বিমসটেক ও বাংলাদেশ : সম্ভাবনার কূটনৈতিক জাগরণ

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গঠিত BIMSTEC (Bay of Bengal Initiative for Multi-Sectoral Technical and Economic Cooperation) একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক উদ্যোগ।
এর লক্ষ্য ছিল অর্থনীতি, প্রযুক্তি, পরিবহন, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন, জঙ্গিবাদ দমন এবং দারিদ্র্য হ্রাসসহ নানাবিধ খাতে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা। বর্তমানে এই সংগঠনটি মোট ১৪টি খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, পরিবহন ও সংযোগ, শক্তি বিনিময়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পর্যটন এবং শিক্ষা খাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এই আঞ্চলিক সংগঠনের সাফল্য নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে, তবে বঙ্গোপসাগর ঘিরে বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, বিশেষত বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-মায়ানমার সম্পর্কের জটিলতা, BIMSTEC-এর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার যথেষ্ট আশঙ্কা তৈরি করছে।
BIMSTEC-এর অসফল হওয়ার পেছনে সদস্য দেশগুলোর রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি বড় কারণ হিসেবে কাজ করছে, যা সংগঠনটির ধারাবাহিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। যেমন, মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান এবং শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট BIMSTEC-এ তাদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। এর সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নাটকীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনও যুক্ত হয়েছে, যা সমন্বিত উদ্যোগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করা যায়।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ২০তম BIMSTEC সামিটে অংশগ্রহণ করেছেন এবং তাকেই পরবর্তী দুই বছরের জন্য BIMSTEC-এর সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যদি এই পদটি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদাধিকার বলে ধরা হয়। তবে বিষয়কে ইতিবাচকভাবে দেখাও সম্ভব। যেহেতু তিনি রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত নন, তাই আঞ্চলিক রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক তাকে এই দায়িত্ব প্রদান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতাকে নতুন মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে।
বর্তমানে এই সংগঠনটি মোট ১৪টি খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, পরিবহন ও সংযোগ, শক্তি বিনিময়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পর্যটন এবং শিক্ষা খাত বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক দিক ছিল ভারত-বাংলাদেশ বৈঠকের বিষয়টি, যা অনেকের মতে বিমসটেক-এর মূল আলোচনার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একাধিক ছবিগুলো আলাদা ইঙ্গিত দেয়।
যেমন শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা এই সামিটে অংশগ্রহণের সময় বাংলাদেশকে ASEAN-এ অন্তর্ভুক্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং সে লক্ষ্যে উদ্যোগও নিয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা হয়তো বাংলাদেশের ওপর যে চরম দ্বিপাক্ষিকতার অভিযোগ রয়েছে, তা কাটিয়ে বহুপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
এছাড়া সাইডলাইন বৈঠকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ যে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে, তাও দারুণ আশাব্যঞ্জক। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মিয়ানমার অতীতেও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং তা রক্ষা করেনি—ফলে এবারের ঘোষণাকে বাস্তবায়নের আগে পূর্ণ আস্থা রাখা কিছুটা সাবধানতার দাবি রাখে।
বাংলাদেশ-ভারতের মাঝে যে সাইডলাইন বৈঠক হয়েছে সেটি ছিল প্রায় ২০-২৫ মিনিট দীর্ঘ। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুমাত্রিক কাঠামো বিবেচনায় নিলে, এই বৈঠকে ফলপ্রসূতা আশা করা যায়। এর মধ্যেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, সীমান্ত হত্যা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপদ প্রত্যাবর্তন প্রসঙ্গে স্পষ্ট অবস্থান উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে—যা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন
তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যথেস্ট সংবেদনশীল। ভারতের সাতটি রাজ্য ঘিরে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান যাই হোক না কেন, বারবার এ বিষয়টির উচ্চারণ কূটনৈতিকভাবে বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কারণ ভারতের কাছে এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয় এবং বারবার এর উল্লেখ দুই দেশের সম্পর্ককে ধীরে ধীরে শীতল, এমনকি হঠাৎ করে উত্তপ্তও করে তুলতে পারে।
