সরকারি চাকরি : কোন দেশে কীভাবে বাদ দেওয়া হয়?
সরকারি চাকরি সাধারণত গোটা বিশ্বব্যাপী উচ্চমর্যাদার এবং আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এর কদর বিভিন্ন দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। বিশেষ করে মেধা ও যোগ্যতা প্রমাণের ভিত্তিতেই উন্নত দেশে সরকারি চাকরি প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রায় শতভাগ।
রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা বড় কোনো অপরাধ প্রমাণ হওয়া ব্যতীত বিশ্বের উন্নত দেশে সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে কোনো বাধা নেই। এমনকি চাকরিতে নিয়োগ লাভের পর সহজেই কাউকে বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি দেখা যায় না বললেই চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি চাকরি থেকে কাউকে নিয়োগ থেকে বাদ দেওয়া বা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্যের শিকার হওয়া সাধারণত নিষিদ্ধ এবং আইনবিরোধী।
তবে কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এর ব্যতিক্রম থাকতে পারে। যেমন মেরিট সিস্টেম এবং সিভিল সার্ভিস প্রটেকশন, সিভিল সার্ভিস রিফর্ম অ্যাক্ট ১৯৭৮ এবং সিভিল সার্ভিস রিফর্ম অ্যাক্ট ১৮৮৩ এর মাধ্যমে অধিকাংশ ফেডারেল সরকারি চাকরি যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়ে থাকে। রাজনৈতিক মতাদর্শ বা দলীয় সমর্থনের ভিত্তিতে নিয়োগ, পদোন্নতি কিংবা বরখাস্ত করা আইনত নিষিদ্ধ।
এজন্য United States Office of Personnel Management (OPM) মেরিট সিস্টেম বজায় রাখার জন্য কাজ করে। বিশেষ কিছু আইন অনুযায়ী সরকারি ফেডারেল কর্মচারীদের রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ সীমিত করা হয়। ফেডারেল কর্মীরা কাজের সময় রাজনৈতিক প্রচারণায় জড়িত হতে পারেন না। তবে সাধারণ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যায় না।
কানাডাতে সরকারি চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কানাডায় পুলিশ ভেরিফিকেশন বা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষ করে পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য সংবেদনশীল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা কানাডার আইনি কাঠামো এবং মানবাধিকার আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
কানাডাতে সরকারি চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কানাডায় পুলিশ ভেরিফিকেশন বা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। বিশেষ করে পুলিশ, সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য সংবেদনশীল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে নিয়োগ থেকে বঞ্চিত করা কানাডার আইনি কাঠামো এবং মানবাধিকার আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
কানাডার হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট, কানাডা চার্টার অব রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস-এর অধীনে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে কাউকে বৈষম্যের শিকার করা বেআইনি। এমপ্লয়মেন্ট ইকুয়িটি অ্যাক্ট এর অধীনে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রার্থীর বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ, এবং রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে বৈষম্য করা যায় না।
পুলিশ ভেরিফিকেশন বা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক শুধুমাত্র অপরাধমূলক কার্যকলাপ বা নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খোঁজার জন্য ব্যবহৃত হয়, রাজনৈতিক আনুগত্য বা সমর্থন খুঁজে বের করার জন্য নয়। কানাডায় কোনো প্রার্থীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়, তবে তা পুলিশ ভেরিফিকেশনে উঠে আসতে পারে। যেমন হিংস্র রাজনৈতিক আন্দোলন বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকলে তা প্রার্থীর নিয়োগে প্রভাব ফেলতে পারে।
সুইডেনেও পুলিশ ভেরিফিকেশন বা ব্যাকগ্রাউন্ড চেক সরকারি ও বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে একটি সাধারণ প্রক্রিয়া। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা বা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বৈষম্য করা সুইডেনের আইনি কাঠামোর অধীনে নিষিদ্ধ। এটি মানবাধিকার আইন এবং সমান অধিকার নীতিমালা দ্বারা সুরক্ষিত।
