যুদ্ধ বন্ধ ও নতুন পররাষ্ট্রনীতিতে ট্রাম্প কি সফল হবেন?

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে মোটামুটিভাবে একমত হয়েছে এর সাথে জড়িত পক্ষগুলো, তবে কোন পন্থায়, কীভাবে এবং কখন এই যুদ্ধের একটি শান্তিপূর্ণ সুরাহা অর্জন সম্ভব হবে, বিষয়টি অস্পষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আগ্রহের প্রতি সম্মান জানিয়ে রিয়াদে প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
মার্কিন এবং রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয়ের মধ্যে সফল আলোচনার মাধ্যমে শিগগির ট্রাম্প-পুতিন আলোচনার পথ খুলেছে। তবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের দেশগুলো এবং ইউক্রেন। রিয়াদে অনুষ্ঠিত আলোচনা প্রক্রিয়ায় ইউক্রেন এবং ইউরোপীয় পক্ষগুলো সম্পৃক্ত না করে একতরফা ভাবে ইউক্রেনের কাছ থেকে তাদের বিরল খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অংশীদারিত্বের দাবি করেছেন ট্রাম্প।
শুরুতে নাকচ করলেও কয়েকদিনে বরফ গলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পদত্যাগের দাবিটি যখন সরব এবং যৌক্তিক হয়ে উঠছিল, এমন অবস্থায় এসে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
ইউক্রেনের এই বিরল খনিজ পদার্থের মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণ লিথিয়াম, টাইটানিয়াম, কয়লা গ্যাস এবং তেল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভাষায় এই যুদ্ধে ইউরোপের দেশগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া অর্থ ঋণ হিসেবে নিলেও, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে অনুদান হিসেবে এই অর্থ দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের রাখঢাক না করে এর কোনো না কোনো প্রতিদান প্রত্যাশা করছেন ট্রাম্প, যা অর্থের অংকে ৫শ বিলিয়ন ডলার।
ইউক্রেন ইতিমধ্যে বুঝে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন বন্ধ হলে এই যুদ্ধে তাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়। তবে তাদের এবং গোটা ইউরোপকে ভাবিয়ে তুলেছে ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের একতরফা পরিকল্পনা এবং সাম্প্রতিক সময়ে পুতিনের সাথে তার এ নিয়ে সমঝোতা। একইসাথে কিছুদিন আগে মিউনিখের নিরাপত্তা সম্মেলনে ট্রাম্পের ডেপুটি জেডি ভ্যান্স জানিয়ে দিয়েছেন তারা ইউরোপে নতুন জোট করতে আগ্রহী এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হবে রক্ষণশীল দেশগুলো।
ট্রাম্প এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। যুদ্ধ বন্ধ প্রক্রিয়ায় তার প্রচেষ্টার সাথে রাশিয়া সম্মত হয়েছে, আবার ইউক্রেনের দিক থেকেও তা নিয়ে বিরুদ্ধাচরণ করার সুযোগ থাকছে না...
এতদিন ধরে তারা রক্ষণশীলদের দমন এবং বাকস্বাধীনতায় ব্যাপক হস্তক্ষেপ করেছে বলে ইউরোপকে অভিযুক্ত করেছেন। ট্রাম্পের পক্ষ থেকে এটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এই যুদ্ধ বন্ধ হলে ইউক্রেনের নিরাপত্তার দায় আর যুক্তরাষ্ট্রের থাকবে না, ইউরোপকেই এটা নিয়ে ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে সংকটে রয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো।
এরই মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ হোয়াইট হাউসে দেখা করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে। সাক্ষাৎ শেষে তিনি যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ায় মার্কিন সম্পৃক্ততা দাবি করেছেন। সেই সাথে ইউক্রেনকে যেন পরাজিত পক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করা না হয় সেটারও নিশ্চয়তা চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের বিনিময়ে যুদ্ধ অবসানের আহ্বান জানিয়েছেন।
যে প্রক্রিয়াতেই এই যুদ্ধ শেষ হোক না কেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান হচ্ছে না, এটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায় এবং ট্রাম্প-পুতিনের মধ্যে এরই মধ্যে এটা নিয়ে সমঝোতাও হয়ে গেছে। তবে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে তার দাবি মেনে নেওয়ার বিনিময়ে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়টি অঙ্গীকার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ইউক্রেনের সম্পদ ভাগাভাগি থেকে অর্জিত অর্থের একটা অংশ ইউরোপের মাধ্যমে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ট্রাম্পের বিকল্প সিদ্ধান্ত থাকতে পারে।
আরও পড়ুন
