গণমানুষের নেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান

বাংলাদেশে দিনদিন ‘রাজনীতিবিদ’-এর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই যেমন ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ চলে গেলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী আব্দুল্লাহ আল নোমান। একইদিনে তার রাজনীতির শহর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সমাবেশে প্রধান বক্তা হিসেবে থাকার কথা ছিল।
বিজ্ঞাপন
আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন এমন একজন নেতা যার কথা, আচরণ ও কাজ দেখলে যে কারও মনে হতো তিনি একজন প্রকৃত রাজনৈতিক নেতা। এখন তো সংখ্যার বিচারে নেতা অনেক। কিন্তু তাদের মধ্যে ‘রাজনীতিবিদ’ কতজন? একজন রাজনীতিবিদের যে বিশেষ অবয়ব আমাদের কল্পনায় ভাসে, মানে জনহিতৈষী, পরোপকারী, দেশপ্রেমিক, চলনে-বলনে সাধারণ কিন্তু ব্যক্তিত্বে ও কাজে অসাধারণ, তার সবই ছিল আব্দুল্লাহ আল নোমানের মধ্যে।
তাকে চিনি এবং জানি বহু বছর ধরে। তাকে না চেনার কোনো সুযোগই ছিল না। ওই যে বললাম, তাকে দেখলেই রাজনীতিবিদ মনে হতো! অ্যা ট্রু পলিটিশিয়ান। তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মনোনয়নে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনবার। বিভিন্ন সময়ে তিনি চারটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার যোগ্যতা ও সততা নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি।
বিজ্ঞাপন
২০১৬ সালে তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। সে বছর ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হয় বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল। কাউন্সিলে প্রকাশনা বিষয়ক উপ-কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। আমি ছিলাম সেই কমিটির একজন সদস্য। প্রকাশনার কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তিনি কতটা দরদ দিয়ে নিখুঁত কাজ করার চেষ্টা করেন।
তাকে আমি দুইটা আইডিয়া দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বিএনপির অর্জন অনেক। কিন্তু সেই অর্জনের প্রচার কম। দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই জানেন না সেইসব অর্জনের কথা। যেমন ধরুন একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার যে জিয়াউর রহমানের সময়ে প্রবর্তিত হয়েছে এবং নিরপেক্ষ যাচাইবাছাইয়ের মাধ্যমে সত্যিকারের গুণীজনদেরই সে পুরস্কার দেওয়া হয়েছে সেটা বিএনপিরই ক’জনে জানেন?
বিজ্ঞাপন
আবদুল্লাহ আল নোমানের রাজনৈতিক দর্শন ছিল সাধারণের জন্য রাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি দিয়ে শুরু করে শ্রমিক নেতা হওয়ার পরও তিনি পরিণত হন গণমানুষের নেতায়।
যদি ছোট পরিসরে একটা বই বের করা যায় যেখানে মেদমুক্তভাবে সংক্ষেপে অর্জনগুলো তুলে ধরা যায়, তাহলে নেতাকর্মীরা তাতে একটু আধটু চোখ বুলাতে পারে। তিনি কিছুক্ষণ আমার কথা শুনে বললেন, খুবই ভালো আইডিয়া। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে এ বই লিখবে কে? তুমি যদি লেখার দায়িত্ব নাও তাহলে অবশ্যই আমরা কাউন্সিল উপলক্ষে এটা প্রকাশ করে কাউন্সিলরদের হাতে পৌঁছে দেবো। তিনি এমনভাবে বললেন যে, আমি আর না করতে পারলাম না। আমার লেখা ‘উন্নয়নে অর্জনে বিএনপি’ শিরোনামে বইটা প্রকাশ করলেন তিনি।
তাকে আরেকটি আইডিয়া দিয়েছিলাম। সেটাও গ্রহণ করেছিলেন সানন্দে এবং তার সম্পাদনার দায়িত্বও দিয়েছিলেন আমাকেই। বাংলাদেশে পলিটিক্যাল কার্টুনিস্ট হিসেবে আসিফুল হুদা অনন্য। হুদার কার্টুন মানেই রাজনীতির অনেক বার্তা। তাই বললাম, তার কার্টুনগুলো যদি বিষয়ভিত্তিকভাবে ভাগ করে একেকটা অধ্যায় করা যায়, যার শুরুতে সামান্য ভূমিকা থাকবে এবং তার পরে প্রাসঙ্গিক কার্টুনগুলো থাকবে। গুম-খুন, দাদাগিরি, অত্যাচার, দুর্নীতি, নির্বাচন, শেখ হাসিনা—এমন বেশ কয়েকটি অধ্যায় মিলে বহু বিষয়ক কার্টুন ছিল বইটিতে।
আসিফুল হুদাকে অনুরোধ করে কিছু নতুন কার্টুন আঁকিয়ে অনেক সময়, শ্রম দিয়ে তৈরি করার পরেও শেষ পর্যন্ত কার্টুনের বইটি প্রকাশ করতে না পারার আক্ষেপ তিনি প্রকাশ করেছিলেন বেশ কয়েকবার। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে একজন সিনিয়র নেতা আশঙ্কা করেছিলেন যে, এই কার্টুনের বইটি প্রকাশ করলে শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হতে পারেন এবং এর কারণে সরকার কাউন্সিলে বাধা দিতে পারে। সে কারণে নাকি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল কার্টুনের বইটির প্রকাশনা।
আরও পড়ুন
আবদুল্লাহ আল নোমানের রাজনৈতিক দর্শন ছিল সাধারণের জন্য রাজনীতি। ছাত্ররাজনীতি দিয়ে শুরু করে শ্রমিক নেতা হওয়ার পরও তিনি পরিণত হন গণমানুষের নেতায়। তিনি তার বড়ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নে। পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা ছিলেন। পরে মাওলানা ভাসানীর অনুসারী হয়ে ন্যাপে যোগ দেন। ভাসানী ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকও হয়েছিলেন তিনি। পরে ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দেশ গড়ার ডাকে সাড়া দিলে তিনি যুক্ত হন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলে। শ্রমিক দলের সহসভাপতি ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার কান্ডারি হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিএনপিকে সংঘটিত করার কাজটি তিনিই করেছেন। তার হাত ধরেই বিএনপিতে তৈরি হয়েছে অনেক নেতা। যাদের অনেকেই এখন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা। চট্টগ্রাম বিএনপির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর। দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিবও ছিলেন একসময়।
বাম ধারার রাজনীতি যারা করেন তাদের সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা এই রকম ছিল যে, তারা সৎ রাজনীতি করেন, অর্থলোলুপ হন না, হৃদয় দিয়ে মানুষের কষ্ট অনুভব করেন। যদিও কালে কালে কিছু বাম রাজনীতিক তাদের ক্ষমতা ও অর্থলোভী ভূমিকার জন্য মানুষের পুরোনো ধারণাকে বদলে দিয়েছেন। কিন্তু বাম রাজনীতি থেকে বুর্জোয়া রাজনীতিতে নাম লেখালেও তিনি নিজেকে রাজনৈতিক পঙ্কিলতার চলতি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেননি।
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে। সেই প্রতিযোগিতা কখনো সুস্থ, কখনো অসুস্থ। কিন্তু আব্দুল্লাহ আল নোমান কখনো কারও সঙ্গে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেননি। রাজনীতিতে তার প্রাপ্তি অনেক হলেও শেষ জীবনে এসে সে গতিটা একটু ধীর হয়ে গিয়েছিল। দলে তার যে জায়গা পাওয়ার কথা ছিল তা তিনি পাননি।
দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার, বরেণ্য রাজনীতিবিদ ও দলের দুঃসময়ের কান্ডারিদের একজন হওয়ার পরেও বিএনপিতে তিনি কেন অবহেলিত হয়ে পড়লেন সে এক বড় প্রশ্ন। কেউ কেউ আকার ইঙ্গিতে ২০০৬ সালের এক-এগারোর প্রেক্ষাপটে তার কিছু অস্পষ্ট ভূমিকাকে দলে সুদৃঢ় অবস্থান হারানোর জন্য চিহ্নিত করেন। কিন্তু সে হিসাবটাও ঠিক মেলে না।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিএনপিকে টিকিয়ে রাখার কান্ডারি হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ আল নোমান। চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিএনপিকে সংঘটিত করার কাজটি তিনিই করেছেন।
কারণ সে সময় যারা প্রকাশ্যে দল ভাঙার নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ দলে খুব ভালোভাবেই পুনর্বাসিত হয়েছেন এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য পর্যন্ত হয়েছেন। অথচ কী এক ঠুনকো গুপ্ত কারণে আব্দুল্লাহ আল নোমানের মতো যোগ্য নেতাকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
আসলে পদ-পদবীর লোভ এবং তার জন্য কারও কাছে ধরনা না দেওয়ার মানসিকতা লালন করতেন বলেই হয়তো দলে তার যোগ্য জায়গাটা অর্জিত হয়নি। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ ছিল বলেও কখনো শুনিনি। কারণ তার সফলতা পদের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। তার গোটা রাজনৈতিক জীবনের অর্জন তাকে বেশিরভাগ সহকর্মী ও দেশবাসীর কাছে এমন এক জায়গা এনে দিয়েছে যে এখানে পদ-পদবীর বিষয়টা ছিল গৌণ।
একজন মানুষের সফলতা এটা নয় যে, তিনি কত বড় পদ-পদবীর অধিকারী ছিলেন। বরং তিনি মৃত্যুর পরে মানুষের মনে শ্রদ্ধার সঙ্গে বেঁচে থাকার মতো কী রেখে গেলেন তাই আসল। সে বিবেচনায় জননেতা আব্দুল্লাহ আল নোমান অবশ্যই একজন সফল মানুষ। ৮৩ বছরের জীবনে তার যে অর্জন, যে যোগফল তা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়।
বর্তমানে যারা রাজনীতি করেন ও করতে চান, বিশেষ করে আব্দুল্লাহ আল নোমানের পরের প্রজন্ম, তাদের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে এই নেতার কর্মময় জীবন। বয়স ও শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে দলে কিছুটা উপেক্ষিত থাকার পরেও দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র অনীহা দেখাননি তিনি। যেদিন সকালে তিনি ইহজগতের সমাপ্তি মেনে নিয়ে চিরবিদায় নেন, সেদিনও তার বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল নিজ এলাকা চট্টগ্রামে, নিজ দলের জনসভায়। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি দলের জন্য কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। এইরকম নিবেদিতপ্রাণ নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ ।। কবি, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
sayantha15@gmail.com