উপস্থিত সকল রাজনৈতিক দল ছয় দফার বিরোধিতা করে। আইয়ুব খানের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল যখন বাকি সকলের লক্ষ্য তখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা দাবিনামা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ‘বিরোধী দলগুলোর ঐক্যে ফাটল ধরানোর জন্য আইয়ুব খানের সচিব আলতাফ গওহরের প্ররোচনায় শেখ মুজিব এই দাবি উত্থাপন করেছেন’—এমন অভিযোগও উঠে।
ছয় দফার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে প্রথম বিবৃতি দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, আব্দুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ, আবুল কাশেম (সাব-জজ) প্রমুখ।
পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোতে একে বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা বলে আখ্যায়িত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এই সম্মেলন থেকে ওয়াক আউট করে এবং ১১ ফেব্রুয়ারি তিনি সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফার ব্যাখ্যা দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে প্রথম বিবৃতি দেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজ, আব্দুল্লাহ আল হারুন, এম এ হান্নান, জানে আলম দোভাষ, আবুল কাশেম (সাব-জজ) প্রমুখ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি বিবৃতির মাধ্যমে ছয় দফার প্রতি সংহতি জ্ঞাপন করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফার সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যান করে কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামী। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে প্রথম জনসভা করে জনমত গঠন শুরু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৪ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তার সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ১৮ মার্চ কনভেনশনে মুসলিম লীগের সম্মেলনে গভর্নর মোনায়েম খান গৃহযুদ্ধের হুমকি দেন।
১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সম্মেলন। পুরনো নেতাদের অনেকেই ছয় দফার বিরোধিতা করলেও জেলা নেতৃত্ব এবং ছাত্রলীগ দৃঢ় অবস্থানে থাকে। এই সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন, পুরনো নেতাদের অনেকেই বাদ পড়ে যান। ছয় দফা আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হয়।
কনভেনশনে মুসলিম লীগের সম্মেলনে আগত আইয়ুবের মন্ত্রী ভুট্টো ছয় দফা প্রশ্নে প্রকাশ্য বিতর্কের চ্যালেঞ্জ জানালে শেখ মুজিবুর রহমান সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীন আহমদ পত্রিকার মাধ্যমে ভুট্টোকে জানিয়ে দেন। প্রকাশ্য বিতর্কের এই চ্যালেঞ্জ দেশবাসীর মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি করে। কিন্তু ‘সময়ের অভাব’ অজুহাতে বাকপটু ভুট্টো রণে ভঙ্গ দেন।
৭ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন তিনি ছয় দফা মানেন না, এতে শোষণ মুক্তির কোনো দাবি নেই। ছয় দফাকে তিনি সিআইএ’র দলিল বলেও অভিযুক্ত করেন। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে চীন ভ্রমণের পর থেকেই মওলানা ভাসানী আইয়ুব বিরোধী অবস্থান ত্যাগ করেন। ‘আইয়ুব খান যখন চীনের প্রতি ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন তখন ছয় দফা দাবির মাধ্যমে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা মূলত সিআইএ’র চক্রান্ত’- এরকম মতামত প্রতিষ্ঠিত হয় বামপন্থীদের মধ্যে।
চীন ও সোভিয়েত মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে গেলেও ন্যাপ তখনো অবিভক্ত। রাজনৈতিকভাবে ছয় দফাকে মোকাবিলা করার জন্য ভাসানী আত্মগোপনে থাকা চারজন কমিউনিস্ট নেতার উপর হুলিয়া প্রত্যাহারের অনুরোধ জানান- কমরেড তোয়াহা, আব্দুল হক, আসহাব উদ্দিন আহমদ ও সুখেন্দু দস্তিদার। হিন্দু বিদ্বেষী আইয়ুব খান সুখেন্দু দস্তিদারের বদলে কমরেড মোজাফফর আহমদের হুলিয়া প্রত্যাহার করে।
সকল রাজনৈতিক পক্ষের বিরোধিতার পাশাপাশি এসময় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গণপ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হতে শুরু করে। ১৮ এপ্রিল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে বারবার গ্রেপ্তার করে যশোর, সিলেট, ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠানো হতে থাকে। ৯ মে আবার তাকেসহ আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় প্রায় সকলকেই গ্রেপ্তার করা হয়।
৭ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ঘোষণা দেন তিনি ছয় দফা মানেন না, এতে শোষণ মুক্তির কোনো দাবি নেই। ছয় দফাকে তিনি সিআইএ’র দলিল বলেও অভিযুক্ত করেন।
জুন মাসে ছয় দফা সমর্থকরা সরকারের বিরুদ্ধে এককভাবে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়। যুব নেতা শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, ছাত্রলীগ সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক এতে নেতৃত্ব দেন। তাদের পরামর্শে আওয়ামী লীগ ছয় দফার পক্ষে হরতাল আহ্বান করে ৭ জুন। এর আগে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে শিক্ষা আন্দোলন সফল করলেও এবার ছাত্র ইউনিয়ন নীরব ভূমিকা পালন করে। ৩ জুন ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সম্মেলনে হরতাল বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপও প্রকাশ্যে সক্রিয় সমর্থন জানায়নি। ৫ তারিখে ন্যাপের জনসভায় হাজী দানেশ আবারও ছয় দফা এবং আহুত হরতালের সমালোচনা করেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও তাদের শ্রমিক জোটের একক প্রচেষ্টায় ছয় দফার পক্ষে ৭ জুন ঐতিহাসিক গণজোয়ার সৃষ্টি হয়। ছাত্রদের পাশাপাশি আদমজী পাটকল ও তেজগাঁ শিল্পাঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকাকে আন্দোলিত করেন ছয় দফার সমর্থনে। পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সরকারি প্রেস নোট অনুযায়ী নিহত হন ১০ জন, এদের প্রায় সকলেই ছিলেন শ্রমিক। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকসহ সারাদেশে কয়েক হাজার কর্মী গ্রেপ্তার হন। প্রকাশ্য সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত না থাকলেও মস্কোপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের কিছু কর্মীও হরতালে সক্রিয় থাকেন। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমসহ এদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তখন পর্যন্ত শ্রমিক রাজনীতির পুরো কর্তৃত্বই ছিল বামপন্থীদের হাতে। কিন্তু ছয় দফা আন্দোলন ও ৭ জুনের হরতাল ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকদেরকে সম্পৃক্ত করে দেয় শেখ মুজিবুর রহমানের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে, যে রাজনীতির মূল কথাই ছিল বাংলার অধিকার। অধিকারের প্রশ্নে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে স্বাধীন রাষ্ট্র অর্জনের কার্যকর ভিত্তি ছিল ছয় দফা, এমন মূল্যায়ন মোটেও অত্যুক্তি নয়।
হাসান মোরশেদ ।। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান গবেষক, www.1971archive.org