প্রশ্নের মুখে বৈশ্বিক পরিবেশ বাঁচানোর ভাবনা
লস অ্যাঞ্জেলেসের অর্থ ‘পরীদের শহর’। সেই শহরই এখন স্রেফ আগুনের গ্রাসে। ভাবতেই কেমন জানি লাগছে! ভয়াবহ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমেরিকার বিখ্যাত বৈভবের এই শহরটি। যে যুক্তরাষ্ট্রকে মনে করা হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিক শক্তিশালী দেশ সেই দেশটি এখন প্রকৃতির কাছে বিরাট ধরাশায়ী।
তাদের অসহায়ত্ব এখন টের পাচ্ছে বিশ্ববাসী। পর্যাপ্ত পানির অভাবে পরিস্থিতি কতটা খারাপ থেকে খারাপতর হতে পারে তার চাক্ষুষ প্রমাণ এই দাবানল। তার ওপরে রয়েছে কাজের দুর্বল নেতৃত্ব, প্রবল বাতাস ও আগুন নেভাতে এসে পর্যাপ্ত পানি না পেয়ে দমকল বাহিনীর অসহায় আত্মসমর্পণ যা বিচিত্র ও ভিন্ন যুক্তরাষ্ট্রকে দেখলো জনগণ। এখন প্রশ্ন উঠছে নিজ দেশে এত জলবায়ু সম্মেলন করে কী অর্জন করলো তারা?
দাবানল কী?
দাবানল হচ্ছে বনভূমি বা গ্রামীণ এলাকার বনাঞ্চলে সংঘটিত একটি অনিয়ন্ত্রিত আগুন যা পাহাড়ি অঞ্চলে একটু বেশি হয়ে থাকে। প্রাকৃতিকভাবে দাবানল সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বজ্রপাত। এর ফলে বিভিন্ন স্থানে শুরুতে ছোট ছোট দাবানলের সৃষ্টি হয়। তারপর বাতাসের সংস্পর্শে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। শুষ্ক মৌসুমে বনে আগুন লাগলে তা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তার ওপরে বাতাসের বেগ থাকলে তো কথাই নেই।
ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের মতে, আমেরিকার প্রায় ৮৫ শতাংশ দাবানল মানুষের কারণে হয়ে থাকে। অযত্নে ফেলে রাখা ক্যাম্প ফায়ারের আগুন বা সিগারেটের আগুন মানুষ অসতর্ক অবস্থায় ফেলে রাখে। ফেলে রাখা আগুন থেকে দাবানলের সৃষ্টি। দাবানলের আগুন ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে চলতে সক্ষম।
তিন দশকের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন রেইনফরেস্ট, আফ্রিকার কঙ্গো রেইনফরেস্ট এলাকাসহ অনেক ভূমি মানবসৃষ্ট দাবানলে পুড়েছে। দাবানলের আগুন থেকে অগ্নিঝড়, টর্নেডো তৈরি হতে পারে এবং এর ছাই বহুদূর এমনকি ৩ হাজার মাইল দূর পর্যন্ত চলে যেতে পারে।
আগুন লাগলো কীভাবে?
