অভিযোগ ও উত্তর খোঁজা

প্রশ্ন করতে হয় পিনপয়েন্টে। তা হলো, কেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চলছে? কে করছে এইসব এবং কার ইশারায়? এ দেশের জনগণের জানার, বোঝার অধিকার আছে।
বিজ্ঞাপন
যারা দেশকে রক্ষা করতে এই দুঃসময়ে রাত দিন পরিশ্রম করছেন। নিশ্চয়ই সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি দৃপ্তভাবে আমার দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং সেনাবাহিনীর পাশে। আর তখনই প্রশ্ন জাগরিত হয় এখনকার কোনো কোনো তরুণ নেতৃবৃন্দের নানাবিধ কর্মকাণ্ড ঘিরে। কী চায় তারা? বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা কি তারা দেখতে চায় না? তারা কি চায় না জনগণের জন্যে শান্তি ফিরে আসুক?
সম্প্রতি আমার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে সদ্য জন্মানো জাতীয় নাগরিক কমিটির অন্যতম নেতা আবুল হাসনাতের দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্ট। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ কুশাসন এবং ভয়াবহ রকম লুটপাটের কবল থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে আরেকটি স্তরে নিতে যে কয়েকজন তরুণ ভূমিকা রেখেছেন, হাসনাত সেই সাহসীদের তালিকায়। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে নেমে আসা জনতা তাকেও দিয়েছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। সেই ভালোবাসাকে পোক্ত করতে তাদের সাহসের মাঠে সরাসরি সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাশে থেকেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তার দৃঢ় এবং সঠিক নেতৃত্ব না হলে আগস্টের রক্তাক্ত দিনগুলো আরও বেদনার্ত হয়ে উঠতো। বাংলাদেশ হয়তো প্রবেশ করতো একটি অনিবার্য ভয়াবহ সংকটে।
বিজ্ঞাপন
সেই সংকটের উত্তরণে নিঃসন্দেহে কাণ্ডারির ভূমিকা রেখেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সাথে তার সতীর্থ কমান্ডাররা। অথচ তাকেই এখন প্রশ্নবিদ্ধ করতে পিছ পা হচ্ছে না আগস্ট অভ্যুত্থানের অনেক কলাকুশলী। তাদের অনেকেই রাজপথে, মাঠে-ঘাটে, অনলাইনে নানাবিধ নোংরা বাক্য ছড়াতে ব্যস্ত। অথচ তারা ভুলে যাচ্ছে আমাদের সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক। ভুলে যাচ্ছে তারা, সেনাবাহিনী প্রধান একজন ব্যক্তি নন, তার পদটি একটি প্রতিষ্ঠান, সুতরাং তিনি পদাধিকারেই একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে কুতর্ক রচনা করলে বাংলাদেশ আঘাত পায়, আঘাত পায় এ দেশের সার্বভৌমত্বের শক্তি।
তরুণ নেতা হাসনাত ফেসবুকে কী পোস্ট করেছেন? তিনি লিখেছেন, “১১ই মার্চ সময় দুপুর ২:৩০। কিছুদিন আগে আমি আপনাদের বলেছিলাম যে, 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ' নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে। এই পরিকল্পনা পুরোপুরি ভারতের। সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরীন শারমিন চৌধুরী, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। আমি সহ আরও দুইজনের কাছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে এই পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয় ১১ই মার্চ দুপুর ২:৩০এ।
বিজ্ঞাপন
আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন সমঝোতার বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয়-ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে-তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো। ফলশ্রুতিতে আপনি দেখবেন গত দুইদিন মিডিয়াতে আওয়ামী লীগের পক্ষে একাধিক রাজনীতিবিদ বয়ান দেওয়া শুরু করেছে। আমাদেরকে আরও বলা হয়-রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল- মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে।
আমাদেরকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলে আমরা তৎক্ষণাৎ এর বিরোধিতা করি এবং জানাই যে, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে কাজ করুন। এর উত্তরে আমাদের বলা হয়, আওয়ামী লীগকে ফিরতে কোন ধরণের বাধা দিলে দেশে যে সংকট সৃষ্টি হবে, তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে এবং 'আওয়ামী লীগ মাস্ট কাম ব্যাক'।
আলোচনার এক পর্যায় বলি- যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা, কিভাবে ক্ষমা করে দিবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, "ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম এন্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। তোমার বয়সের থেকে বেশি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া 'ইনক্লুসিভ' ইলেকশন হবে না।"
উত্তরে বলি, 'আওয়ামী লীগের সাথে কোন ইনক্লুসিভিটি হতে পারে না। আওয়ামী লীগকে ফেরাতে হলে আমাদের লাশের উপর দিয়ে ফেরাতে হবে । আওয়ামী লীগ ফেরানোর চেষ্টা করা হলে যে সংকট তৈরি হবে, তার দায়ভার আপনাদের নিতে হবে'। পরে- মিটিং অসমাপ্ত রেখেই আমাদের চলে আসতে হয়।”
আমার কাছে খুব বিস্ময়কর তার এই অভিযোগ! কেন? এর সারমর্ম দাঁড়ায়, সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চাইছে, আওয়ামী লীগকে আবার রাজনীতি করার সুযোগ দিতে, যার নেতৃত্বে থাকবেনা শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্য। আপন রক্ত। এ পর্যন্ত বুঝলাম। গণতান্ত্রিক ধারা মানেই প্রশ্ন করো, উত্তর খোঁজো। তৈরি করো নতুন ন্যারেটিভ অথবা আগের ন্যারেটিভের যৌক্তিক মীমাংসা নির্ণয় করো। সে প্রেক্ষিতেই স্বাভাবিক ধারায় কিন্তু কিছু প্রশ্ন চলে আসে।
ধরা যাক হাসনাত ও তার দুই বন্ধু এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের ভেতর একটি আলোচনা হয়েছে। কবে হয়েছে? হাসনাত বলেছে ১১ মার্চ। তাহলে দশদিন পর ২১ মার্চ কেন তা প্রকাশ করা? কোন উদ্দেশ্যে এই দশদিন তা গোপন রাখা? আবার কি উদ্দেশ্যেই সেটি জনগণের সামনে এনে সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পেশাগত জায়গাটিকে এখন প্রশ্নবিদ্ধ করা? সবটাই বড়ই ধোঁয়াশা। এমন ধরনের ধোয়ার মাঝে অনেক বিপদ ওত পেতে থাকে। সে বিপদ হলো, নিজের দেশকে বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেওয়ার কৌশল।
আরও পড়ুন
আচ্ছা, এমন একটি ঘটনা যা কী না কনফিডেনসিয়াল মত বিনিময়। তাহলে এথিকস রইলো কোথায় সেসব প্রকাশ করার? নেতা হতে গেলে হতে হয় ধীর-স্থির, প্রজ্ঞাবান এবং নিজের মাঝে সৃষ্টি করতে হয় গভীরতা। কিন্তু এখানে দেখছি সেসব অনুপস্থিত। যদি প্রশ্ন করা হয়, হাসনাত, আপনাকে কি কেউ ক্যান্টনমেন্টে ডেকেছিল? নাকি নিজে নিজে সেখানে গিয়েছিলেন? এর সদুত্তর আপনি দেননি। মিডিয়া এ নিয়ে আপনাকে প্রশ্ন করছিলো, খুব সতর্কতায় দ্বন্দ্ব তৈরি করে আপনি এড়াচ্ছিলেন, দেখেছি। সত্যটা কি এই নয়, রেকর্ড আছে যে, আপনাকে কেউ ডাকে নাই। আপনি নিজ থেকে সেখানে গিয়েছিলেন। তাহলে এখন অন্যদিকে মোড় ঘুরানোর চেষ্টা কেন? আবারো প্রশ্ন, উদ্দেশ্যটা কী? আরও প্রশ্ন আছে। হাসনাত, আপনার এই প্রকাশিত বক্তব্য কি আপনার রাজনৈতিক দল এনসিপির বক্তব্য? আপনি কি এনসিপির নেতৃবৃন্দের অনুমোদন নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন?
লক্ষ্য করছি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নেই। আরও লক্ষ্য করছি, যেদিন হাসনাত পোস্ট করলো, ঠিক একইদিনে এই সরকারের ক্রীড়া বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ভিডিও মেসেজ ছেড়েছেন এই বলে, সেনাবাহিনী প্রধান চাননি প্রফেসর ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করতে। বাহ, বেশ তো! এ কথা তো তাহলে গত আগস্টের। কিন্তু সাত মাস পর এনসিপির নেতা হাসনাতের সাথে এখন বলা কেন?
