সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে সন্দেহ ও বাস্তবতা

সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্যতম একটি আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। এ সমুদ্র দ্বীপটির আয়তন ৮ বর্গ কিলোমিটার। দ্বীপটিতে বাস করেন প্রায় দশ হাজার মানুষ। তবে পর্যটনের কারণে প্রতি বছর সেখানে কয়েক লাখ মানুষ যাতায়াত ও অবস্থান করেন। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের আনাগোনায় দ্বীপটির জীববৈচিত্র্য ও সার্বিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
২০২৪ সালের এপ্রিলে এনভায়রনমেন্টাল অ্যাডভান্সেস (Environmental Advances) নামের বিজ্ঞান সাময়িকীতে সেন্টমার্টিন নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, পর্যটনের কারণে দ্বীপটিতে উচ্চ তাপমাত্রা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন উজাড়, দূষণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কচ্ছপের আবাসস্থল ধ্বংস, মিঠা পানির সংকট, জোয়ারে সমুদ্র ভাঙনসহ নানাবিধ বিপদ দেখা দিয়েছে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সেন্টমার্টিন নিয়ে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স (Ocean Science) জার্নালে আরেকটি গবেষণামূলক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছিল, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবাল শূন্য হতে পারে। দ্বীপটির ৪১ ভাগ প্রবাল ইতিমধ্যেই ধ্বংস হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আর কিছুকাল পর দ্বীপটি সমুদ্র গর্ভে ডুবে যাবে।
সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ২০২৪ সালের অক্টোবরে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পর্যটকদের জন্য নভেম্বর মাসে সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর ডিসেম্বর-জানুয়ারি দুই মাস রাত্রিযাপনের অনুমতি দেওয়া হয়।
তবে সে সময় পর্যটকদের সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সেই সাথে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে পর্যটকদের আগাম নিবন্ধন, ট্রাভেল পাস ও জাতীয় পরিচয়পত্র কার্ড প্রদর্শনপূর্বক দ্বীপে প্রবেশের বিধান চালু হয়। এ ব্যবস্থার ফলে সেন্টমার্টিনে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রবেশ ও বসবাসের সম্ভাবনা রোধ হয়ে যায়।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত নয় মাস সেন্টমার্টিন ভ্রমণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়। এই ৯ মাসের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাকালে সেন্টমার্টিন দ্বীপ সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর কতগুলো পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। যেমন
প্লাস্টিক বোতলসহ ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার অভিযান, বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে খাবার পানি উৎপাদন ও সরবরাহ, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় লোকজনের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ইত্যাদি।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করায় স্বার্থান্বেষী মহল সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে নানাবিধ অপপ্রচার চালানো শুরু করে। গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে একজন ভারতীয়র এক্স হ্যান্ডেল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রোপাগান্ডা চালানো হয় যে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি সেন্টমার্টিন দখল করে নিয়েছে।
পরবর্তীতে ফ্যাক্টচেক অনুসন্ধানী টিম রিউমার স্ক্যানার থেকে জানানো হয় সেন্টমার্টিন দখলের দাবিটি ভুয়া। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেন্টমার্টিনকে ঘিরে আরও একটি গুজবের ডালপালা মেলেছে। প্রচার করা হচ্ছে যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের জন্য দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দিয়েছে। এ নিয়ে অনেকে বেশ রসাত্মক ঢংয়ে লেখেন, কেন সেন্টমার্টিন বিশ্ব রাজনীতিতে এত গুরুত্বপূর্ণ, সামরিক ঘাঁটিতে বানাতে বাংলাদেশের কাছে আমেরিকার আবদার, সেন্টমার্টিন দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের কেন প্রয়োজন ইত্যাদি নানা কথা।
আরও পড়ুন
সূত্র ছাড়াই এসব মনগড়া কাহিনি যথেচ্ছ প্রচারিত হচ্ছে। অবশ্য এমন গুজবের আদি সূত্র ক্ষমতাচ্যুত হাসিনার বিভিন্ন উক্তি। শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় একাধিকবার মন্তব্য করেন যে, সেন্টমার্টিন দ্বীপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইজারা দেওয়ার জন্য তার ওপর চাপ রয়েছে। ২০২৩ সালের ২১ জুন গণভবনে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইজারা দিলে তার ক্ষমতায় থাকাতে কোনো অসুবিধা হবে না।
আমেরিকা বাংলাদেশের কাছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ চায় এবং সে জন্যই আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ তৈরি করছে। তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগের জোট সঙ্গী জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারাও হাসিনার এমন কথার সাথে সুর মেলান। শেখ হাসিনা বিএনপি'র প্রতি অভিযোগ করে বলেছিলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপ বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসতে চায়।
