তীব্র গরমে খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত?

২০২৪ সালের মতো এবারের গ্রীষ্মেও হয়তো তীব্র গরম অনুভব হতে পারে বলে ইতিমধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। তীব্র গরম যেমন আমাদের জীবনযাত্রার কষ্টের কারণ, তেমনই স্বাস্থ্যঝুঁকিও বটে যেমন, হিট স্ট্রোক। তীব্র গরমে পানি শূন্যতা এবং পেটের পীড়াজনিত রোগ বেশি দেখা দেয়।
আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়াই পেটের পীড়ার জন্য দায়ী এবং এগুলো পানিবাহিত জীবাণু দিয়ে ঘটে। এজন্য তৃষ্ণা নিবারণের জন্য নিরাপদ পানি পান করা একান্ত আবশ্যক। বিশেষ করে গরমে খেটে খাওয়া মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্য পাবলিক প্লেসে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা রাখা দরকার। এই বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনকে উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ রাখছি।
একইসাথে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদ পানি সরবরাহের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। পানির সাথে সাথে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসেরও পরিবর্তন ঘটাতে হবে।
বাংলাদেশের একটি চিরায়ত প্রবাদ হলো, ‘মাছে ভাতে বাঙালি বা ভেতো বাঙালি’। অর্থাৎ একদা এ দেশের মানুষ তিন বেলাই ভাত খেতে পছন্দ করত। তাই ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য। বর্তমানে ভেতো বাঙালির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। শহরের স্বাস্থ্য সচেতন লোকেরা সকালবেলা ভাতের পরিবর্তে আটার রুটি বা পাউরুটির দিকে ঝুঁকেছে।
যাদের সামর্থ্য আছে তারা রুটির পরিবর্তে ওট বা কর্নফ্লেকে অভ্যস্ত হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এগুলো সবই স্বাস্থ্যসম্মত সকালের নাস্তা। আজকের এই প্রবন্ধে অভিজাত সমাজের ইউরোপিয়ান বা পশ্চিমা ব্রেকফাস্টের বিপরীতে এদেশের গ্রামীণ মহিলাদের উদ্ভাবিত ‘পান্তা ভাত’ এর কথা বলবো। তীব্র গরমে সকালে নাস্তার টেবিলে পেঁয়াজ-মরিচ দিয়ে গরিবের পান্তা ভাত রাখার যৌক্তিকতা তুলে ধরব। আমাদের গ্রামীণ সমাজে এই পান্তা ভাত কীভাবে এলো সেটি একটু জানা দরকার।
পান্তা ভাত একঘেয়েমি মনে হলে এর পরিবর্তে দই, চিড়া ও কলা খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তীব্র গরমে পান্তা ভাত বা দই-চিড়া খেলে পেট ঠান্ডা থাকে।
এক সময় গ্রামের বাঙালি নারীরা গ্রীষ্মকালে রাতের বেলা রান্না করা ভাত অথবা বেঁচে যাওয়া ভাত পানি দিয়ে সংরক্ষণ করত। যেটি পান্তা ভাত নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি একেবারেই আমাদের দেশীয় গ্রামীণ সমাজের সাধারণ নারীদের উদ্ভাবন বা সহজ গ্রামীণ প্রযুক্তি। এই পান্তা ভাত তৈরিতে যে একটি অন্তর্নিহিত রসায়ন লুকিয়ে আছে সেটি মানুষের অজানা ছিল। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় যেটিকে এখন অণুজীববিজ্ঞানের আলোকে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে ‘ফার্মেন্টেশন বা গাঁজানো’ প্রক্রিয়া হিসেবে।
ভাতকে ১০-১২ ঘণ্টা ধরে পানিতে সারারাত ডুবিয়ে রেখে দেওয়ার ফলে পানির নিচে থাকা ভাত বাতাসের সংস্পর্শে আসতে পারে না বিধায় সেখানে ধীরে ধীরে অবায়বীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়। ফলে পচনকারী বায়বীয় অণুজীব দ্বারা ভাত নষ্ট হতে পারে না। অন্যদিকে অবায়বীয় পরিবেশে বিশেষ ধরনের উপকারী অবায়বীয় অণুজীব ভাত ও পানির মধ্যে অ্যানারোবিক ফার্মেন্টেশনের মাধ্যমে ভাতের মধ্যকার ধনাত্মক পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম।
আগেকার দিনে পান্তা ভাতকে গরিব মানুষের খাবার এবং এর পুষ্টিগুণ নেই বলে মনে করা হলেও বর্তমানে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, পান্তা ভাতে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। পান্তা ভাত ‘বডি রিহাইড্রেটিং ফুড’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই গরমকালের নাস্তায় পান্তা ভাতের জুরি মেলা ভার।
