টাকা পাচারকারীর তালিকাটা অন্তত মানুষ জানুক
কানাডায় বাংলাদেশ থেকে পাচারের টাকায় গড়ে ওঠা বিলাসবহুল আবাসিক অঞ্চল ‘বেগম পাড়া’ নিয়ে অনেক আলোচনায় এবার এক নতুন বেগমের নাম পাওয়া গেল। নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের স্ত্রী শামীমা সুলতানা জান্নাতী কানাডায় বাড়ি কিনেছেন। বাংলাদেশি পাসপোর্ট অনুযায়ী তার পেশা ‘গৃহবধূ’ হলেও এই বিলাসবহুল বাড়ি কী করে কিনলেন, কী করে টাকা পাঠালেন এমন সব প্রশ্ন এখন আলোচনায়।
একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, বাংলাদেশে এখন বাতাসে টাকা উড়ছে, যারা ধরতে পারছে, তারা সেই টাকা ধরে পাচার করে দিচ্ছে। কারণ, দেশে রাখাটা নিরাপদ নয়। কেউ বেগম পাড়ায় বাড়ি কিনছে, কেউ মার্কিন মুল্লুকে সম্পদ গড়ছে কেউবা আবার মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কিনছে।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বাণিজ্য কারসাজির মাধ্যমে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ বিদেশে পাচার হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচারে বাংলাদেশ শীর্ষে, আর অর্থ পাচারের দিক থেকে শীর্ষ ১০০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০।
একটা ধারণা অনেকদিন ধরে ছিল যে, ব্যবসায়ীরাই বেশি পাচার করছে। তবে গতবছর ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন পররাষ্টমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, কানাডায় অর্থ পাচারের ২৮টি ঘটনার তথ্য পেয়েছে সরকার যেখানে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগই আমলা বা সরকারি চাকরিজীবী।
যে শ্রেণির লোকই পাচার করুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে টাকা পাচার হচ্ছে এবং বিপুলভাবে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিবছর কত টাকা বিদেশে পাচার হয় সে সংক্রান্ত তথ্য কোথাও নেই। শুধু মানুষ দেখছে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের বিত্ত বৈভবের প্রদর্শনী বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচারে বাংলাদেশ শীর্ষে, আর অর্থ পাচারের দিক থেকে শীর্ষ ১০০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারের যেসব ঘটনা আমরা জানতে পারছি সেগুলো খুব সামান্যই। বেশিরভাগ তথ্য প্রকাশই হচ্ছে না। বাণিজ্য কারসাজি, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারের পুরো বিষয়টা যেহেতু অবৈধ পন্থায় হয়ে থাকে সেজন্য এর সঠিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া মুশকিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আছে নজরদারির জন্য। বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী বিদেশে টাকা পাঠানো বেশ জটিল। বাংলাদেশের বাইরে ভ্রমণের সময় একজন ব্যক্তি প্রতিবছর ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য নিয়ম মেনে অর্থ নেওয়া যায়। তবে বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেওয়া নিষিদ্ধ। তাহলে বিদেশে এত টাকা পাচার হচ্ছে কী করে? এ প্রশ্নের উত্তরটা কোথাও নেই।
মূলত দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকাই পাচার হচ্ছে। শিল্প বা বাণিজ্যের জন্য ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা পাচার করে দিচ্ছে, পণ্য জাহাজীকরণের কাগজপত্র জাল করে এলসিকৃত পণ্যের পুরো টাকা তুলে নিয়ে তা বিদেশে রেখে দিচ্ছে, আমলারা বা সরকারি চাকরিজীবীরা, রাজনৈতিকদের কেউ কেউ যোগসাজশের মাধ্যমে অর্জিত টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থ পাচারের ঘটনা ঘটে মূলত সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হলে। বাস্তবতা হল, দেশে সঞ্চয় বাড়লেও বিনিয়োগ বাড়ছে না। দেশে যেকোনো পর্যায়ে বিনিয়োগ নিয়ে অর্থের মালিকদের আস্থাহীনতায় টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে।
বিদেশে সম্পদ কেনার জন্য অর্থ নেওয়া নিষিদ্ধ। তাহলে বিদেশে এত টাকা পাচার হচ্ছে কী করে? এ প্রশ্নের উত্তরটা কোথাও নেই।
অর্থ পাচার একটি বৈশ্বিক সমস্যা, কিন্তু বাংলাদেশ থেকে যে হারে অর্থ পাচার হচ্ছে, তা উদ্বেগজনক। তাই বিষয়টি নিয়ে উদাসীন থাকার সুযোগ নেই। পাচার রোধের প্রচেষ্টা নিতেই হবে।
একটা উপায় হতে পারে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো। সরকার একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্সও গঠন করতে পারে যার কাজ হবে পাচারকারীদের তালিকা প্রকাশ করা এবং এদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। প্রতিবেশী ভারত জাতিসংঘের সহযোগিতায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনায় সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশও সেই উদ্যোগ নিতে পারে।
যারা টাকা পাচার করছে, এরা প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান মানুষ। অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, এই মানুষগুলো এই দেশে বসে অর্থ আয় করলেও দেশটার প্রতি কোনো দরদ নেই। তারা বাংলাদেশকে নিজেদের দেশই মনে করছে না, দেশ মনে করছে কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপ বা মালয়েশিয়াকে।
অর্থ পাচার রোধে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে হবে। সেই দেশগুলোকে জানাতে হবে যে, তোমাদের দেশে আমাদের দেশের অবৈধ অর্থ প্রবেশ করছে, ফেরত দাও।
জিএফআই তথ্য অনুযায়ী, মোট পাচার হওয়া অর্থের ৮৫-৯০ শতাংশই হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে। তাই এই দিকটিতে কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
অর্থ পাচার রোধের ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছাই বেশি জরুরি। পাচার হওয়া অর্থ দুর্নীতি ও অবৈধ পন্থায় অর্জিত। তাই বলে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে সেই তথ্য জানার অধিকার জনগণের নেই? আমরা জানি টাকা ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ ও জটিল কাজ। কিন্তু পাচারকারীদের নামধাম প্রচারে বাধা কোথায়? অন্তত তালিকা প্রকাশ করে এদের একটু লজ্জা দেওয়া হোক।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি