ই-কমার্স খাতে ভ্যাট পুনর্বিবেচনার আহ্বান
একজন ই-কমার্স ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসেবে আইসিটি খাতের বিকাশে মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ উল্লেখিত ইন্টারনেট ও টেলিফোন সেবায় বৃদ্ধিকৃত মূল্য সংযোজন কর হ্রাস করার অনুরোধ জানাচ্ছি। মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এ অনুচ্ছেদ ৩(গ)-তে উল্লেখিত সেবা কোড এস০১২.১০ ও এস০১২.১৪ এর মূসকের (ভ্যাট) হার বৃদ্ধি করে যথাক্রমে টেলিফোন সেবায় ২৩ শতাংশ এবং ইন্টারনেট সেবায় ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ইন্টারনেট বাংলাদেশ ই-কমার্স বিজনেস-এর লাইফ লাইন। বাংলাদেশের ই-কমার্স খাত ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ট্র্যাজেডি এবং ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে একটি জটিল এবং বহুমুখী সংকট ছিল, উল্লেখযোগ্যভাবে যে পরিমাণ ব্যবসার ব্যাঘাত ঘটেছে বা ব্যবসার অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তা থেকে ধীরে ধীরে ব্যবসায়ীরা ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, পরিস্থিতি ক্রমাগতভাবে পরিবর্তিত হচ্ছিল এবং পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে। আমরা আশা করেছিলাম বাংলাদেশের ই-কমার্স খাতের বর্তমান পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে উত্তরণের মাধ্যমে সামনের দিনগুলোয় আরও বিস্তৃত হবে। কিন্তু ই-কমার্স এর লাইফ লাইন ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ই-কমার্স ব্যবসার ব্যবসায়িক ও খরচ যেমন বাড়বে, তেমনি গ্রাহক সেবাও বিঘ্নিত হবে সাথে সাথেই কমার্স ইন্ডাস্ট্রি মুখ থুবড়ে পড়বে।
জুলাই-আগস্ট এর ছাত্র ও জনতার বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চলমান সময়ে ই-কমার্স খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ নেই। আবার সরকারের চলমান নীতি সংস্কার কার্যক্রমেও ই-কমার্স খাত পুরো ব্যবসায়িক কার্যক্রমের একটা ছোট অংশ হলেও এই খাত প্রাধান্য পায়নি। দেশের কর্মসংস্থানের একটি অংশ ই-কমার্স খাত থেকে হয় যা পুরোপুরি উপেক্ষিত। এ খাতে সংস্কার এবং চলমান সংস্কার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ হলো ই-কমার্স এর জন্য ৩৬তম লার্জেস্ট মার্কেট সব দেশের মধ্যে। যার আর্থিক মার্কেট সাইজ আনুমানিক প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা, আনুমানিক প্রায় ১২ কোটির মতো মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং আনুমানিক প্রায় ১০ কোটি ফেসবুক ইউজার আছে, যার মধ্যে ১০ শতাংশ ইউজার মানে প্রায় ১ কোটি ইউজার ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিতে অর্ডার বা সেবা নিয়ে থাকেন। যার মধ্যে ১৫ লাখ মানুষ ই-কমার্সে অর্ডার করে থাকেন প্রায় প্রতিদিন। দৈনিক প্রায় ৮ লাখের অধিক অর্ডার হয় এবং প্রতি অর্ডারে বাস্কেট সাইজ ১২৫০ থেকে ১৪৫০ এর মতো এবং দৈনিক ই-কমার্স এর ট্রানজেকশন হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো। ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির ওপর সামগ্রিক প্রভাব পড়বে।
বেশ কয়েক বছর আগে করোনা মহামারির সময়ে ইন্টারনেটের ফলে ই-কমার্স বিজনেস অনেকটা আশীর্বাদ হয়ে উঠেছিল, জীবন এবং জীবিকার একটা পথ তৈরি করে দিয়েছিল। গৃহবন্দি মানুষগুলোর নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন অনলাইন ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল তেমনি কয়েক লাখ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছিল। যার ৬০ শতাংশই ছিল নারী উদ্যোক্তা।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
ইন্টারনেট ও টেলিফোন সেবার ভ্যাট বৃদ্ধি আইসিটি নির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যকে বাধাগ্রস্ত করবে। ই-ক্যাবের প্রায় ২৭০০ মেম্বারসহ আনুমানিক প্রায় সাড়ে তিন লাখ ফেসবুক পেইজ আছে যারা এফ কমার্স এবং ইনস্টাগ্রামে বিজনেস করে থাকেন, যার ২০ শতাংশ নারী এবং তিন লাখ ফেসবুক পেইজ যারা বিজনেস করেন তাদের ৯৭ শতাংশ এসএমই বা ছোট উদ্যোক্তা। এছাড়া ছয় লাখের বেশি ফ্রিল্যান্সার সরাসরি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। এই ভ্যাট বৃদ্ধি তাদের কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
অধ্যাদেশে ইন্টারনেট সেবায় ভ্যাট ১০ শতাংশ এবং টেলিফোন সেবায় ২৩ শতাংশে উন্নীত করার সিদ্ধান্তের ফলে দেশের ই-কমার্স, এফ কমার্স, আইটি, ট্যুরিজম, রেস্টুরেন্ট, ডেলিভারি সার্ভিস, ভ্লগার এবং মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সামগ্রিকভাবে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি ই-কমার্স এবং আইটি কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রে বাৎসরিক টার্নওভার ৩ কোটির পরিবর্তে ৫০ লাখ টাকার বেশি হলেই ভ্যাট নিবন্ধনের শর্ত আরোপ করার সিদ্ধান্তও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
পরিশেষে বলা যায় যে, উল্লেখিত সমস্যাসমূহ বিবেচনায় এনে ইন্টারনেট, টেলিফোন সেবার ওপর ভ্যাট না বাড়ানো এবং কোম্পানির বার্ষিক টার্নওভার ৩ কোটির পরিবর্তে ৫০ লাখ টাকার বেশি হলে ভ্যাট নিবন্ধিত হওয়ার শর্ত বাতিল করে ই-কমার্স এবং আইসিটি খাতের বিকাশে উদ্যোক্তা নির্ভর বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কমার্সের একজন ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসেবে সরকারকে আন্তরিক অনুরোধ করছি। আশা করি বর্তমান সরকার এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ই-কমার্সে সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করবেন।
সোহেল মৃধা ।। ই-কমার্স উদ্যোক্তা