নাগরিক সাংবাদিকতা এবং ঢাকা পোস্ট

নাগরিক সাংবাদিকতা বিশ্বব্যাপী আলোচিত একটা টার্ম বলা চলে। বিশ্বের অনেক জনপ্রিয় গণমাধ্যম নাগরিক সাংবাদিকতার বিষয়ে আলাদা টিম গঠন করেছে। বাংলাদেশে এটি বহুল আলোচিত না হলে দুই-একটি গণমাধ্যম তা নিয়ে কাজ করছে। ঢাকা পোস্ট প্রথম সারির অনলাইন পত্রিকা। তারাও এই বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে ভাবতে পারে। আমি এই বিষয়ে বিশদে লিখছি।
স্মার্টফোন এখন সবার হাতে হাতে। সেই স্মার্টফোনে থাকছে ইন্টারনেট। স্মার্টফোন থেকেই যেকোনো ছবি বা ভিডিও করে সরাসরি ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন সহজেই পোস্ট করা যায়। আপলোড করে দেওয়া যায় টেক্সট। আর দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টার এ সুবিধার কারণে কখনো কখনো ব্যক্তিই হয়ে উঠছেন একজন স্বাধীন ব্রডকাস্টার।
নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো ঘটনা যদি না আসে বা তারা কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে পারেনি। কারণ ফেসবুকে রাখঢাকহীন আলোচনার সাথে তথ্য, প্রমাণ হাজির হওয়ার পর অনেক ঘটনাই গণমাধ্যমে উঠে এসেছে গুরুত্বের সাথে। আর তাতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে অনেককেই।
বিগত কয়েক বছরে আমাদের দেশে বেশকিছু আলোচিত ঘটনা ঘটেছে যা আমরা সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যম থেকে সবার আগে জানতে পেরেছি। এসব ঘটনা পরবর্তীতে মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য সংবাদের উপকরণ হওয়ার পাশাপাশি দিনের প্রধান শিরোনামে স্থান পেয়েছে।
সময় এখন ইউজার জেনারেটেড কন্টেন্টের
ছবি, ভিডিও, টেক্সট বা অডিও কন্টেন্ট যখন একজন ব্যবহারকারী নিজে ধারণ করেন, তা আবার অনলাইনে প্রচার করেন, তখন ওই কন্টেন্টকে ইউজার জেনারেটেড কন্টেন্ট বলা হয়। আর কন্টেন্ট সংগ্রহ, তৈরি এবং প্রচারের কাজটি সাধারণ ব্যবহারকারী বা নাগরিকরা করে থাকেন বলে তাকে নাগরিক সাংবাদিক এবং এই কার্যপ্রবাহকে নাগরিক সাংবাদিকতা বলা হয়। মূলধারার গণমাধ্যমে তা সংবাদ হওয়ার জন্য অবশ্যই সেই উপজীব্যতা থাকা চাই। অনলাইনে কোনো কিছু লিখে দেওয়ার নামই নাগরিক সাংবাদিকতা নয়।
নাগরিক সাংবাদিকতার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জ্যা রোসেন বলেছেন, যখন দর্শক বা পাঠক হিসেবে পরিচিত সাধারণ মানুষ তাদের কাছে থাকা গণমাধ্যমে ব্যবহার্য সরঞ্জাম দিয়ে একে অন্যকে তথ্য জানানোর কাজ করে থাকে তাকেই নাগরিক সাংবাদিকতা বলা হয়।
নিউইয়র্কভিত্তিক তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক অনলাইন সাময়িকীতে (পিসিম্যাগ) নাগরিক সাংবাদিকতাকে বৃহত্তর পরিসরে খবর বা প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা বলা হয়। একে সহযোগী নাগরিক সাংবাদিকতা বা তৃণমূল পর্যায়ের মিডিয়াও বলা যেতে পারে। গণমাধ্যমে নাগরিক সাংবাদিকদের কন্টেন্ট প্রচারের উপযোগী হলে তখন সোর্সের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তা যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রচারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্যথায় মিথ্যা সংবাদ (ফেক নিউজ) প্রচার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
নাগরিক সাংবাদিকতা বাংলাদেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সংবাদ তৈরির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আমাদের দেশে তুঙ্গে থাকার কারণেই ছোট-বড় ঘটনাগুলো আলোচনায় চলে আসছে। পাঁচ-ছয় বছরে নাগরিক সাংবাদিকদের দেওয়া অনেক সংবাদ মূলধারার গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে। যেমন—
২২ অক্টোবর ২০১৯ সাভারের ডগরমোড়া এলাকায় নক্ষত্রবাড়ি নামের ভবনের ছাদবাগানের গাছ কেটে ফেলেন খালেদা আক্তার লাকি। গাছ কাটার ভিডিও মোবাইলে ধারণ করেন ওই দিনই ৫টা ৫৮ মিনিটে সুমাইয়া হাবিব নামের অপর এক নারী তার ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন।
দশ লাখেরও বেশি ভিউ হওয়া ভিডিওটি ভাইরাল হলে অনলাইনে প্রতিবাদ শুরু হয়। পুলিশ খালেদা আক্তারকে আটকও করে। বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেনি মূলধারার গণমাধ্যমও। পরবর্তীতে সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়, প্রতিহিংসার বশে গাছগুলো কাটে লাকি, আর বিচার পাওয়ার আশায় ফেসবুকে ভিডিও পোস্ট করেন সুমাইয়া হাবিব।