ট্রাম্প এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছেন। যুদ্ধ বন্ধ প্রক্রিয়ায় তার প্রচেষ্টার সাথে রাশিয়া সম্মত হয়েছে, আবার ইউক্রেনের দিক থেকেও তা নিয়ে বিরুদ্ধাচরণ করার সুযোগ থাকছে না; বরং এক্ষেত্রে তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রকে কতটুকু সন্তুষ্ট করতে পারবে, সেটা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। ইউক্রেন যেমন নিজেদের সম্পদ ভাগাভাগির বিষয়ে মার্কিন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, রাশিয়াও ইউক্রেনের অধিকৃত অঞ্চলগুলোয় খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার নাকচ করে দেয়নি।
এক্ষেত্রে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, ট্রাম্পের আমলে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি একটি পরিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাবে। ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো তার ইউরোপীয় মিত্রদের পরিত্যাগ করে রাশিয়ার সাথে কৌশলগত বোঝাপড়ায় যেতে চাইছেন। এক্ষেত্রে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
আবার মধ্যপ্রাচ্যে তার পূর্বসূরি বাইডেনের উদ্যোগে ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উগ্রপন্থাকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, যার জেরে যেকোনো সময় এই চুক্তিও ভেস্তে যেতে পারে। ইরানকে নিয়েও নতুন পরিকল্পনার ছক কষছেন তিনি। মূলত হামাস নিধনের নামে তিনি ইরানের ওপর এই মেয়াদে অনেক বেশি কঠোর হবেন বলে ধারণা করা যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে তিনি কতটা সফল হবেন এটা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়, কারণ রাশিয়ার মিত্র ইরানের ব্যাপারে অতি কঠোর অবস্থান, রাশিয়া নিশ্চয়ই ভালো চোখে দেখবে না। এমনটা হলে ব্যাপক হোঁচট খাবেন ট্রাম্প। সাথে চির বৈরী চীন তো রয়েছেই। যদিও চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে তিনি এবার কিছুটা নমনীয় রয়েছেন এখন পর্যন্ত।
তবে দিনশেষে মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়া বা চীন কোনোপক্ষই যুক্তরাষ্ট্রকে একতরফা সুযোগ দেবে না—এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এক্ষেত্রে পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতিকে তিনি কতটা টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেটা সময়ই বলে দেবে।
সবকিছু মিলিয়ে ট্রাম্পের শুরুটা কিন্তু মন্দ নয়। সারা বিশ্বেই তিনি একটা বড়সড় ধাক্কা দিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক যে, তিনি বেশ বড়সড় ঝুঁকিও নিচ্ছেন।
দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠক করেছেন। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে তার নীতিতে অনেকটাই সফল হয়েছেন। ভারতের শতাধিক অবৈধ অভিবাসীকে হাতে শেকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর মধ্য দিয়ে তিনি এটাই জানান দিয়েছেন যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের চেয়ে মার্কিন জাতীয় স্বার্থকে অনেক বড় করে দেখেন।
বাণিজ্য বৈষম্য দূরীকরণে তাই ট্রাম্পের উচ্চ শুল্কারোপের হুমকি ভারত গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। আগামী বছরগুলোয় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে দুই পক্ষই সম্মত হয়েছে। ট্রাম্পের চিন্তায় বাংলাদেশও রয়েছে, যা ভারতের সাথে আলোচনা এবং তার বিভিন্ন বক্তব্যে উঠে এসেছে, তবে বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
সবকিছু মিলিয়ে ট্রাম্পের শুরুটা কিন্তু মন্দ নয়। সারা বিশ্বেই তিনি একটা বড়সড় ধাক্কা দিয়েছেন। তবে এটাও ঠিক যে, তিনি বেশ বড়সড় ঝুঁকিও নিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের শক্তির ভারসাম্যের পরিবর্তন হতে পারে এবং দিনশেষে সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটুকু সহায়ক হবে এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনতিকে তিনি কীভাবে পুষিয়ে উঠবেন এটা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যায়।
এই মুহূর্তে তার প্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ। এর সহজ সমাধান হতে হলে কয়েকটি ধাপ খুব গুরুত্বপূর্ণ, যেমন রাশিয়া কি ইউক্রেনের অধিকৃত এলাকাগুলো ছেড়ে দেবে, নাকি এগুলো রাশিয়ার অংশ হয়ে থাকবে, ইউক্রেনের নিরাপত্তার বিষয়টি কেমন দাঁড়াবে এবং ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলার ধরনগুলো কেমন হবে ইত্যাদি।
সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে ট্রাম্প কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগগুলো আগামী ৪ বছর পর তার উত্তরসূরি যিনি আসবেন, তিনি চালিয়ে যাবেন কি না। আসলে ট্রাম্পের চিন্তাভাবনাগুলো একটি বেশিই ব্যতিক্রম।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়