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও এর আশপাশে যে দাবানল জ্বলছে তা কিন্তু নতুন কিছু নয়। এই এলাকায় আগুনের এমন ভয়ংকর ইতিহাস বহুদিনের। গরম, খরা আর বাতাসের কারণে এই অঞ্চলে আগুন লাগার ঝুঁকি সবসময়ই বেশি থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবী আরও গরম ও শুষ্ক হয়ে উঠছে। এ কারণে আগুন এখন আগের চেয়ে আরও বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
...পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির অভাব যেমন একটি কারণ। তেমনি যে গতিতে আগুন ছড়াচ্ছে, তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার তারও অভাব চোখে পড়ছে।
প্রায় এক সপ্তাহ ধরে দাবানলে পুড়তে থাকা লস অ্যাঞ্জেলেস এখন প্রায় ভস্মীভূত। মূলত লস অ্যাঞ্জেলস এলাকাটি পাহাড়ি অঞ্চলে ঘেরা। পাহাড় থেকে আগুন ছড়াচ্ছে শহুরে বিভিন্ন এলাকাগুলোয়। যদিও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রাকৃতিক কারণেই এই আগুনের সূত্রপাত। দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাত না হওয়া, শুষ্ক আবহাওয়া ও বাতাসের প্রবল বেগের কারণে এই দাবানল সৃষ্টি হয়েছে। দাবানল উৎপত্তির স্থান হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে পিয়েদ্রা মোড়াদা ড্রাইভের একটি বাড়ির পেছনের বনাঞ্চলকে।
ন্যাশনাল ফায়ার প্রটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে দাবানলের সূত্রপাত হওয়ার ক্ষেত্রে বড় একটি কারণ হলো বজ্রপাত। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার আগুনের ক্ষেত্রে তেমন কিছু হয়নি বলে মনে করছেন আবহাওয়া অফিস। বজ্রপাত, অগ্নিসংযোগ, বৈদ্যুতিক লাইন ছাড়াও অনেক সময় আবর্জনা পোড়ানো এবং আতশবাজি ফাটানো থেকেও দাবানলের সূত্রপাত হতে পারে। তাছাড়া দুর্ঘটনায় অসংখ্য উৎস থেকেই আগুন ছড়াতে পারে। তবে লস অ্যাঞ্জেলসের এবারের দাবানলটি সন্দেহের বিভিন্ন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে ইতিমধ্যে। সৃষ্টি করছে নানা রহস্যের।
মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত সংখ্যা কত?
হাজার দশেকেরও বেশি স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত শহরকে লেলিহান শিখার ছোবলে পুড়তে দেখেছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দারা। আহত ও নিহতের সংখ্যা কত? সূত্র যা প্রকাশ করছে, প্রকৃত সংখ্যা তা দ্বিগুণের চেয়ে বেশি এটা আমাদের সবার অজানা নয়। এখনো মৃত্যুর মিছিল বেড়ে চলেছে। যখন আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসবে তখনই হয়তো বোঝা যাবে আসলে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি কত। অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে ফেললেও সব কি আর লাঘব করা যায়?
আরও পড়ুন
ইতিমধ্যেই লস অ্যাঞ্জেলেসে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। যেহেতু ধোঁয়ায় ঢেকেছে বিশাল এলাকা, সেই ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে লাখ লাখ আমজনতা। তাই তাদের আপাতত ঘরবন্দি থাকতে নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। আগুনের গ্রাসে অন্তত ১২ হাজারেরও বেশি বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। প্রতিদিন আরও নতুন সংখ্যা যুক্ত হচ্ছে। বিধ্বংসী আগুনে কার্যত কবরে পরিণত হয়েছে ক্যালিফোর্নিয়া। আগুন ছড়িয়েছে ৩৭ হাজার একরেরও বেশি অঞ্চল জুড়ে। কেড়ে নিয়েছে বহু মানুষের জীবন ও সম্পদ। প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটায় অসহায় তারই জ্বলন্ত প্রমাণ এটি।
আগুন নেভাচ্ছে কয়েদিরা
দাবানলের পরিস্থিতি সামাল দিতে এবারে সামনে থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন জেলবন্দিরাও! প্রায় হাজারখানেক (যদিও সঠিক সংখ্যাটা ৯৩৯) জেলবন্দিরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে আগুন নেভানোর কাজ করে চলছেন বলে জানা যাচ্ছে বিবিসি সূত্র থেকে।
সমাজে একটি কথা প্রচলিত আছে, জেলখাটা মানুষ মানেই দাগি আসামি! তারা এভাবে লড়ছেন দমকল বাহিনীর সঙ্গে, এটা অকল্পনীয়। মূলত ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিলেন তারা। দুর্যোগকালীন সময়ে অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন তারা হয়েছেন জাতীয় বীর। প্রকৃতি কখনো যে কোনো বিভেদ মানে না তা আবারও স্মরণ করিয়ে দিলো।
আগুন নেভাতে না পারার কারণ?