আধুনিক সাংবাদিকতায় নাগরিক সাংবাদিকতাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। শুধু কন্টেন্ট উপভোগ নয়, বরং পাঠকরাই এখন সংবাদ তৈরিতে নিজেদের অংশগ্রহণ দেখতে চায়।
মূল ধারার গণমাধ্যমকে নাগরিক সাংবাদিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেখানে প্রবাসীরাও তাদের প্রবাস জীবনের নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত লিখতে পারবেন। পাঠকরা আশপাশে ঘটে যাওয়া যেকোনো ঘটনা বা যেকোনো বিষয়ে নাগরিক সাংবাদিকতায় অংশ নিতে পারবেন।
নাগরিক সাংবাদিকতাকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকা পোস্ট-এর মতো অনলাইন গণমাধ্যমগুলো আলাদা টুলস ব্যবহার করে বা টিম গঠন করেও তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। নাগরিক সাংবাদিকতার জন্য আলাদা মোবাইল অ্যাপস চালু করতে পারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাঠ পর্যায়ের নাগরিক সাংবাদিকরা এই অ্যাপস ব্যবহার করে দ্রুত খবর পাঠাতে পারবেন। আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলো এই ধরনের প্রকল্প চালু করতে পারে। পাশাপাশি সংবাদ পোর্টালগুলোয় নাগরিক সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রকাশ করে রাখতে পারে। ঢাকা পোস্ট শুরু থেকেই মাল্টিমিডিয়াকে গুরুত্ব দিয়েছে। দেশের অনেক বড় ঘটনা ভিডিওর মাধ্যমে তুলে ধরেছে। নাগরিক সাংবাদিকরা তাদের তোলা ছবি ও ভিডিও পাঠানোর মাধ্যমে ঢাকা পোস্ট-এর নিউজ পোর্টালকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘সামাজিক আন্দোলন’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আধুনিক বিশ্বে সামাজিক আন্দোলনসহ প্রায় সব অঙ্গনেই প্রভাব বিস্তার করছে। ইন্টারনেট তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে সুসংগঠিত হয়ে যেকোনো সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে লক্ষ্যে যে পৌঁছানো যায় তা আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটে যাওয়া আন্দোলন থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি।
আধুনিক সাংবাদিকতায় নাগরিক সাংবাদিকতাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। শুধু কন্টেন্ট উপভোগ নয়, বরং পাঠকরাই এখন সংবাদ তৈরিতে নিজেদের অংশগ্রহণ দেখতে চায়।
তুরস্কেও ইস্তাম্বুলের গেজি পার্ক, মিশরের কায়রোর তাহরির স্কোয়ার কিংবা নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিল মানুষ। তরুণ প্রজন্মের কাছে মতামত প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম এবং সামাজিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তথাকথিত আন্দোলন কাঠামোর পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নতুন সমন্বয়কারী কৌশলগত প্রযুক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
২০২৪-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া অন্যতম আন্দোলনগুলোর একটি হচ্ছে কোটা সংস্কার আন্দোলন। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন হলো বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরিতে প্রচলিত কোটাভিত্তিক নিয়োগ ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত আন্দোলন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়।
২০২৪ সালের আগে ২০১৮ সালেও সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। তবে এবার তা সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দেয়। এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দারুণ প্রভাব বিস্তার করে এবং এখানেও আমরা মূলধারার গণমাধ্যমকে দেখেছি নাগরিক সাংবাদিকদের ওপর নির্ভর করতে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও কিছু আলোচিত ঘটনা
সিলেটের শিশু রাজন হত্যা, ফেনীর সোনাগাজী মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাতের ঘটনা অথবা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই। ২০১৮ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে আমরা একটি শক্তিশালী ছাত্র আন্দোলন দেখেছি, যারা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছে। বাংলাদেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে এর আগে কখনো এত বড় আন্দোলন হয়নি। এটি সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে উদ্ভূত আন্দোলনগুলোর অন্যতম।
আরও পড়ুন