২০১১ সালে ‘দি টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া’-তে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জীবপ্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক পান্তা ভাত নিয়ে এক গবেষণায় এ ভাতের অনেক উপকারিতা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি পান্তা ভাতে অনেক ধরনের মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট যেমন ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনের মতো উপাদানের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়। যেটি শরীরের জন্য দরকার।
গবেষক মধুমিতা বড়ুয়ার মতে, ভাতের মধ্যে ফাইটেটের মতো যেসব এন্টি-নিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর থাকে সেগুলো ফার্মেন্টেশনের সময় অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি ভাতের দানাগুলো পানিযুক্ত হয়ে হাইড্রেটেড হয়। এই জৈবিক প্রক্রিয়ায় উপকারী ইস্ট এবং ব্যাকটেরিয়া অংশগ্রহণ করে।
ইস্টকে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এককোষী প্রোটিন বলা হয়। তাই পান্তা ভাতে বোনাস হিসেবে অতিরিক্ত প্রোটিন পাওয়া যায়। ফার্মেন্টেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট অণুজীবকে এখন প্রোবায়োটিক অণুজীব বলা হয়। প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া এবং ইস্ট ভরপুর পান্তা ভাত প্রত্যক্ষভাবে এবং পরোক্ষভাবে মানুষের অন্ত্রের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা দিয়ে থাকে। এই প্রোবায়োটিক অণুজীবকে অধিক কার্যক্ষম রাখতে দরকার হয় প্রিবায়োটিক বা আঁশ জাতীয় খাবার।
গ্রামের গরিব কৃষকেরা পান্তা ভাতের সাথে পেঁয়াজ এবং মরিচ খেয়ে থাকে। এখানে পেঁয়াজ একটি আঁশ জাতীয় খাবার বা প্রিবায়োটিক। পাশাপাশি পান্তা ভাতের সাথে খাওয়া সবুজ মরিচ ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-৬, ভিটামিন বি-৯, আয়রন এবং সোডিয়াম সমৃদ্ধ। মরিচের ভিটামিন সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভিটামিন বি-৬ স্নায়ুতন্ত্রকে সুস্থ রাখে এবং ভিটামিন বি-৯ কোষ ও টিস্যু বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পান্তা ভাতের সাথে একটু লবণ, কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে হয়ে গেল কম পয়সায় এবং বিনা রান্নায় সকাল বেলার শ্বেতসার, প্রোটিন, ভিটামিন এবং সিনবায়োটিক (প্রোবায়োটিক + প্রিবায়োটিক) সমৃদ্ধ একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। পান্তা ভাত একঘেয়েমি মনে হলে এর পরিবর্তে দই, চিড়া ও কলা খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। তীব্র গরমে পান্তা ভাত বা দই-চিড়া খেলে পেট ঠান্ডা থাকে। কথায় বলে, ‘পেট ঠান্ডা থাকলে মাথাও ঠান্ডা থাকে’।
সুস্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন মৌসুমে ঋতুভিত্তিক সবজি এবং ফল খাওয়া উচিত। শীতের শেষে পরিবর্তিত শুষ্ক আবহাওয়াতে সজনে একটি ঋতুভিত্তিক সবজি। সজনে ভিটামিন সি এবং অন্যান্য অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল জৈব-রাসায়নিক পদার্থ সমৃদ্ধ হওয়ায় কাশি এবং সর্দির মতো মৌসুমী রোগজীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধে অনন্য। সজনের পাতা, ফুল এবং ফল খাওয়া হয়। সজনে ভিটামিন, খনিজ এবং অন্যান্য বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ সমৃদ্ধ।
পুষ্টিবিশেষজ্ঞরা সজনেকে একটি বিস্ময়কর গাছ বলে অভিহিত করেছেন। সজনে পাতায় রয়েছে কমলার চেয়ে ৭ গুণ বেশি ভিটামিন সি এবং কলার চেয়ে ১৫ গুণ বেশি পটাশিয়াম। এতে প্রচুর পরিমাণে জিংক এবং পালং শাকের চেয়ে ৩ গুণ বেশি আয়রন বিদ্যমান যা রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া দূরীকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই শরীরকে সুস্থ রাখতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সজনের স্যুপ বা সবজি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
তীব্র গরমে সালাদ বা খাবারের অনুষঙ্গ হিসেবে অবশ্যই শসা বিবেচ্য। শসা কম ক্যালরি এবং আঁশ যুক্ত হওয়ায় স্বাস্থ্যের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শসায় পানি এবং অন্যান্য খনিজ পুষ্টির সাথে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় মৃদু মাত্রার মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে। ফলে শরীরের জমানো ক্ষতিকর ও বিষাক্ত উপাদানগুলো অপসারণ করে রক্তকে পরিষ্কার রাখে।