দাবানলের আগুন নেভানোর কাজটা যতটা মুখে বলা সহজ বাস্তবে কিন্তু ততটা কঠিন। আসলে প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করা ও অনেক বড় চ্যালেঞ্জিং। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানির অভাব যেমন একটি কারণ। তেমনি যে গতিতে আগুন ছড়াচ্ছে, তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে যে ধরনের প্রস্তুতি দরকার তারও অভাব চোখে পড়ছে। অনেকের মতে, কাজের সমন্বয়হীনতা ও দমকলকর্মীদের দক্ষতার অভাব অন্যতম কারণ। ফলে আগুন নিয়ন্ত্রণে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
দাবানল নিয়ে মার্কিন কূটনীতি
দাবানল পরিস্থিতির এই অবনতির জন্য ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় তোপ দাগা শুরু করে দিয়েছেন আমেরিকার ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং বিশ্বের সবথেকে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক। লস অ্যাঞ্জেলেসে পানির অভাবের জন্য ট্রাম্প দায়ী করেছেন এক ধরনের মাছকে। এ নিয়ে ট্রুথ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তিনি লিখেছেন, ‘স্মেল্ট নামের ছোট একটা মাছকে রক্ষা করতে গিয়ে পানির সমস্যা বাড়িয়েছে। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার মানুষের কথা ভাবেননি। এর জন্য বাইডেন প্রশাসনই প্রত্যক্ষ দায়ী’। আবার মাস্ক দুষছেন লস অ্যাঞ্জেলেসের দমকলবাহিনীর সংরক্ষণ নীতিকে। তাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য কোনোটাই যে কম উত্তাপের নয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুনের চেয়ে সেই আগুনের উত্তাপ আঁচ করা যাচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ নীতি ও বৈশ্বিক পরিবেশ বাঁচানোর ভাবনা
মার্কিন পরিবেশ নীতি ও তাদের জীবন যাপন দেখলে অনেক অবাক হয়। তাদের পরিবেশ সংরক্ষণ নীতিমালায় ভালো ভালো বক্তব্য সন্নিবেশিত থাকলেও বাস্তবে মার্কিনিরা কিন্তু পরিবেশ ধ্বংসে বেপরোয়া। বিশ্বাস করে অবকাঠামো ও নগরায়নে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজেটে সামরিক ও অবকাঠামো খাতে যত ব্যয় করে পরিবেশ খাতে এর কম করে কেন? উত্তর একটাই তারা ব্যবসা ছাড়া কিছুই বোঝে না। এখন তাদের দেশে যে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে তারপরও তাদের কি বোধ উদয় হবে না?
দূষণ, বন্যপ্রাণী সুরক্ষা, ভূমি ব্যবহার, শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার, বর্জ্য উৎপাদন এবং বর্জ্য নিষ্পত্তির মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি পরিবেশগত নীতি প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একক বা ব্যাপক পরিবেশগত নীতি নেই।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণ করে ধনী দেশগুলো আর বরাবরই ঝুঁকিতে থাকে গরিব দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও অর্থনীতিকে বদলে দেবে। আমরা কতটুকু জানি তা? শুধু নিজের মতো করে প্রস্তুতি নিলেই হবে না। সবাইকে মিলে বড় উদ্যোগ নিতে হবে। পৃথিবী কোনো একক রাষ্ট্রের না বরং সবার। সবাই মিলে টেকসই জলবায়ু সুনিশ্চিত করতে হবে।
দূষণ, বন্যপ্রাণী সুরক্ষা, ভূমি ব্যবহার, শক্তি উৎপাদন ও ব্যবহার, বর্জ্য উৎপাদন এবং বর্জ্য নিষ্পত্তির মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য একটি পরিবেশগত নীতি প্রয়োজন। বাস্তবতা হলো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একক বা ব্যাপক পরিবেশগত নীতি নেই। পরিবেশগত সমস্যাগুলোর প্রতি এর প্রতিক্রিয়া-পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক, কর্পোরেট এবং জনসাধারণের প্রভাব, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং বৈজ্ঞানিক অনিশ্চয়তার সাপেক্ষে দ্বারা নির্ভরশীল।
পুরো বিশ্ব কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ নীতির দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের জলবায়ু তহবিলের অর্থ দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো দুর্যোগ মোকাবিলা করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবানলে হাওয়া যে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পড়বে না তা উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব নয়। সময় হয়তো এর যথার্থ উত্তর দিয়ে দেবে। পরিবেশে বিপর্যয় রোধে সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই আমরা পরিবেশে বাঁচাতে পারবো। পরিবেশ বাঁচালে, মানুষ বাঁচবে। মানুষ বাঁচলে, পৃথিবী বাঁচবে।
প্রশান্ত কুমার শীল ।। শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
vprashantcu@gmail.com