ধর্ম যার যার, ঈদ আনন্দ সবার

ঈদুল ফিতর (যার অর্থ, রোজা/উপবাস ভাঙার আনন্দ) মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মীয় উৎসবের একটি। অন্যটি, ঈদুল আযহা। ধর্মীয় পরিভাষায় একে ইয়াওমুল জায়েজ (পুরস্কারের দিবস) হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনা এবং ফিতরা ও জাকাত আদায়ের পর এই দিনটি ধর্মীয় আবহে আনন্দঘন পরিবেশে পালন করে থাকে ইসলাম ধর্মের অনুসারীবৃন্দ।
বিজ্ঞাপন
ঈদুল ফিতর উদযাপনের শুরু ইসলামের সূচনালগ্নেই হয়। হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষে প্রথমবারের মতো মুসলমানরা এই উৎসব পালন করেন। ঈদুল ফিতর ইসলামিক বর্ষপঞ্জির দশম মাস শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে উদযাপিত হয়। মহানবী (সা.) নির্দেশ দিয়েছিলেন, 'এই দিনে সবাই একত্রিত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করবে, একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাবে এবং দরিদ্রদের মাঝে সদকা প্রদান করবে।'
প্রায় চার দশক আগে ছোটবেলায় আমি দেখেছি আমার সরকারি চাকরি করা বাবা আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঈদের দিনে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুবান্ধবদের জন্যও খাবারের আলাদা ব্যবস্থা করতেন। অন্যদের মাঝে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক বাবুল স্যারও আমন্ত্রিত থাকতেন। ঈদের দিনের নিত্যচেনা সেমাইয়ের পাশাপাশি খাসির মাংস দিয়ে খিচুড়িও রান্না করা হতো। তারা পেট ভরে খেয়ে দীর্ঘ আড্ডা দিতেন।
বিজ্ঞাপন
সে বয়সে ঈদের দিনে বাবার এমন আলাদা আয়োজনের কারণ খুব একটা বুঝতাম না। বড় হয়ে ঠিক বুঝেছিলাম এটি তার অন্তরে লুকিয়ে থাকা অসাম্প্রদায়িক মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও তার প্রচেষ্টা ছিল পবিত্র ঈদকে কেবল মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সর্বজনীনভাবে উদযাপনের।
বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দেশ, যেখানে ধর্ম, জাতি ও ভাষার সমন্বয়ে একটি সর্বজনীন সামাজিক বন্ধন গড়ে উঠেছে। ঈদ মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি কেবল একটি ধর্মীয় আচার নয় বরং এটি সর্বজনীন উৎসব যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যে আনন্দের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে ঈদ উৎসব একটি মিলনমেলার মতো, যেখানে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয়; ফলে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঈদ উৎসবের সর্বজনীনতা, এর ঐতিহ্য, গুরুত্ব এবং ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে সীমিত পরিসরে আলোকপাত করা হবে এ লেখায়।
বিজ্ঞাপন
ধর্মীয় তাৎপর্য
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা—এই দুটি প্রধান ঈদ বাংলাদেশের মুসলমানদের জীবনে গভীর তাৎপর্য বহন করে। ঈদুল ফিতর এক মাস রোজার পর আসে, যা আত্মশুদ্ধি ও সংযমের প্রতীক। অন্যদিকে, ঈদুল আজহা কোরবানির মাধ্যমে আত্মত্যাগ ও মানব সেবার গুরুত্ব তুলে ধরে। ঈদুল ফিতর রমজান মাসের শেষের দিনে পালিত হয়, যা এক মাস রোজা রাখার পর আত্মশুদ্ধির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে, ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ নামে পরিচিত, যা ত্যাগের মহিমাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই দুটি ঈদই মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ধর্মীয় বিধান পালন করার পাশাপাশি আনন্দ ও সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরি হয়।
ঈদ উৎসবের সর্বজনীনতা
বাংলাদেশে ঈদ উৎসব শুধু মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি একটি সর্বজনীন উৎসব। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সব ধর্মের মানুষ এই উৎসবের আনন্দে অংশগ্রহণ করে। ঈদের দিনে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই একত্রিত হয়, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায় এবং মিষ্টি ও খাবার বিনিময় করে। ভিন্ন ধর্মের যারা তারাও ঈদের ছুটি আনন্দময় করতে যার যার পছন্দমতো অবকাশ যাপনের সুযোগ কাজে লাগান।