সুইডেনে কাউকে নিয়োগের ক্ষেত্রে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সমর্থন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বেআইনি। ডিসক্রিমিনেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিশ্বাস নিয়ে বৈষম্য করা যায় না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে কাউকে চাকরির জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হলে সেটি মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে।
যদি কোনো ব্যক্তির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, বা হিংসাত্মক আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে এবং এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। তবে সেই তথ্য পুলিশ ভেরিফিকেশনে উঠে আসতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে নিয়োগদাতারা প্রার্থীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণের মতো। বিশেষ করে একজন শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করার সময় থাকেই তার স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। অনেকেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক গৃহীত বিসিএস পরীক্ষার সবগুলো ধাপ অতিক্রম করে মেধা প্রমাণ করার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হন।
আবার অনেক সময় দেখা যায় যে, পিএসসি কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষায় শুধু মেধা প্রমাণ করলেই চাকরিতে যোগদান করা যায় না। পুলিশ ভেরিফিকেশন কিংবা বিশেষ তদন্ত সংস্থার ভেরিফিকেশনে ‘ক্লিন ইমেজ’ না পেয়ে যদি প্রার্থীর বিষয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য আসে তবে সেসব ক্ষেত্রে চাকরিতে নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি যে অনেক প্রার্থী পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও প্রজ্ঞাপনে তাদের নাম উঠেনি। পিএসসি কর্তৃক গৃহীত সব পরীক্ষায় তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করার পরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজানা কারণে তাদের নাম প্রজ্ঞাপনে না থাকার বিষয়টি দীর্ঘদিন চাকরি প্রার্থীদের শঙ্কার কারণ হিসেবে আমরা দেখেছি।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরি পাওয়া অনেকটা সোনার হরিণের মতো। বিশেষ করে একজন শিক্ষার্থী স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করার সময় থাকেই তার স্বপ্ন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। অনেকেই পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) কর্তৃক গৃহীত বিসিএস পরীক্ষার সবগুলো ধাপ অতিক্রম করে মেধা প্রমাণ করার মাধ্যমে বিসিএস ক্যাডার হন।
তবে এক্ষেত্রে কেউ যদি চাকরিবিধি ভঙ্গ করেন, তাহলে তার শাস্তি অবশ্যই বিধি মোতাবেক হওয়া উচিত। বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ১৯৭৯ সালের একটি আচরণ বিধিমালা রয়েছে। এর নাম সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯। যা পরবর্তীতে ২০০২ সালে এবং ২০১১ সালে দুই দফায় সংশোধিত হয়েছে। এই আচরণ বিধিমালায় মোট ৩৪টি নির্দেশনা আছে।
দেশে বা বিদেশে কারও কাছ থেকে উপহার বা পুরস্কার নেওয়া, যৌতুক দেওয়া-নেওয়া, ব্যক্তিগত ব্যবসা, রাজনীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী সহকর্মীর সঙ্গে আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে তার নির্দেশনা রয়েছে। শুধু নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধি নেই।
তবে নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে এমন একটি বিধি আছে ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালায়। সেখানে অসদাচরণের সংজ্ঞাও দেওয়া আছে। যেখানে অসদাচরণ বলতে বোঝানো হয়েছে—অসঙ্গত আচরণ, চাকরি-শৃঙ্খলা হানিকর আচরণ কিংবা শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণকে।
উল্লিখিত বিধানাবলী অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মচারী বা কর্মকর্তা অপরাধ করলে অবশ্যই তার শাস্তি অনিবার্য হওয়া উচিত। কিন্তু মেধা প্রমাণ করার পর, পিএসসি কর্তৃক সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর, কিংবা প্রজ্ঞাপন হওয়ার পর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো প্রার্থীকে পুনঃপ্রজ্ঞাপন তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার সংস্কৃতি এবং দৃষ্টান্ত ভয়াবহ এবং দুঃখজনক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
আর যদি সেটি কোনো রাজনৈতিক কারণে হয় সেটি নিশ্চয়ই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য বেমানান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মেধা অনুযায়ী সকলের চাকরিতে নিয়োগ লাভের সমান সুযোগ থাকা উচিত।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়