তাজা কাটা শসা, কাঁচা মরিচ, টক দই এবং প্রয়োজনে কাটা টমেটো এবং পেঁয়াজ একসাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় শসা রায়তা। যেটি গ্রীষ্মকালে শরীর ঠান্ডা রাখতে দারুণভাবে সাহায্য করে। তাই তীব্র গরমে সালাদ হিসেবে বা যেকোনোভাবে শসা খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। এরপর মৌসুমী ফল খাওয়ার ব্যাপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তীব্র গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেখা দেয় নানা ধরনের রোগ। এর মধ্যে অন্যতম ভাইরাসজনিত রোগ হলো সর্দি-কাশি ও সাধারণ ফ্লু। এইসব রোগের হাত থেকে বাঁচতে হলে মৌসুমী ফল আনারস অত্যন্ত কার্যকর। আনারসে বিদ্যমান প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি ভাইরাসজনিত ঠাণ্ডা-কাশি প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে। একইসাথে আনারস শরীরের পানিশূন্যতা রোধ করে। আনারসের মতো তরমুজও একটি গ্রীষ্মকালীন ফল। এই ফলে পানির পরিমাণ প্রায় ৯৩-৯৫ শতাংশ এবং নানা ধরনের খনিজ লবণে সমৃদ্ধ।
এই ফলের রস যেমন আমাদের পানিশূন্যতা দূর করে তেমনই ঘামের সাথে বের হয়ে যাওয়া খনিজ লবণের ঘাটতি মেটায়। তরমুজে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় শরীরের অম্ল–ক্ষারের ভারসাম্য বজায় থাকে—যা ক্লান্তিভাব দূর করতে সাহায্য করে।
তীব্র গরম থেকে এসেই সাথে সাথে ঠান্ডা পানি বা শরবত কোনোটাই না খাওয়া ভালো। গরমে আরেকটি উত্তম পানীয় হলো ঘোল বা মাঠা।
প্রাপ্তি সাপেক্ষে তীব্র গরমে বেলকে বিবেচনা করা যেতে পারে। বেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও পটাশিয়ামের মতো মূল্যবান পুষ্টি উপাদান। কাঁচা বেল ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগে ধন্বন্তরি। পাকা বেলের শরবত সুস্বাদু এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। বেলের মতো পেঁপেও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ একটি ফল। এতে রয়েছে ভিটামিন এ, সি ও ই, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়ামের মতো খনিজ পুষ্টি। পেট ঠান্ডা রাখতে সকালে এক গ্লাস বেল বা পেঁপের শরবত রাখতেই পারেন।
তীব্র গরমে এবং কাঠ-ফাটা রোদ থেকে বাসায় ফিরে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবতের কোনো জুড়ি নেই। শহরাঞ্চলে শরবতের জায়গা নিয়েছে বিভিন্ন স্বাদের ট্যাং। তবে ট্যাঙের পরিবর্তে লবণ-চিনি পানির সাথে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লেবুর রস দিয়ে তৈরি শরবত খাওয়াই উত্তম। তবে তীব্র গরম থেকে এসেই সাথে সাথে ঠান্ডা পানি বা শরবত কোনোটাই না খাওয়া ভালো। গরমে আরেকটি উত্তম পানীয় হলো ঘোল বা মাঠা।
দুধ থেকে ছানা অপসারণের পর অবশিষ্টাংশই ঘোল নামে পরিচিত। এতে দুধের প্রোটিন, ফ্যাট ভিন্ন আর সব উপাদানই বিদ্যমান। সাথে থাকে উপকারী প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া। এটি মূলত পনির বা মাখন উৎপাদনের একটি প্রধান উপজাত। পনিরের তুলনায় সস্তা হওয়ায় উপমহাদেশে আবহমান খাদ্য সংস্কৃতিতে ঘোলের চিরন্তন এক আবেদন রয়েছে। গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মানুষের কাছে এক দিকে হজমে সহায়ক, অন্যদিকে প্রশান্তিদায়ক ঠান্ডা পানীয় হিসেবে ঘোল খুবই জনপ্রিয়।
ঘোল পান করলে পুষ্টিগুণের সাথে সাথে প্রচণ্ড গরমে শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ করে শরীরকে সতেজ রাখে। এ কারণেই গরমের দিনে ঘোলের কোনো বিকল্প পানীয় নেই। তপ্ত রোদে সস্তায় এমন পানীয় যেন অমৃতের স্বাদ এনে দেয়। তাই শরীর ঠান্ডা রাখতে সকাল/দুপুর যেকোনো সময় ঘোল রাখতেই পারেন।
গরমের সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে ডায়রিয়া ও আমাশয় ছড়িয়ে পড়ে। এসবের হাত থেকে বাঁচতে নিরাপদ পানি এবং শরীর ঠান্ডা রাখে এমন স্বাস্থ্যপযোগী খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব। আসুন, কালবিলম্ব না করে আমরা এই তীব্র গরমে পেট এবং শরীর ঠান্ডা রাখে এমন খাদ্যাভ্যাসের পরিকল্পনা করি। সুস্থ থাকি।
অধ্যাপক ড. মিহির লাল সাহা ।। চেয়ারম্যান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়