সব দেখে আর শুনে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের নাগরিকেরা গোয়েন্দা কাহিনির সামনে। এদেশের নাগরিকেরা যেন আর বিশুদ্ধ রাজনীতির দেখা পাচ্ছেন না। গতরাতে, শুক্রবারে, ইউটিউব দেখলাম পিনাকী ভট্টাচার্য, ইলিয়াস এবং ডক্টর কনক সারায়োর মিলে গল্প করছে। সেখানে পিনাকী বলছে, “হাসনাতকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন তোমার এই গোপন মিটিং এর কথা আমাকে জানাও নাই?” হাসনাত বলে, “দাদা আমি রাজনীতি বুঝি না। খেয়াল করিনি বলতে হবে। যখন যা মাথায় আসে বলে ফেলি।”
হাসনাতের গুরুর মুখে উচ্চারিত এমন সত্য কথা শোনার পর সত্যিই হতভম্ভ আমি। ভাবছি, কী করে একজন তরুণ নেতা এমন দায়িত্বহীন কথা বলতে পারে যিনি কী না আগামীর বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে চান? তাহলে কি প্রশ্ন উঠে আসবে না, তার কাছে বাংলাদেশের রাজনীতি বা সেনাবাহিনীর অবস্থান বা সেনাবাহিনীর মর্যাদা কতটুকু বজায় থাকবে?
হাসনাতের এই পোস্টের পর দেশের রাজপথে আবার অস্থিরতা। এনসিপি জমায়েত করছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ঠেকাতে। সে না হয় করলো, কিন্তু এই জাতীয় জমায়েত থেকে তারা বিরতিহীনভাবে সেনাবাহিনী প্রধানকে টার্গেট করে অপবাদ ও আঘাত করেই চলেছে। সেনাবাহিনীর মাঝে বিভক্তি তৈরি হলে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এটা কি কোনো দেশপ্রেমিকের কাম্য হতে পারে? পারে না। কিন্তু তারা তো সবাই মুক্তমনে গঠনমূলকভাবে চিন্তা করছে না।
হাসনাতদের গুরুরা বাস করে উন্নত বিশ্বে। আমেরিকায়, ফ্রান্সে। যেখানে তাদরে জীবন সুখের, আয়েশের। তারা ইউটিউবে এসে দেশের জন্যে কেঁদে বুক ভাসায় এবং দেশের সাধারণ মানুষ, ছাত্র জনতাকে ঠেলে দেয় ভয়াবহ সংঘাতে। এতে করে তাদের কী যায় আসে? কিছুই ক্ষতি নাই তাদের। তারা নিজে ও তাদের পরিবার নিয়ে বাস করে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশে, রাজার হালে। মরে তো সব হতভাগা বাংলাদেশের লোকজন।
এখন রমজান মাস। হাসনাত এবং তাদের গুরুদের ক্রোধে সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়তে পারে? সে কথা কি তারা ভাবে? মোটেও না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখতে হলেও রাজপথে আন্দোলনের সময় এখন নয়। তাদের এই আন্দোলন এমন তো হতে পারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধ শক্তিতে সুযোগ করে দিতে পারে আমাদের বড় মাপের বিপদ ঘটাতে? বাংলাদেশকে দুর্বল করতে? এমন হলে লাভ কার? এমন নয় তো, সবার অলক্ষ্যে এ লাভ ক্ষমতা থেকে পতিত আওয়ামী লীগের পকেটে ঢুকবে যে দলের নেতারা লুটপাটের অর্থে বিদেশে আয়েশে আছে? এমন হলে কি লাভ অন্য দেশের, যারা কিনা আমাদের ভালো চায় না? খুব কি খারাপ শোনাবে যদি প্রশ্ন করি, রাজনীতি কম বোঝা হাসনাতের এমন উদ্দেশ্য কি আছে, এ সব কালো শক্তিকে সহায়তা করার?
এখানে একটা কথা বলা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমার এ লেখা যদি হাসনাতের চোখে পড়ে, ভাববে নিশ্চয়ই হাজারো সুবিধাবাদীর মতো আমিও। কিন্তু বলি, আমি ছিলাম জাপানি আর জার্মানি দূতাবাসের রাজনৈতিক উপদেষ্টা, সবমিলিয়ে সিকি শতাব্দী। কিন্তু আজও না আছে বাড়ি, না আছে গাড়ি। বয়সটা চৌষট্টি পেরুল। আপনার মতো আমিও পড়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আশির দশকের শুরুর দিক। বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক মঞ্চের। সেজন্যেই এটুকু বলতে চাই, যা বলছি নিজের সব রকম সততা নিয়ে দেশ আর জনগণের প্রয়োজনে বলছি। একজন প্রবীণ প্রাজ্ঞজন হিসেবে তরুণদের বলছি, ক্ষমতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করা থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে, এই বাংলাদেশ সব দিক থেকে ভেঙে পড়তে পারে। ভূলুণ্ঠিত হতে পারে এ দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ ।। রাজনৈতিক বিশ্বেষক, কবি ও কথাশিল্পী