স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভাবনা

আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ঘিরে চলে তামাশা, প্রহসন ও ভোট ডাকাতির উৎসব। সংঘটিত হয় সহিংসতা। আওয়ামী লীগের তাণ্ডবে টিকতে না পেরে প্রধান প্রধান বিরোধীদলসমূহ স্থানীয় সরকারের সর্বশেষ নির্বাচনগুলোতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে অধিকাংশ মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান এবং মেম্বারদের পদগুলো আওয়ামী নেতাদের দখলে চলে যায়।
মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৯ আগস্ট সরকার দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন, ৩৩১টি পৌরসভা, ৬১টি জেলা পরিষদ (তিন পার্বত্য জেলা বাদে) ও ৪৯৫টি উপজেলা পরিষদের মেয়র, চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে সে স্থলে প্রশাসক নিয়োগ করে। তবে আদালতের রায়ের কারণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব লাভ করেন বিএনপি নেতা শাহাদাত হোসেন। এরপর ২৭ সেপ্টেম্বর সব সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়। স্থানীয় সরকারের এই চার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য আকার ও পরিধি ভেদে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রমুখ সরকারি কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়।
তবে ৪৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বারদের স্বপদে বহাল রাখা হয়। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি'র পক্ষ থেকে ইউনিয়ন পরিষদও ভেঙে দেওয়ার দাবি ওঠে। কেননা আওয়ামী আমলে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মেয়র-কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান-মেম্বাররা জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার অন্তরায়।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও এর নির্বাচন নিয়ে বহুবার কাটাছেঁড়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী ও যথাযথ কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেনি। এর জন্য কেন্দ্রীয় শাসনের সর্বময় কর্তৃত্ব, এলাকার উন্নয়নে জাতীয় সংসদ সদস্যদের (এমপি) এখতিয়ার ও তদারকি, দলবাজির রাজনীতি, নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ এসবই মূলত দায়ী।
বিশেষ করে আওয়ামী আমলে নির্বাচনী ব্যবস্থায় দলীয় মনোনয়ন ও দলীয় প্রতীক বরাদ্দের বিধান চালু হাওয়ায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন তার নির্দলীয় ঐতিহ্য ও জৌলুস হারিয়ে ফেলে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে পূর্ণ মাত্রায় রাজনীতিকরণ করায় ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের উদীয়মান নেতৃত্ব ছিটকে পড়ে। এলাকার সমাজ সেবক, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবী শ্রেণি এমন ব্যক্তিত্বরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে দূরে সরে যায়।
ভোটাররা মেরুকরণের রাজনীতির কাছে অসহায় হয়ে পড়েন। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কার্যত পরিণত হয় কালো টাকার লড়াই ও দলীয় মনোনয়ন বাণিজ্যের খেলায়। জলমহল দখলের মতো মেয়র-চেয়ারম্যান কিংবা কাউন্সিলর-মেম্বারের পদগুলো দখলের জন্য চলে পেশি শক্তির প্রদর্শন। প্রার্থী কর্তৃক টাকার বিনিময়ে ভোটারের ভোট ক্রয় একটি রেওয়াজে পরিণত হয়।
স্থানীয় সরকারের এ শোচনীয় অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করে। সংস্কার প্রস্তাবনা ও মতামত প্রদানের জন্য কমিশনকে তিন মাস সময় দেওয়া হয়। কমিশন প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ ২৪ নভেম্বর এক মত বিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের তথা মেয়র বা চেয়ারম্যানদের সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচিত করার কথা বলেন। অর্থাৎ কাউন্সিলর-মেম্বারদের ভোটে মেয়র-চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার বিধান চালুর অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু এ ধরনের বিধান চালু করা হলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার আরও বেহাল দশা হতে পারে। কেননা এতে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কাউন্সিলর কিংবা মেম্বারদের বশ করার মাধ্যমে মেয়র বা চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটারদের মূল আকর্ষণ বিন্দু হলেন মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীগণ। তাই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার বিধান রহিত করা হলে নির্বাচনের মূল আমেজটাই নষ্ট হয়ে পড়বে। তখন ভোট প্রদানের হার অর্থাৎ ভোটার টার্ন আউট উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে। এলাকার উন্নয়ন ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় মেয়র কিংবা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত নেতৃত্বের কারিশমাতেও ভাটা পড়বে। স্থানীয় নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকে সেটারও বিলুপ্তি ঘটবে।
আরও পড়ুন
৬ জানুয়ারি ২০২৫ ড. তোফায়েল আহমেদ আরেকটি মতবিনিময় সভায় আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসাথে আয়োজনের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের বাইরের মানুষের মতামতে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। তার মতে, ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধাপে ধাপে যেসব স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে মোট ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন একসাথে আয়োজন করা গেলে রাষ্ট্রের মাত্র ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
৮ জানুয়ারি ২০২৫, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের (ইআইবি) ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সাথে বৈঠককালে তাকে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে। সুতরাং কমিশন প্রধান এবং সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এ দুজনের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, জাতীয় নির্বাচনের আগে কিংবা একসাথে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো কেবলমাত্র জাতীয় নির্বাচনের পরেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়েছে। এতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মতপার্থক্য প্রকাশ পেয়েছে।
২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও এমন মতবিরোধ হয়েছিল। সে সময় বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই চারটি সিটি কর্পোরেশন ও নয়টি পৌরসভার নির্বাচন আয়োজনের বিরোধিতা করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের আগেই ২০০৮ সালের ৪ আগস্ট স্থানীয় সরকারের ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অংশ নেয় এবং তাতে জনগণও সাড়া দেয়। ফলে সেই নির্বাচনে শতকরা ৮০ শতাংশের ওপর ভোট পড়ে।
বর্তমানে কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান আরও বিলম্বিত হতে পারে এবং নির্বাচিত মেয়র-চেয়ারম্যানদের দ্বারা কিংস পার্টি গঠিত হতে পারে। কিন্তু এসব ধারণা অমূলক এবং যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা তাই যদি হতো, তাহলে একসাথে জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে রাজনীতিক দলগুলোর আপত্তি থাকার কথা নয়।
৫ আগস্ট ২০২৪ হাসিনার পতনের পর দেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিরাট সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের গণতন্ত্র ও সুশাসনের মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। এসব প্রতিষ্ঠান দেশের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সাথে সম্পর্কিত। তাই জাতীয় সংসদের চেয়ে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব কোনো অংশেই কম নয়। বিগত দিনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক হয়ে ওঠে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অধীনে অনুষ্ঠিত স্থানীয় সরকার নির্বাচনকালে ভোটাররা এলাকার উন্নয়নের প্রত্যাশায় সরকারি দলের সাথে জড়িত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফলে অন্যান্য বিরোধী দলীয় কিংবা নির্দলীয় প্রার্থীদের যোগ্যতা থাকলেও তারা পিছিয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সব প্রার্থীর জন্যই লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত হয়। এছাড়া জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা হলে তা নির্বাচন কমিশনের জন্য হতে পারে একটি টেস্ট কেস। এর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবে।
জুবায়ের হাসান ।। রাজনৈতিক বিশ্লেষক
zubairjcc1163@gmail.com