জলে ও জ্বলে ভালোবাসার গান

‘কারে বলে ভালোবাসা, কারে বলে প্রেম
বিজ্ঞাপন
মিলনে বিরহে আমি জানলেম...’
এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘মান সম্মান’ সিনেমার গান। শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে গাওয়া গানটির লিপে ছিলেন নায়ক আলমগীর। সাদা কালো যুগের ছবি। গানটা সেই সময়ে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। সময়ের চালচিত্রে গানটি এখনো পাঠকদের মনে সুখ ও জ্বালা বাড়ায়।
বিজ্ঞাপন
প্রেম কী কেবলই একটা শব্দ? নাকি মানব সংসারের যন্ত্রণার বাঁশি, কেবলই বেজে যায় অথৈ আগুনের জ্বলে? প্রেম আর ভালোবাসা শব্দ দুটোর মধ্যে কতটুকু পার্থক্য? বাংলা ভাষায় একটি শব্দের বিপরীতে অনেক শব্দ। ফলে অনেক সময়ে খুঁজে তল পাওয়া মুশকিল শব্দের গতি প্রকৃতি ও অর্থ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বময় প্রেমের সন্ধান করেছেন আকুল হৃদয়ে। জীবনের চারপাশে তিনি রোপণ করেছেন প্রেম বৃক্ষ। গানে, কবিতায়, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে—কোথায় তিনি ভালোবাসার সেতার বাজাননি আপন আনন্দযজ্ঞের বলয়ে? বিচিত্র রূপ ও রূপান্তরে তিনি ছিলেন প্রেমের পূজারি।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেছেন—প্রেমের দ্বারা চেতনা যে পূর্ণশক্তি লাভ করে সেই পূর্ণতার দ্বারাই সে সীমার মধ্যে অসীমকে, রূপের মধ্যে অপরূপকে দেখতে পায়, তাকে নতুন কোথাও যেতে হয় না।
আবার রবীন্দ্রনাথ গানে লিখেছেন—আমি রূপে তোমায় ভোলাবো না, ভালোবাসায় ভোলাবো...।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বময় প্রেমের সন্ধান করেছেন আকুল হৃদয়ে। জীবনের চারপাশে তিনি রোপণ করেছেন প্রেম বৃক্ষ। গানে, কবিতায়, নাটকে, গল্পে, উপন্যাসে—কোথায় তিনি ভালোবাসার সেতার বাজাননি আপন আনন্দযজ্ঞের বলয়ে? বিচিত্র রূপ ও রূপান্তরে তিনি ছিলেন প্রেমের পূজারি।
কীভাবে পরিস্থিতি ও বোধের কারণে প্রেম ও ভালোবাসা মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যায়, তা বাণী ও সুরে আঁকেন তিনি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমের অমর ও অদ্বিতীয় পুরুষ। প্রেম ও ভালোবাসার এক দুরন্ত পথিক তিনি। গানে কবিতায় গল্পে উপন্যাসে কাজী নজরুল ইসলাম ভালোবাসার তরী ভাসিয়েছেন জলে, ডাঙ্গায় এবং অন্তরীক্ষে।
প্রেমের মূল সম্পদ বিরহ। বিরহের মধ্যে প্রেম কেঁপে ওঠে রহি রহি...। বিরহের মূল তন্ত্র ধারণ করে কবি কাজী নজরুল নিজেকে ছড়িয়েছে প্রেমের সংসারে, ভালোবাসার সমুদ্রে। তিনি গানের খাতায় লিখেছেন—তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ...। বিরহের যাতনায় তিনি ছিলেন আকণ্ঠ নিমজ্জিত। লিখেছেন গান—আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়, মোছ আঁখি দুয়ার খোলো দাও বিদায়...।
ভালোবাসার সংসারে পাল তোলা নৌকা বেয়ে নাইয়া হওয়ার সাধ জাগে সবারই। কিন্তু আশা ও ধারণার সঙ্গে মিলে প্রেম বা প্রেমাস্পদ সব সময়ে মেলে না। পড়ে থাকে নিজস্ব দীর্ঘশ্বাস হাতের তালুতে, বুকের গভীরে বেদনার তীক্ষ্ণ বালুচরের মতো। দুনিয়া জুড়ে এখন সবকিছু দিনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। প্রেম বা ভালোবাসার মতো জটিল অনুভবও ফ্যাশনের পাশা খেলায় ডুবে গেছে।
ভালোবাসা দিবস কী ফ্যাশন? ভালোবাসা তো অন্তরের গভীরে প্রবহমান নিঃশব্দ স্রোতের মতো বয়ে যায়। ফ্যাশনে পরিণত হলে নিঃশব্দের আলো কেমন করে সম্পর্কের জাল বোনে? কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক—ভালোবাসা বা প্রেম এখন ফ্যাশনের প্রজাপতি।
প্রতিবছর চৌদ্দ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ঘটা করে ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন দিবস পালন করা হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও একই দিনে ভালোবাসা দিবস পালন করা হয় নানা অনুষ্ঠান বা উৎসবের মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন বা ভালোবাসা দিবস পালন শুরু হয় ১৯৯৩ সালে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের প্রেরণায়।
তিনিই প্রথম বাংলাদেশে তরুণ-তরুণীদের সামনে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি পালনের প্রস্তাব রাখেন। প্রেম ও ভালোবাসায় জারিত দুরন্ত বাংলার তরুণ তরুণীরা আনন্দঘন চিত্তে ভালোবাসার দিন হিসেবে গ্রহণ করে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর দিবসকে।
ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন ইতালির রোম নগরের যাজক। ২৬৯ খ্রিস্টাব্দে তাকে গ্রেফতার করে ইতালির সম্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস। কেন পাদ্রি ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতার করা হলো? ধর্ম বিরুদ্ধ কোনো কাজ করার জন্য? না, পাদ্রি ভ্যালেন্টাইন গ্রেফতার হয়েছিলেন প্রেমের কারণে!
প্রেম! মানে না কোনো বাধা বারবার প্রমাণিত, সেই আদিকাল থেকে। একজন পাদ্রি সেকালে সব ধরনের বাধা নিষেধ উপেক্ষা করেও নারীর প্রেমে মগ্ন হয়েছিলেন, এখন যেমন হয়। হবে। কিন্তু ভ্যালেন্টাইনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল?
জানা যায়, ভ্যালেন্টাইন প্রেমিকসুলভ ছিলেন। যেখানে সেখানে প্রেমে পড়তেন। জেলে গিয়েও প্রেমে পড়েন। পরবর্তীতে সেই অন্ধ প্রেমিকাকে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন।
কারাগারের কারারক্ষীর অন্ধ মেয়ের চিকিৎসা করে ভালো করে দিয়েছিলেন কিন্তু প্রেম তাকে ছাড়েনি। প্রেম এমনই কাঁঠালের আঠা... লাগলে পরে ছাড়ে না, ছাড়েননি পাদ্রি ভ্যালেটাইনকেও। গ্রেফতার হওয়ার পর আইনের বিচারে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন ইতালির সম্রাট। মৃত্যুর তারিখ ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।
এখন প্রেমের জন্য, প্রেম করবার জন্য, প্রেমকে জীবনে গ্রহণ করার মহান অভিপ্রায় হলেও, কখনো কখনো প্রেম জীবন সংহারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন হলেন ভ্যালেন্টাইন। যদিও তিনি মারা গেছেন কিন্তু এখনো তিনি বেঁচে আছেন দুনিয়ার সব প্রেমিক-প্রেমিকার গভীর মনোজগতে, সফল মহিমায়। প্রশ্ন হলো সেই সময়, মৃত্যুর সময়ে ভ্যালেন্টাইন কী জানতেন, তিনি প্রেমের মহান পুরুষ হিসেবে সারাবিশ্বে পূজিত হবেন?
জানতেন না। আহা! প্রেমের জন্য দুনিয়া জুড়ে এমন মহিমা পৃথিবীর কম প্রেমিকের জীবনে ঘটেছে। যদিও আমরা জানি—লাইলি-মজনুর প্রেম। শ্রীকৃষ্ণ-রাধার প্রেম।
ভালোবাসা দিবস কী ফ্যাশন? ভালোবাসা তো অন্তরের গভীরে প্রবহমান নিঃশব্দ স্রোতের মতো বয়ে যায়। ফ্যাশনে পরিণত হলে নিঃশব্দের আলো কেমন করে সম্পর্কের জাল বোনে? কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক—ভালোবাসা বা প্রেম এখন ফ্যাশনের প্রজাপতি।
এইরকম প্রেমে ঘটনা অসংখ্য। ব্রিটিশ রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৯৩৬ সালে। কিন্তু এক বছরের মধ্যে অনেক সাধের সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন সাধারণ একজন নারী সিম্পসনকে ভালোবেসে। এবার বাস্তব থেকে ফিরি সাহিত্যে।
কথাসাহিত্যের নানা অনুষঙ্গে প্রেম ছড়িয়ে আছে। সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা সাহিত্যের প্রেম আখ্যান তৈরিতে অতুলনীয়। শবনম উপন্যাসে তিনি যে প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন তা বিস্ময়কর। উপন্যাসের নায়িকা শবনমের রূপের বর্ণনা করেছেন, যেকোনো প্রেমিকের জন্য চিরকালের উদাহরণ হয়ে থাকতে পারে। যেমন—
‘প্রথমে দেখেছিলুম কপালটি। যেন তৃতীয়ার ক্ষীণচন্দ্র। শুধু, চাঁদ হয় চাপা বর্ণের, এর কপালটি একদম পাগমান পাহাড়ের বরফের মতই ধবধবে সাদা। সেটি আপনি দেখেননি? অতএব বলব নির্জলা দুধের মত। সেও তো আপনি দেখেননি? তা হলে বলি বন-মল্লিকার পাপড়ির মত।
নাকটি যেন ছোট বাঁশী। ওইটুকুন বাঁশীতে কি করে দুটো ফুটো হয় জানি না। নাকের ডগা আবার অল্প অল্প কাঁপছে। গাল দুটি কাবুলেরই পাকা আপেলের মত।’
ভালোবাসা অবিনশ্বর এক নৃত্য তরঙ্গ-মনের অন্তপুরে বরফ শীতল জলেও জ্বলে ওঠে বিদগ্ধ আগুনের সর্বনাশে, কিংবা নতুন সৃষ্টির উল্লাসে। কোটি কোটি মানুষ দুনিয়া জুড়ে, প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ধারণ করে ভালোবাসা, গ্রহণ করে সংসারের স্বাদ। সংসারের স্বাদ ও সাধ্যের মধ্যে লড়াই ও তিতিক্ষার মধ্যে যখন জেগে থাকে দ্বাদশীর চাঁদ, ভালোবাসা তখনই পূর্ণতা অর্জন করে অসীম মমতায়।
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা সাহিত্যের অবিসংবাদিত প্রেমিক পুরুষ। কবিতা গল্প উপন্যাসে তিমিরের তীরে বুনে দিয়েছেন তিনি প্রেমের আগুন চুম্বন। কবিতার মধ্যে গেঁথে রেখেছেন ভালোবাসার বিষ, কিন্তু প্রেম ধারণ করলেই হয়ে ওঠে মধু। ক্রিয়ার সঙ্গে থেকে বিপরীতে কবিতার উপমা উৎপ্রেক্ষায় তুলেছেন ধুন...
‘তুমিই শুধু তুমি’ কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক নিবেদন করেছেন,
‘তোমার দেহে লতিয়ে ওঠা ঘন সবুজ শাড়ি।
কপালে ওই টকটকে লাল টিপ।
আমি কি আর তোমাকে ছেড়ে
কোথাও যেতে পারি?
তুমি আমার পতাকা, আমার কৃষির বদ্বীপ।’
আর কী কোথাও যাওয়ার সুযোগ রেখেছেন কবি সৈয়দ শামসুল হক, যেখানে তিনি প্রেমিকার মধ্যে আঁকেন বদ্বীপ!
নির্মলেন্দু গুণ বাংলা কবিতার রহস্যময় সার্থক কবি। কবিতার চরণে চরণে তিনি ফুটিয়ে তোলেন ফুল ও কাঁটার লহরী, প্রজাপতির ডানায় ডানায়। তিনি বিল্পবী, সঙ্গে সঙ্গে বিরহী প্রেমকও। বিচিত্র বোধ ও বোধনের সংশ্লেষে তিনি কবিতায় প্রেম বুনেছেন আবেগ ও আত্মীয়তার সঙ্গে।
‘তোমার চোখ এতো লাল কেন’ কবিতায় তিনি ভালোবাসার বীজ যেভাবে রোপণ করেন মাটিতে, কবিতার শরীরে তা অনবদ্য।
“আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক। আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী-সেবার দায় থেকে ।
......................................................
আমি বলছি না ভলোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন ভিতর থেকে আমার ঘরের দরোজা
খুলে দিক। কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক।
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক, ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন”
আর কী চাই মাটির এই প্রেম ও প্রার্থনার কাছে? প্রেম এলায়িত দ্রবণে হৃদয় আকুল করে জুড়ে বসে শরীর মন প্রাণ ও চিত্ত অধিকারে। সব সুখ ও অসুখে ভালোবাসার মোহ, প্রেমের দাহ ছড়িয়ে থাকুক অকূল দরিয়ার সাঁতার কাটার অবশ্রান্ত গৌরবে।
মনি হায়দার ।। কথাসাহিত্যিক