খুলনায় রাকিব হত্যা, কুমিল্লায় তনু ধর্ষণ ও হত্যা, মিয়ানমারে বিজিবি সদস্যের হাতকড়া পরা ছবি প্রকাশ, মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস, ক্রিকেটার শাহাদাৎ ও তার স্ত্রী কর্তৃক গৃহকর্মীকে নির্যাতনের ছবি, গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলাকারীদের পরিচিতি প্রকাশ এবং বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যার মতো অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সামনে চলে আসে। আবার দেশের বাইরে সিরীয় শিশু আয়নাল কুর্দির মৃত্যু, ভারতের মেডিকেল শিক্ষার্থী নির্ভয়াকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাগুলোর মতো অনেক ইস্যু আমাদের দেশেও ব্যাপক আলোচিত হয়। নাগরিকরা ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন।
নাগরিক সাংবাদিকতায় নৈতিকতা ও আস্থার সংকট
সাংবাদিকতার নীতিমালা না মানার কারণে তথ্য বিভ্রান্তিতে পড়ছেন গণমাধ্যমের গ্রাহক। এতে করে ওই গণমাধ্যম আস্থার সংকটে পড়ছে। বাংলাদেশে সংবাদপত্র মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে একমাত্র প্রেস কাউন্সিল প্রবর্তিত কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থায় কর্মরত সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আচরণবিধি প্রচলন করে।
এসব নীতিমালা সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের পেশাগত কাজে আরও দায়িত্বশীল আচরণ পালনে সাহায্য করছে। এই ‘প্রেস কাউন্সিল অ্যাক্ট’-এর ১১ (বি) ধারায় প্রণীত। এটি ২০০২ সালে সংশোধন করা হয়। কিন্তু অনেক সময়ে সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থাসমূহ এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় এসব আচরণবিধি বা নৈতিকতা মানা হচ্ছে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত খবর প্রচারেও আজকাল রীতিমতো প্রতিযোগিতায় নেমেছে প্রথম সারির গণমাধ্যম আর সেখানেও মানা হচ্ছে না নৈতিকতা।
মূলধারার গণমাধ্যমের দায়িত্বহীন কিংবা পক্ষপাত আচরণই সনাতন গণমাধ্যমের ওপর মানুষ আস্থা হারাচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য খবরের সন্ধানের এখন অন্যতম উৎস হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। সাধারণ পাঠক-দর্শক প্রতিদিনের খবর কিংবা বিনোদনের জন্য ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যম অনুসরণ করছে। যার ফলে কোনো না কোনোভাবে আয়ের দিক দিয়েও লোকসানে পড়তে হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমকে।
টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকা এবং অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর আয়ের মূল উৎস বিজ্ঞাপন। আর সেই বিজ্ঞাপন কমছে দ্রুতগতিতে। অন্যদিকে উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে নাগরিকদের প্রচার করা ছবি ও ভিডিও জায়গা করে নিচ্ছে পত্রিকার পাতায় কিংবা টেলিভিশনের পর্দায়। এতে করে পেশাগত সাংবাদিকতার প্রতি মানুষের আগ্রহ দিন দিন কমতে শুরু করেছে। এসব কিছুই নাগরিক সাংবাদিকতা মূলধারার গণমাধ্যমকে জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ আর প্রশিক্ষণের অভাব থাকায় অনেকের কাছে নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলো আধুনিক সাংবাদিকতা পেশায় দক্ষ লোকবল ও সংবাদকর্মীদের গুণগত মান বাড়ানোর লক্ষ্যে এ বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে পারে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নানামুখী সমস্যা রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতিদিন অজস্র খবর আসতে থাকে। একই বিষয়ে নানানভাবে তথ্যের উপস্থাপন, বিকৃতি অথবা গুজবও ছাড়ানো হয়। যেহেতু এই মাধ্যমটি একেবারে উন্মুক্ত তাই তথ্য প্রকাশে এখানে কোনো বাধা-নিষেধ নেই। ইন্টারনেটভিত্তিক ওয়েব সাইটগুলোর এটাই বৈশিষ্ট্য। যে কেউ চাইলেই যেকোনো ধরনের খবর প্রচার করতে পারে। এ কারণে যেকোনো গুজবের খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে। তাই নাগরিক সাংবাদিকতাতেও নৈতিকতার লঙ্ঘন বা আস্থার সংকট রয়েছে।
গুজব নাগরিক সাংবাদিকতাকে যেভাবে ঝুঁকির মুখে ফেলছে
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো কীভাবে ইউজার জেনারেটেড কনটেন্টকে কাজে লাগাতে পারে এই বিষয় নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দক্ষিণ আফ্রিকার সাংবাদিক ও হ্যাশট্যাগ আওয়ার স্টোরিজ-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা ইউসুফ ওমরের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন একটি বড় সমস্যা হলো ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। কোথাও আগুন লাগলে মানুষ ছবি বা ভিডিও প্রকাশ করতে শুরু করে। কিন্তু পরে দেখা যায়, সেগুলো বছর তিন-চারেকের পুরোনো ফুটেজ। মানুষ মৃত্যু নিয়েও গুজব ছড়ায়। আমি বিশ্বাস করি, এ সমস্যা সমাধানের উপায় গণমাধ্যম শিক্ষার ব্যবস্থা করা। দর্শক-শ্রোতাদের ভুয়া তথ্য চেনার উপায় বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা নিজেরা ভুয়া তথ্য না ছড়ান।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