২০২৪-এর ৫ আগস্ট হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দিল্লিতে বসে দাবি করেন, যদি সেন্টমার্টিন দ্বীপটি ছেড়ে দিতাম তাহলে আজও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম। (দ্য ইকোনমিক টাইমস, ১১ আগস্ট ২০২৪)। শেখ হাসিনার এসব খেয়ালি কথার সাথে অন্যান্য মিডিয়াও যথেষ্ট সুর মেলায়।
২০১২ সালের ১ জুন ভারতের টাইমস গ্রুপের টিভি চ্যানেল টাইমস নাউ এক বায়বীয় দাবি করে বলে, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। চীনা প্রভাব মোকাবিলা করতেই যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরের একটি বড় অংশের ঘাঁটি হিসেবে চট্টগ্রামকে ব্যবহার করতে চায়।
এভাবেই শেখ হাসিনা ও ভারত সেন্টমার্টিন দ্বীপকে ঘিরে তাদের চালবাজিমূলক রাজনীতিকে সরগরম করে রাখেন। এই চালবাজির পুনরাবৃত্তি ঘটে যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটকদের ভ্রমণের ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। তখন থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ছড়ানো হয় যে, দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিএ প্রেস উইং ফ্যাক্টস নামক ভেরিফাইড ফেসবুক পাতায় জানিয়ে দেওয়া হয়, সেন্টমার্টিন দ্বীপ কোনো দেশের কাছে ইজারা দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের নেই।
শেখ হাসিনা জনগণের সামনে নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য মাঝেমধ্যেই সেন্টমার্টিন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এক হাত নিতেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১১ সালে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ নৌ-মহড়া শুরু হয়। সেই থেকে এখনো পর্যন্ত প্রতিবছর এ ধরনের যৌথ নৌ-মহড়া পরিচালিত হয়ে আসছে।
বস্তুত এদেশের সমুদ্র দ্বীপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইজারা দেওয়ার অপপ্রচার বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। এদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বামপন্থী দলগুলো তৎকালীন আওয়ামী সরকারের প্রতি অভিযোগ তুলেছিল যে ভোলার মনপুরা দ্বীপ ইজারা দেওয়ার বিনিময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অভিযোগ তুলেছিল সেন্টমার্টিন দ্বীপে মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের আয়োজন চলছে। ১৯৯১ সালে সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত উপকূলবাসীর সহায়তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী অপারেশন সি এঞ্জেল নামক কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল। সে সময়ও তখনকার খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে নানা অপপ্রচার চালানো হয়েছিল।
দেশের বাইরের কিছু মিডিয়া থেকে প্রায়ই প্রচার করা হয় চীনকে ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশের চট্টগ্রামে কিংবা কোনো দ্বীপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নৌঘাঁটি স্থাপন করতে চায়। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের প্রচারণার কোনো ভিত্তি নেই। আর এ অঞ্চলে মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের তেমন কোনো গুরুত্বও নেই।
সমুদ্রপথে চীনের বাণিজ্য জাহাজগুলো প্রথমে দক্ষিণ চীন সাগর হয়ে মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে আন্দামান সাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। অতঃপর বঙ্গোপসাগর থেকে ভারত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগর ব্যবহার করে। এভাবে চীনের বাণিজ্যিক জাহাজগুলো পশ্চিম এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রবেশ করে।
দক্ষিণ চীন সাগর অঞ্চলে চীনকে ঠেকানোর জন্য ফিলিপাইনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী নৌঘাঁটি রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে আন্দামান ও বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করবার জন্য মালাক্কা প্রণালী ছাড়া আর কোনো নৌপথ নেই। মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া মধ্যবর্তী ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মালাক্কা প্রণালীতে চীনকে ঠেকানোর জন্য সিঙ্গাপুরে মার্কিন নৌঘাঁটি রয়েছে।
মালাক্কা প্রণালী পার হয়েই আন্দামান সাগরে অবস্থিত ভারতীয় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতের বিমান ও নৌঘাঁটি রয়েছে। এভাবে এ তিনটি সামরিক স্থান চীনকে আটকানোর জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। বস্তুত চীন মার্কিন নৌ যুদ্ধের ফয়সালা হবে মালাক্কা প্রণালীতে। সেখানে চীনকে ঠেকাতে না পারলে চীনের জন্য আন্দামান সাগর, বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর এমনিতেই উন্মুক্ত হয়ে যাবে। তাই এদিক বিবেচনায় বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ উপকূলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের কোনো প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব নেই।
জুবায়ের হাসান ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক
zubairjcc1163@gmail.com