সব মিলিয়ে, বিমসটেক সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের তুলনায় আরও বেশি গুরুত্ব বহন করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ যেন প্রস্তুতিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল সদস্য রাষ্ট্রের মতো করেই এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা—এই সম্মেলনের ফলাফল কতটা ইতিবাচকভাবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও আঞ্চলিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে, তা জাতি হিসেবে আমরা আগ্রহ ও প্রত্যাশার সঙ্গে দেখব।
তবে আলোচনাটি শুধুমাত্র বাংলাদেশ কেন্দ্রিক না রেখে BIMSTEC সংগঠনকেও একটি সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। BIMSTEC-এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল আঞ্চলিক সংযোগ বৃদ্ধি, কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, অধিকাংশ সদস্য দেশে রেল, সড়ক ও সামুদ্রিক যোগাযোগের কাঠামো এখনো কাঙ্ক্ষিতভাবে গড়ে ওঠেনি। BIMSTEC মোটরযান চুক্তি ও উপকূলীয় শিপিং চুক্তিও এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। ফলে অঞ্চলজুড়ে বাণিজ্য ও মানুষের চলাচল কার্যকরভাবে প্রসারিত হতে পারছে না।
এই সীমাবদ্ধতার পেছনের কারণগুলো বের করা জরুরি। সদস্য দেশগুলোর অনেকেই SAARC, ASEAN, BBIN-এর মতো অন্যান্য আঞ্চলিক জোটেরও সদস্য, ফলে মনোযোগ বিভক্ত হওয়া কিংবা আগ্রহ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। বাস্তবতাও বলছে, BIMSTEC-কে অনেক সময়েই প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে যতটি সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল, তার হয়নি, যা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করেছে।
সবচেয়ে বড় যে সংকটটি চোখে পড়ে তা হলো, সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যে আন্তরিকতার অভাব। ভারত এখানে সবচেয়ে প্রভাবশালী সদস্য, যার প্রভাব অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি। এই বৈষম্য ছোট দেশগুলোর মধ্যে নিরুৎসাহ ও আস্থাহীনতা তৈরি করে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতার পথকে আরও কঠিন করে তোলে। যেমন SAARC কার্যকারিতা হারিয়েছে, BIMSTEC-এর ক্ষেত্রেও তেমন পরিণতির আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিমসটেক সম্মেলনটি বাংলাদেশের জন্য অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের তুলনায় আরও বেশি গুরুত্ব বহন করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ যেন প্রস্তুতিপূর্ণ ও দায়িত্বশীল সদস্য রাষ্ট্রের মতো করেই এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছে।
আরও হতাশার বিষয় হলো, ২০১৪ সালে ঢাকায় BIMSTEC-এর স্থায়ী সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও তা এখনো পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেট সংকটে ভুগছে। সচিবালয়ের কার্যক্রম তথ্য সংরক্ষণ ও সমন্বয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশের সরকার প্রধান যেহেতু বর্তমানে সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন, তিনি এই স্থবিরতা কাটিয়ে সংগঠনকে কোনো গতিশীল পথে এগিয়ে নিতে পারেন কি না।
তবে সংগঠনের অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রেও বেশকিছু আলাদাভাবে নোটিশ করার মতো। বর্তমানে BIMSTEC মোট ১৪টি খাতে কাজ করছে—যার মধ্যে রয়েছে বাণিজ্য, পরিবহন, কৃষি, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রযুক্তি। এত সংখ্যক খাতে একযোগে কার্যক্রম পরিচালনার ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া চ্যালেঞ্জের।
উদাহরণস্বরূপ, বহু বছর পার হলেও BIMSTEC Free Trade Agreement (FTA) এখনো চূড়ান্ত হয়নি। BIMSTEC-এর দীর্ঘদিন কোনো শক্তিশালী চুক্তিভিত্তিক আইন বা সনদ (Charter) ছিল না। এটি একটি ঢিলেঢালা সমঝোতার ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছিল, যার ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা যায়নি।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০২২ সালে BIMSTEC-এর প্রথম চার্টার গৃহীত হলেও, তা এখনো পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তদুপরি, BIMSTEC-এর নিজস্ব কোনো গবেষণা বা নীতিনির্ধারণী উপদেষ্টা সংস্থা বা থিংক-ট্যাংক নেই, ফলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণে তথ্য নির্ভরতা কম এবং দৃষ্টিভঙ্গি সীমিত থাকে। এর ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া হয় ধীরগতির ও কম কার্যকর। সর্বোপরি, BIMSTEC-এর সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া একমতভিত্তিক (consensus-based), যার ফলে একটি দেশ দ্বিমত পোষণ করলেই যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে জটিলতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশিদের প্রত্যাশার তালিকা দীর্ঘ, আর বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে ভাবনার অভাব সেই আকাঙ্ক্ষার ভারকে আরও ভারি করে তোলে। আমরা চাই, এই BIMSTEC সামিট যেন আমাদের আশা পূরণ করে। যে কূটনৈতিক তৎপরতা আমরা দেখিয়েছি, তা যেন টেকসই ও কার্যকর হয়। যেন বিশ্বায়নের যুগে আমরাও এগিয়ে থাকতে পারি। বাংলাদেশের উদ্যম ও প্রত্যাশাই হোক BIMSTEC-এর গতি ও ভবিষ্যতের প্রধান চালিকাশক্তি।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়