নাগরিক সাংবাদিকরা মূলত স্মার্টফোনসহ বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। সম্ভাব্য সাইবার আক্রমণ থেকে ইন্টারনেটে রক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের কলাকৌশল জানা সবার জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো পোস্ট আপলোড, কমেন্ট, লাইক, বন্ধু বাছাই ও শেয়ার করার ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা। সামাজিক যোগাযোগেরমাধ্যমে সরকার বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো পোস্ট আপলোড, কমেন্ট, লাইক, শেয়ার করা থেকে বিরত থাকা।
নতুন ধারার মিডিয়ার জন্য দরকার প্রশিক্ষিত লোকবল
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর আরও বেশি ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট—ইউজিসি কন্টেন্ট ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন ইউজার জেনারেটেড কন্টেন্টের ভাণ্ডার তৈরি হয়েছে। নিউজ রুমগুলোয় যদি এই বিশাল পরিমাণ কন্টেন্ট থেকে সুনির্বাচিত কন্টেন্টগুলো প্রকাশ করতে পারে, তাহলে একদম নতুন একটি ধারার সূচনা হবে।
আমার মনে হয়, এখানে এখনো অনেক সংবাদমাধ্যম ওই মানে পৌঁছাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই প্ল্যাটফর্মের উপযোগী করে মিডিয়া কন্টেন্ট তৈরিতে পারদর্শী হওয়ার জন্য দরকার প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ আর প্রশিক্ষণ। কিন্তু বাস্তব চিত্র হচ্ছে, আমাদের দেশে এই দুটোরই বড় অভাব। আর এ কারণে দেশের মূলধারার গণমাধ্যম এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে পুরোপুরি সুফল ভোগ করতে পারছে না।
প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ আর প্রশিক্ষণের অভাব থাকায় অনেকের কাছে নতুন ধারার এই সাংবাদিকতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলো আধুনিক সাংবাদিকতা পেশায় দক্ষ লোকবল ও সংবাদকর্মীদের গুণগত মান বাড়ানোর লক্ষ্যে এ বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতে পারে।
তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কথা ভেবে ঢাকা পোস্ট-এর মতো আধুনিক অনলাইন গণমাধ্যম এ বিষয়ে আলাদা উদ্যোগ গ্রহণ করতে। নিয়মিত বিষয়ভিত্তিক সেমিনার ও সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়নে কর্মশালার আয়োজন করতে পারে।
বাংলাদেশে সাংবাদিকরা এখন ডিজিটাল সাংবাদিকতার কথা বলছেন। মোবাইল ফোন আর কম্পিউটার প্রযুক্তিনির্ভর এই অনলাইন সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে বিপুল জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ তৈরি কিংবা দিনের আলোচিত ঘটনার খোঁজ পেতে সাংবাদিকরা এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভর করছেন। সাম্প্রতিককালে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনার দিকে তাকালে আমরা এর প্রমাণ পাই।
করোনা মহামারির সময় লকডাউন চলাকালে ঘরে বসেই ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে সাংবাদিকতা চর্চা করার নতুন কৌশল বিশ্ববাসী দেখেছে। বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মূলধারার ও অনলাইন গণমাধ্যমে সাংবাদিকদের এই কৌশলে খবর প্রচার করতে দেখেছি।
করোনা সংকটে অসহায় মানুষদের কাছে সিএনজি নিয়ে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া নাফিসা আনজুম খানের উদ্যোগ যখন ফেসবুকে ভাইরাল হলে ওই কর্মসূচির সঙ্গে সামিল হন বাংলাদেশ জাতীয় ওয়ানডে দলের সাবেক অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ফেসবুক থেকে উঠে আসা এই খবর জায়গা করে নেয় প্রথাগত সংবাদমাধ্যমে; প্রচারিত হয় একাধিক প্রতিবেদন। এভাবেই নাগরিক সাংবাদিকতা বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ তৈরিতে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে।
ড. জামিল খান ।। সহযোগী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা, মিডিয়া ও যোগাযোগ বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি