ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষের আত্মসমালোচনা কি জরুরি?

ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষসমূহের আত্মসমালোচনা এখন সময়ের একটি অপরিহার্য দাবিতে পরিণত হয়েছে। কেননা, অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, আত্মসমালোচনার অভাব এবং অন্ধ চাটুকারিতার প্রতি অযথা আকর্ষণই ফ্যাসিবাদের উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছে। যখন অন্যায়, নিপীড়ন এবং স্বৈরাচার সমাজের দৈনন্দিন বাস্তবতায় পরিণত হয়ে যায়, তখন তার প্রতিকার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে, ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলোর মধ্যে কয়েকটি বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যা আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করাচ্ছে।
প্রথমত, কিছু পক্ষের দাবি যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সরকারবিরোধী আন্দোলন এককভাবে ফ্যাসিবাদকে বিতাড়িত করেছে। তাদের ভাষা এবং আচরণ দেখে মনে হয়, দেড় মাসের আন্দোলনেই তারা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটিয়েছে এবং তারা একমাত্র এই পরিবর্তনের নায়ক। তবে বাস্তবতা হলো, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে নির্যাতিত, বঞ্চিত এবং নিপীড়িত রাজনৈতিক শক্তি ও জনগণই এই প্রতিরোধের মূল চালিকাশক্তি ছিল। তাদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম এবং নিষ্ঠা অস্বীকার করা, প্রকৃত ইতিহাসের প্রতি অবিচার। এটি যেন পুরনো একটি প্রবচন—‘ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে’, যেখানে পরিবর্তনের সুযোগকে নিজেদের একক সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই ধরনের আত্মপ্রশংসা শুধু ইতিহাসের বিকৃতি নয়, বরং জাতির ঐক্য ও সংগ্রামের প্রতি এক ধরনের অশ্রদ্ধা।
দ্বিতীয়ত, আরেকটি পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তারা মনে করে শুধুমাত্র এবাদত বা ধর্মীয় কার্যকলাপে সম্পৃক্ত হলেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব, আর বাস্তব জীবনে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তেমন জরুরি নয়। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে—বিশেষত নিয়োগ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থায়—অন্যায় এবং অনিয়মকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিহত করতে চায় না। বরং, তারা নৈতিক বিচারে বর্তমান সময়ের অবিচারকে অতীতের ফ্যাসিবাদী শাসনের সঙ্গে তুলনা করে আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। তাদের মতে, ‘এখন কিছুটা অবিচার কমেছে, তাই এটুকু মেনে নেওয়া যায়।’ কিন্তু ইসলামী শিক্ষায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কেউ কারও বোঝা বহন করবে না।’ সুতরাং, বর্তমানের অন্যায়কারীরাও সমান অপরাধী এবং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করাই ন্যায়বিচারের প্রয়োজন।
আরও পড়ুন
তৃতীয়ত, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বৃহৎ জাতীয়তাবাদী ধারার মধ্যে একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সুপ্তভাবে লুকিয়ে রয়েছে। তারা পূর্বে কিছু আত্মত্যাগ করলেও, এখন সেই ইতিহাসকে পুঁজি করে বিভিন্ন সুবিধা লাভের চেষ্টা করছে। এরা এখন চাঁদাবাজি, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে, যা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের মূল আদর্শের বিপরীত। এমনকি, কিছু ব্যক্তি নিজেদের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, অথচ বাস্তবতা হলো—বিশেষ করে শিক্ষিত সমাজের একটি বৃহৎ অংশ ফ্যাসিবাদের সহযোগী ছিল। তারা শুধু নীরব দর্শকই ছিল না, বরং সক্রিয়ভাবে ফ্যাসিবাদকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রেখেছিল। এমনকি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তারা প্রতিবাদ তো দূরের কথা, ন্যূনতম নিন্দা পর্যন্ত করেনি।
এই সুবিধাবাদী এবং আত্মকেন্দ্রিক চর্চাগুলোর প্রতিকার না করা হলে, ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এটি এমন এক ক্ষত সৃষ্টি করবে, যা সারিয়ে তোলার কোনো উপায় অবশিষ্ট থাকবে না। ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত দায় নয়, এটি একটি দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। যারা ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার দাবি করছেন, তাদের আগে নিজেদের আত্মসমালোচনা করা জরুরি। সমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের ভুলগুলো চিহ্নিত করে শুধরে না নিলে, ইতিহাস আমাদের কঠোরভাবে শাস্তি দিবে।
এখনই সময়, আমাদের আত্মসমালোচনা করার এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আরও কার্যকর ও সামগ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণের। না হয়, আমরা একদিন এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হবো, যেখানে ইতিহাস আমাদের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে উঠবে।
ড. খালিদুর রহমান ।। অধ্যাপক, পরিসংখ্যান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট