উৎসবে আমেজে অর্থনীতির গতিপথ

বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে জমে ওঠে অর্থনীতি। অর্থনীতির বড় অনুষঙ্গ হলো কেনাকাটা। ক্রেতাকে আহ্বান জানাতে দোকান মালিকরা বিপণিবিতানগুলো হরেকরকমের আলোকসজ্জায় সাজিয়ে তোলে। যেকোনো উৎসবেই চিরচেনা এই চিত্র ফুটে ওঠে।
বিজ্ঞাপন
এবারও ঈদের আগে একই চিত্রের দেখা মেলে। সন্ধ্যার পর থেকেই সব বিপণিবিতানগুলোর আলোকসজ্জা জানান দেয় উৎসবের আনন্দে মেতেছে দেশ। প্রতিটি উৎসবই আমাদের মন ও পরিবেশ আলোকিত করার সাথে সাথে অর্থনীতিও আলোকিত করে। অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে সবক্ষেত্রে, প্রভাব রয়েছে প্রতিটি উৎসবে।
আরব অর্থনীতি হজের আগমনের ও পশ্চিমা অর্থনীতি যেমন বড়দিনের অপেক্ষায় থাকে, ঠিক তেমনি আমাদের দেশের অর্থনীতিও ঈদ, পহেলা বৈশাখ, দুর্গাপূজা ইত্যাদির জন্য অপেক্ষা করে। গ্রামীণ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় ভিত্তি হচ্ছে উৎসব। প্রধান উৎসবগুলো বিশেষ করে পাইকারি, খুচরা বাজার, পরিবহন, পর্যটন এবং আতিথেয়তার মতো খাতে, ভোক্তাদের ব্যয় এবং চাহিদা বৃদ্ধির কারণে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কার্যকলাপকে উৎসব অর্থনীতি বোঝায়।
বিজ্ঞাপন
ঈদ ও পহেলা বৈশাখ এই দুটি উৎসব প্রায় দুই থেকে তিন বছর ধরে একসাথে আসছে, তাই উৎসব অর্থনীতির মূল লক্ষ্য ঈদ ও নববর্ষকে ঘিরে। ঈদের বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়েই রয়েছে বস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী। ঈদুল ফিতর উৎসবের সময়, রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু হয় ভোগ্যপণ্যের বেচাকেনা। সবার জন্য অপরিহার্য হিসেবে রয়েছে সেমাই, চিনি, ছোলা, ডালসহ অনেক পণ্য। এরপর শুরু হয় পোশাকের কেনাবেচা।
কাপড়ের মধ্যে পায়জামা, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, শাড়ি, লুঙ্গি ও টুপি প্রধান। এরপর রয়েছে জুতা, প্রসাধনী, স্বর্ণালঙ্কার। আর এর প্রভাব একেবারে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে চলে যায়। ঈদ উপলক্ষে শহরের মানুষ হয় গ্রামমুখী। আর সারা বছর স্তিমিত হয়ে থাকা গ্রামের হাটবাজার কয়েক দিনের জন্য দারুণ চাঙা হয়ে ওঠে।
বিজ্ঞাপন
গ্রামীণ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতির বড় ভিত্তি হচ্ছে উৎসব। প্রধান উৎসবগুলো বিশেষ করে পাইকারি, খুচরা বাজার, পরিবহন, পর্যটন এবং আতিথেয়তার মতো খাতে, ভোক্তাদের ব্যয় এবং চাহিদা বৃদ্ধির কারণে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কার্যকলাপকে উৎসব অর্থনীতি বোঝায়।
ঈদ বোনাস মানুষের একটি বৃহৎ অংশের নিষ্পত্তিযোগ্য আয় বৃদ্ধি করে। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ঈদ উদযাপনের জন্য তাদের পরিবারে আরও বেশি রেমিট্যান্স পাঠায়। মনে রাখতে হবে, আমাদের অর্থনীতি মূলত সহনীয় ভোগ ও চাহিদানির্ভর। এই চাহিদার বড় উৎস রেমিট্যান্স খাত। বছরের মার্চ মাসের প্রথম ১৯ দিনে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় এসেছে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকা হাতবদল হয়ে সমাজে কতটা ঘুরল তার ওপর অর্থনীতির গতিশীলতা নির্ভর করে। মুদ্রা যত বেশি হাতবদল হবে, অর্থনীতি তত বেশি গতিশীল হবে। মানুষের হাতে টাকা যাবে, ব্যয় হবে, আরেকজন পাবে—এভাবেই অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকবে।
ঈদুল ফিতরকে অনেকে ফিতরা বিতরণের উৎসব হিসেবেও পরিচিত করে থাকে, যা ধনী থেকে দরিদ্র পর্যন্ত দানশীলতারই একটি রূপ। ধনী মুসলমানরা ঈদুল ফিতরের সময় ফিতরা ছাড়াও জাকাত বিতরণ করেন। জাকাতকে ঘিরে গরিব-অসহায় মানুষের মাঝেও ঈদ অর্থনীতির ছোঁয়া লাগে। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাকাত ও ফিতরা ব্যবস্থাপনার সুফল অপরিসীম।
বাংলাদেশের অন্যতম আরেকটি উৎসব ঈদুল আযহা। প্রতি বছর ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গরু-ছাগল কেনাবেচা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। ভারত থেকে অবৈধ পথে গরু আসা অনেকটা কমে যাওয়ায় বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ জুড়ে বহু ছোট-খাট খামার গড়ে উঠেছে, যার মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট।
আরও পড়ুন
গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য গরু-ছাগল লালনপালন করে। কোরবানিতে গরু-ছাগল আমাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে অর্থের সরবরাহ বাড়ায়। গ্রামের পশু শহরে আসে। শহরের টাকা গ্রামে যায়। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা করতে কোরবানির ঈদ বড় ভূমিকা রাখে।
এছাড়া কোরবানিকৃত পশুর চামড়া আমাদের অর্থনীতিতে রপ্তানি বাণিজ্যে, পাদুকা শিল্পে, পোশাক, হস্তশিল্পে এক অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।
সারাবছর পরিবহন খাত একই গতিতে চললেও ঈদ উৎসবে দেখা যায় ভিন্ন মাত্রা। বাসের টিকেট, ট্রেনের টিকেট, প্লেনের টিকেট, লঞ্চের কেবিন সব বুকিং হয়ে যায় ঈদের ১৫-২০দিন আগেই। কালোবাজারিরাও তাদের কালো হাত বাড়িয়ে দেয় এই সুযোগে। স্বাভাবিকভাবে টিকেট না পেলে, অনেক সময়ই পাওয়া যায় এসব কালোবাজারির কাছে। এরা দ্বিগুণ-তিনগুণ মূল্যে বিক্রি করছে এসব টিকেট। এরপরও সবাই ছুটে চলেছে নাড়ির টানে নিজ ঠিকানায়।
বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও উৎসবের জোয়ারের টান লাগে। সামর্থ্যবানরা দেশের বাইরে গেলেও মধ্যবিত্তরা ছুটে যান দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোয়। এজন্য দেশের পর্যটন শিল্পও এ সময়ে যথেষ্ট লাভবান হয়। এবারের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৯ দিনের সরকারি ছুটিতে পর্যটন কেন্দ্রগুলো ভরে উঠবে ঈদ আনন্দে এমনই আশা করছে বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের কর্মকর্তাগণ।
মুদ্রা যত বেশি হাতবদল হবে, অর্থনীতি তত বেশি গতিশীল হবে। মানুষের হাতে টাকা যাবে, ব্যয় হবে, আরেকজন পাবে—এভাবেই অর্থনীতির চাকা গতিশীল থাকবে।
যত দিন যাচ্ছে জাতীয় অর্থনীতিতে পহেলা বৈশাখ ততই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অর্থপ্রবাহের দিক দিয়ে ধর্মীয় বড় উৎসব রমজানের ঈদের পরেই বাংলা নববর্ষের অবস্থান। আর গ্রামবাংলার অর্থনীতিতে এর শিকড় আরও অনেক গভীরে। পহেলা বৈশাখে মাছ ও মিষ্টিজাত সামগ্রী খাতেও ব্যাপক অর্থের লেনদেন হয়। ঢাকাসহ সারা দেশের মিষ্টির দোকানগুলোয় হয় শত শত মণ মিষ্টিসামগ্রীর বেচাকেনা। নতুন বছরের প্রথম দিনে অতিথি আপ্যায়নসহ একে অপরকে মিষ্টিমুখ করানোর রীতিনীতি পুরোনো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা বেশ গতি পেয়েছে। নববর্ষের নতুন কর্মযজ্ঞে জেগে ওঠে কামার, কুমার ও কুটিরশিল্পীরা। মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, শানকি, সরা, ফুলের টব থেকে শুরু করে নানা পণ্যসম্ভারের লেনদেনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার হয়।
নববর্ষকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ঠাঁই পাওয়া অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। বছরজুড়ে তেমন চাহিদা না থাকলেও গ্রামীণ শিল্পী বিশেষ করে বাউল ও বয়াতিদের পহেলা বৈশাখে বেশ চাহিদা বাড়ে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ অবহেলিত এই শিল্পীগোষ্ঠী ও জড়িত মানুষদের কর্মসংস্থান হয়।
এছাড়া বিভিন্ন উৎসব বর্তমানে ই-কমার্স খাতের ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা দ্বার তৈরি করেছে। এখন মানুষ ঘরে বসেই অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারছে, আর উদ্যোক্তারাও সহজেই তাদের পণ্য ও সেবা ডিজিটাল মাধ্যমে বাজারজাত করতে পারছে। এতে ব্যবসার সুযোগ যেমন বাড়ছে, তেমনি অর্থ লেনদেনের নতুন নতুন মাধ্যমও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মোবাইল ব্যাংকিং ও ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যবহারের ফলে অর্থ স্থানান্তর সহজ হয়ে উঠছে।
বছর ঘুরে আসছে খুশির ঈদ, নববর্ষ। এবারের বাংলা নববর্ষ এবং রোজার ঈদ আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আনন্দে ভাসছে সবাই। নতুন জামা কেনা-কাটায় ব্যস্ত মানুষ। মানুষের আর্থিক লেনদেন বেড়েছে এর ফলে অর্থনীতিতে গতি প্রবাহ বেড়েছে বহুগুণ। আনন্দ প্রবাহের মাধ্যমে সকল গ্লানি মুছে যাক। ২০২৫ সাল আমাদের সবার জন্য মঙ্গলময় হোক, ঘুরে দাঁড়াক বাংলাদেশের অর্থনীতি, এটাই প্রত্যাশা।
রুনা সাহা ।। সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়