সামাজিক সম্প্রীতি ও সংহতি
ঈদ উপলক্ষে দেশের বড় বড় শহরগুলো থেকে স্রোতের মতো মানুষ গ্রামেগঞ্জে তাদের শেকড়ের সন্ধানে যায়। এ বিশেষ দিবসে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে সবাই ঈদের নামাজ পড়তে একত্রিত হয় এবং প্রার্থনা শেষে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করে। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি, উপহার বিনিময় এবং একে অপরকে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে পরস্পরের ভুল বোঝাবুঝি নিরসন হয়, এবং ফলে সুসম্পর্ক ও সম্প্রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে ঈদ উৎসব সমাজে সম্প্রীতি ও সংহতির বন্ধন দৃঢ় করে।
আরও পড়ুন
অর্থনৈতিক প্রভাব
ঈদের আমেজ কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ঈদের সময় বাজারে নতুন নতুন পোশাক সামগ্রী, প্রসাধনী, ইত্যাদি পাওয়া যায় বলে মুসলমানদের পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মের লোকজনদেরও বাজারে ভিড় জমাতে দেখা যায়।
ঈদ উৎসবকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, বিশেষত পোশাক, খাদ্য, গৃহস্থালি পণ্য এবং বাজারে ব্যাপক বেচাবিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন শহর ও গ্রামে মেলা বসে, যেখানে স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসার বিকাশ ঘটে। এছাড়া, প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঈদ উপলক্ষে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত দিক
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবের সঙ্গে কিছু বিশেষ ঐতিহ্য জড়িয়ে আছে। সকালে ঈদের নামাজ পড়ার পর আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে যাওয়া, বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার তৈরি করা, শিশুদের নতুন পোশাক উপহার দেওয়া, সমাজের দরিদ্রদের সাহায্য করা—এসব ঐতিহ্য সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। তাছাড়া, ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যেখানে নাটক, সংগীত ও বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান থাকে। পাশাপাশি, বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, যেমন গরিব-দুঃখীদের মাঝে নতুন পোশাক বিতরণ, ফ্রি খাবার সরবরাহ এবং ঈদ পুনর্মিলনী আয়োজন।
ঈদে প্রযুক্তির প্রভাব
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির প্রভাব ঈদ উদযাপনের ওপরও ব্যাপকভাবে পড়েছে। মানুষ এখন ব্যক্তিগত যোগাযোগের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে, অনলাইন শপিংয়ের মাধ্যমে কেনাকাটা করে এবং ভার্চুয়াল মাধ্যমে দূরদূরান্তে বসবাসরত আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। প্রযুক্তির ব্যবহার প্রবাসীদের জন্য দেশে থাকা নিকটজনদের সাথে যোগাযোগ খুবই সহজ করে দিয়েছে। তারা কেবল অডিও মাধ্যম নয়, ভিডিও মাধ্যমে যোগাযোগ করে পরস্পরকে দেখার সুযোগও পাচ্ছেন।
ঈদ ও দান-সদকা
ঈদ উপলক্ষে দান-সদকার গুরুত্ব অপরিসীম। জাকাত প্রদান করা মুসলমানদের জন্য ফরজ। সমাজে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাকাত বিতরণ করা হয়। ফিতরা সাধারণত খাদ্য সামগ্রী বা নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ দিয়ে প্রদান করা হয়। অপরদিকে, ঈদুল আজহার সময় কোরবানির মাংস সমাজের দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করা হয় যা সামাজিক সাম্যের প্রতীক। সত্য বলতে কি, দান ইসলাম প্রদর্শিত নিয়মে করা হলে কোনো মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে কোনো হতদরিদ্র বা কেউ না খেয়ে থাকার কথা নয়।
জাকাত প্রদান সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয়। তা হলো, একটি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে জাকাতের অর্থ বিতরণ দৃষ্টিনন্দন, এবং একইসাথে, নিরাপদ করা যেতে পারে। যেমন, ধনীরা বড় ধরনের জাকাতের অর্থ বিতরণ করতে চাইলে সে আয়োজন নিজেদের বাড়িতে না করে প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় স্থানীয় স্কুল বা উপাসনালয়ের মাধ্যমে করতে পারেন। এতে একদিকে যেমন জাকাত বিতরণ ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে, অপরদিকে তেমনি মানুষের ভিড়ে পদদলিত হয়ে প্রাণহানির মতো দুঃখজনক ঘটনাও এড়ানো যাবে।
