প্রাণী থেকে মানুষের রোগ : মহামারির উৎস ও বিস্তার

বিভিন্ন সংক্রামক রোগের উৎপত্তি প্রাণী থেকে হলেও, সময়ের সঙ্গে সেগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে মহামারিতে রূপ নিতে পারে। ইতিহাসে দেখা যায়, কিছু কিছু রোগ প্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়ে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে। এইচআইভি/এইডস, ইবোলা, সার্স, মার্স ও ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগগুলোর প্রভাব বিশ্বজুড়ে লক্ষ করা গেছে।
বিজ্ঞাপন
এসব রোগের বিস্তার, সংক্রমণ প্রক্রিয়া এবং ভয়াবহ পরিণতি মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিছু কিছু প্রাণীবাহিত রোগ রয়েছে যেগুলো প্রথমে প্রাণী দেহে থাকে এবং পরে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এসব রোগের মধ্যে কিছু রোগে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণও ঘটে, যা মহামারি আকার ধারণ করার ইতিহাস রয়েছে। এর মধ্যে কিছু রোগ বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশাল ক্ষতি করেছে।
এখানে এমন কিছু রোগের বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো যা প্রথমে প্রাণীর দেহে ছিল এবং পরবর্তীতে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞাপন
হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (Human Immunodeficiency Virus—HIV)/এইডস (Acquired immunodeficiency syndrome—AIDS): এইচআইভি প্রথমে আফ্রিকার বানরের দেহে ছিল। এটি একটি ভাইরাস, যা বানর থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়, মূলত বানরের মাংস খাওয়ার মাধ্যমে।
১৯৬০ এর দশকে এটি মানবদেহে ছড়িয়ে পড়ে। এটি SIV (Simian Immunodeficiency Virus) নামক ভাইরাস থেকে উৎপন্ন হয়েছিল। মানুষের মধ্যে এই ভাইরাসটি HIV হিসেবে পরিচিত এবং এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয়, যার ফলে এইডস নামক রোগের সৃষ্টি হয়।
বিজ্ঞাপন
...রোগের বিস্তার, সংক্রমণ প্রক্রিয়া এবং ভয়াবহ পরিণতি মানুষের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কিছু কিছু প্রাণীবাহিত রোগ রয়েছে যেগুলো প্রথমে প্রাণী দেহে থাকে এবং পরে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এইচআইভি মানুষের মধ্যে প্রধানত রক্ত, শুক্রাণু, মূত্র এবং অন্যান্য শারীরিক তরল দ্বারা সংক্রমিত হয়। একে অপরের অব্যবস্থাপিত যৌন সম্পর্ক, ইনজেকশন শেয়ার করা বা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়। এইচআইভি প্রাথমিকভাবে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়, ফলে রোগীর শরীরে নানা ধরনের সংক্রমণ, ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগ ছড়িয়ে পড়ে।
এইডস রোগী বিভিন্ন মারাত্মক সংক্রমণের শিকার হয় এবং মৃত্যুর কারণ হতে পারে। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৬ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি/এইডসের কারণে মারা গেছে এবং প্রতি বছর ১.৭ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়। এটি মূলত আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কিছু অঞ্চলে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে।
ইবোলা (Ebola): ইবোলা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ প্রাণী থেকে মানুষে ঘটে। বিশেষত বাদুড়, বানর এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী ইবোলা ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। এরপর এটি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ১৯৭৬ সালে প্রথম আফ্রিকার সুদানে এবং কঙ্গোতে ইবোলা ভাইরাসের মহামারি দেখা দেয়। এটি মূলত আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের তরল (যেমন, রক্ত, লালা, মূত্র এবং সুতরাং) থেকে মানুষে ছড়ায়।
ইবোলা মানুষের মধ্যে শারীরিক সংস্পর্শের মাধ্যমে দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে। একে অপরকে সংক্রমিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ইবোলা ভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণগুলোর মধ্যে উচ্চ জ্বর, মাথাব্যথা, পেশির ব্যথা, দুর্বলতা, জ্বর ভাব, রক্তক্ষরণ, পেটব্যথা, এবং অন্যান্য সমস্যা অন্তর্ভুক্ত।
আরও পড়ুন
এটি মারাত্মক হলে শক, মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইবোলা ভাইরাসের মহামারি সাধারণত খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারে এবং মৃত্যুহার অত্যন্ত উচ্চ। ২০১৪-২০১৬ সালের পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা মহামারিতে প্রায় ১১,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
সার্স (SARS): সার্স প্রথমে বাদুড়ের মধ্যে ছিল, যা পরে সিভেট (এক ধরনের মাংসাশী প্রাণী) এবং অন্য পশুদের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০২ সালে চীনে এটি প্রথম শনাক্ত হয় এবং বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। SARS-CoV ভাইরাস মূলত মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
এই রোগটি মূলত মানুষের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়, যেমন আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা অন্য কোনো শারীরিক তরল থেকে। এটি সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে সহজেই সংক্রমিত হতে পারে। SARS আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে তীব্র শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি, মাথাব্যথা এবং মস্তিষ্কে প্রদাহের মতো লক্ষণ দেখা যায়।
সার্স মহামারিতে প্রায় ৮০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। যদিও এটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আকারে ছড়ায়নি, তবুও এটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল যে এই রোগটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
মার্স (MERS): মার্স ভাইরাস প্রথমে উটের মধ্যে ছিল এবং এটি পরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১২ সালে প্রথম এটি মধ্যপ্রাচ্যে শনাক্ত হয়। উটের শরীরে থাকা ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হওয়ার পর, এটি শ্বাসযন্ত্রের গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করে।
ইবোলা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ প্রাণী থেকে মানুষে ঘটে। বিশেষত বাদুড়, বানর এবং অন্যান্য জীবন্ত প্রাণী ইবোলা ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে।
MERS-CoV সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে ছড়ায়, অর্থাৎ আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি, হাঁচি বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাস অন্যদের শরীরে প্রবাহিত হতে পারে। মার্স আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি, মাংসপেশিতে ব্যথা, গলা ব্যথা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। মার্সে আক্রান্ত হওয়ার পর মৃত্যুহার বেশ উচ্চ, প্রায় ৩৫ শতাংশ। যদিও এটি সার্সের মতো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েনি, তবে এটি সংক্রমণ এবং সংক্রামকতার কারণে একটি বড় স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা (Influenza): ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসগুলো সাধারণত পাখি ও শূকরের মধ্যে থাকে এবং মানব শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৯ সালের H1N1 ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিটি মূলত শূকর থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছিল এবং পরে এটি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস মানুষের মধ্যে শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি, হাঁচি বা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ভাইরাসটি ছড়িয়ে দেয়। এটি সাধারণত শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা সৃষ্টি করে, যেমন জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা, কাশি, শরীরে ব্যথা এবং ক্লান্তি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, H1N1 মহামারিতে ২০০৯ সালে প্রায় ২০,০০০-৫০,০০০ লোক মৃত্যুবরণ করে।
প্রাণীবাহিত রোগ পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী মহামারির আকার ধারণ করেছে। প্লেগ, ম্যালেরিয়া, রাবিস, ডেঙ্গু ইত্যাদি রোগ সারা পৃথিবীতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
এই রোগগুলোর প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাহায্য এবং জাতীয় পর্যায়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। জনগণের সচেতনতা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন এবং দ্রুত চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুললে এসব রোগের বিস্তার অনেকটাই কমানো সম্ভব।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, গবেষক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com