বাংলাদেশে ঈদ কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সর্বজনীন উৎসব যা সব মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য ও আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। এটি ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। ঈদের মাধ্যমে আমরা ভ্রাতৃত্ববোধ, সহানুভূতি ও সামাজিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করতে পারি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ঈদ শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য নয়, বরং এটি এক মহা উৎসবে পরিণত হয়েছে, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয় এবং মিলেমিশে আনন্দ ভাগ করে নেয়। নিঃসন্দেহে, ঈদ উৎসব সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ায় এবং সামগ্রিকভাবে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি করে।
ঈদ উৎসবকে ধর্মীয় গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উদযাপন করা হলে এটি সামগ্রিক সম্প্রীতি ও ঐক্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সর্বজনীন ঈদ উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশে সামাজিক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায় যা জাতির অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। বাংলাদেশের ঈদ উৎসবকে সর্বজনীন করতে হলে সামগ্রিকভাবে সরকারি, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
ঈদের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব পক্ষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করবে। ঈদকে সর্বজনীন করার উপায় হিসেবে নিচের প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে।
ঈদের আনন্দ সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে অসচ্ছলদের জন্য বিনামূল্যে ঈদের পোশাক, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা যেতে পারে। এ কার্যক্রমে মুসলিমদের পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবম্বলীদেরও অন্তর্ভুক্তি বিবেচনা করা যায়।
ঈদের ছুটিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এমনভাবে সাজানো যেতে পারে যেন সব ধর্মের মানুষ তাতে অংশ নিতে পারেন। অধিকন্তু, নাটক, সংগীতানুষ্ঠান, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, পহেলা বৈশাখের মতো ঈদ মেলা আয়োজন করে তা সবার জন্য উন্মুক্ত করা যেতে পারে।
বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের একত্রিত করে পাড়া মহল্লায় সম্প্রীতির মিলনমেলা আয়োজন করা যেতে পারে। এতে করে সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে চলমান সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গভীরতর হবে।
সরকারি উদ্যোগে ঈদের দিন বা ঈদ-পরবর্তী দিনগুলোয় বিশেষ কর্মসূচির আয়োজন করা যেতে পারে যেখানে সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে।
ধর্মীয় সম্প্রীতির গুরুত্ব বোঝাতে মাধ্যমিক ও নিম্নপর্যায়ে পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
ঈদ উৎসবের সর্বজনীনতার বিষয়টি মাথায় রেখে তরুণদের উপযোগী লেখালেখি, বক্তৃতা ও উপযুক্ত শিল্পানুষ্ঠানের আয়োজন করে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জন্য এক মহিমান্বিত ও আনন্দের দিন। এটি কেবলমাত্র ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি দাতব্য, আত্মশুদ্ধি, সামাজিক সংহতি তথা আনন্দের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। ঈদুল ফিতর আমাদের শিক্ষা দেয় কীভাবে আত্মশুদ্ধি ও সংযমের মাধ্যমে মানবহিতকর ও উন্নত জীবন গঠন করা যায়, এবং একইসাথে, সমাজে ন্যায় ও সাম্যের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
ঈদের মহান শিক্ষা বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করে দেশের মুসলমানরা প্রমাণ করতে পারেন, ধর্ম যার যার, ঈদ-আনন্দ সবার।
এম এল গনি ।। কানাডীয় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট (আরসিআইসি)