জাস্টিন ট্রুডোর বিদায় ও কানাডায় পরিবর্তনের হাওয়া
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর রাজনৈতিক উত্থানটা নাটকীয় হলেও বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। ১৯৭১ সালে যখন তার জন্ম হয়, তার বাবা পিয়েরে এলিয়েট ট্রুডো তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। পিতার রাজনীতির সুবাদে রাজনীতিতে জড়িত না হয়ে পেশা হিসেবে বেছে নেন স্কুল শিক্ষকতাকে।
২০০৮ সালে অনেকটা হঠাৎই রাজনীতির মঞ্চে তার পদার্পণ, তখন তার বয়স ৩৬ বছর, তবে তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে ২০০০ সালে, তার বাবার এক স্মরণসভায়, যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘এখানেই শেষ নয়’। এর কয়েকবছর পর একসময়ের প্রচণ্ড দাপটশালী লিবারেল পার্টির মধ্যে অন্তর্কোন্দল শুরু হলে দলটির প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব এসে পরে তার কাঁধে। তখন বয়স ৪১ বছর। মাত্র দুই বছরের মধ্যে সে সময়ের তৃতীয় অবস্থানে থাকা লিবারেল পার্টিকে টেনে তুলেন এক নম্বরে।
২০১৫ সালের নির্বাচনে কানাডা তথা সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে পরবর্তী নির্বাচনগুলোয়ও। জনগণ তার ওপর আস্থা রেখেছে বলে টানা তিনবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের মতো বিরল সুযোগ লাভ করেন।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অনেকটা অভ্যন্তরীণ এবং অনেকটা বৈশ্বিক রাজনৈতিক কারণে তার সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। ৯ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের এই সময়টাতে ট্রুডোকে অনেক ধরনের আভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন হতে হয়। একসময় দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থায় যারা তার দল এবং নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, সেই ভোটারদের একটা বড় অংশই মনে করেন যে ট্রুডো অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটাতে, বেকারত্ব দূর করতে এবং সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে এমন কিছু নতুন বিষয়ে করারোপ করেছেন, যা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে।
সেই সাথে প্রধান বিরোধী দল কনজারভেটিভ দল এধরনের বিষয়গুলো আরও উসকে দেয়। বিষয়টির সূচনা তার প্রথম মেয়াদে হলেও ২০১৯ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ক্ষুদ্র দলগুলোর সমর্থনে সরকার গঠন করতে তেমন অসুবিধা হয়নি। নিজের দলের অবস্থার উন্নতি হয়েছে ভেবে এবং দলকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সরকারে আনার প্রয়াসে ২০২১ সালে আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দেন। সে বছরও একই অবস্থা হয় এবং অনেকটা ভঙ্গুর অবস্থায় তাকে সরকার গঠন করতে হয়।
এর মধ্যে ২০১৬ সালে জাতীয় কার্বন কর্মসূচির আওতায় দেশের কর রেয়াত পাওয়া মানুষকে করের আওতায় আনা হলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে, যা আরও বৃদ্ধি পায় ২০১৭ সালে তার কিছু কেলেঙ্কারি, ২০১৮ সালে এক সাংবাদিকের সাথে অনৈতিক আচরণ, ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে নৈতিকতা বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদন, ২০২০ সালে করোনা মহামারি ঠেকাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ ইত্যাদি কারণে।
একসময় দেশের অর্থনীতির বেহাল অবস্থায় যারা তার দল এবং নেতৃত্বের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, সেই ভোটারদের একটা বড় অংশই মনে করেন যে ট্রুডো অর্থনৈতিক দৈন্যদশা কাটাতে, বেকারত্ব দূর করতে এবং সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে এমন কিছু নতুন বিষয়ে করারোপ করেছেন, যা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে।
মূলত ২০২১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই ট্রুডো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে সামনের দিনগুলোতে দলের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে এবং হয়তো সরকার গঠনের মতো অবস্থায় আর প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হবে না। কয়েকবছর ধরে অভিবাসন, জীবনযাত্রার ব্যয় এবং আবাসন সমস্যার মতো কিছু বিষয়ে সরব হয়ে ওঠেন বিরোধী রাজনৈতিক দল কনজারভেটিভ দল, সেই সাথে নিজ দলের ভেতর থেকেও সমালোচিত হতে থাকেন ট্রুডো।
কর কমানো, মূল্যস্ফীতি এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষাসহ কিছু প্রতিশ্রুতি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে কনজারভেটিভ দলের নেতা পিয়েরে পলিয়েভরের ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করছেন। ট্রুডোর সময়ে কানাডায় নিয়ন্ত্রণহীন অভিবাসন সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন রোধে ব্যর্থতা ইত্যাদি বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে।
এদিকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ঘোষণা দিয়েছেন, কানাডা থেকে আমেরিকায় বেআইনি অনুপ্রবেশ এবং মাদক প্রবেশ বন্ধ করা না হলে সে দেশ থেকা আসা পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ করারোপ করা হবে, যা কানাডার অর্থনীতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলতে পারে।
আরও পড়ুন
এ সবকিছু অনুধাবন করে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী এবং ট্রুডোর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ডিসেম্বরে পদত্যাগ করেন, যা ট্রুডোর পদত্যাগের ওপর এক বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। এদিকে আগামী অক্টোবর মাসে দেশটির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আছে, কিন্তু জনমত জরিপগুলো বলছে আসন্ন নির্বাচনে ট্রুডোর দলের জনপ্রিয়তা হ্রাস হয়ে মাত্র ২২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এমন অবস্থায় নির্বাচনের আগে তার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে মূলত নতুন নেতৃত্বের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির উন্নয়নের কিছুটা চেষ্টা করার একটা প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে এটিকে।
এখন দেখা যাক সামনের নির্বাচনে যদি কনজারভেটিভ দল বিজয়ী হয় এবং তাদের নেতা পিয়েরে পলিয়েভরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াতে পারে। তবে তার আগে এটাও দেখে নিতে হবে পলিয়েভরেরকে প্রধানমন্ত্রী হতে হলে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
আমরা জানি ট্রুডো পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের আগে এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে লিবারেল দলের পক্ষ থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়া হবে, যার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন অনেকেই। এদের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চারিত নামটি হচ্ছে সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড।
এই ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডই ডিসেম্বর মাসে ট্রুডোর নীতির বিরোধিতা করে সরে দাঁড়ান তার মন্ত্রিসভা থেকে। একসময়ের তুখোড় সাংবাদিক ক্রিস্টিয়া দীর্ঘদিন ট্রুডোর সাথে থাকলে অভিবাসন, অর্থনৈতিক নীতি এবং জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে ট্রুডোর নীতিকে সমালোচনা করে তার সাথে একমত হতে না পেরে পদত্যাগ করেন।
সেদিক থেকে বিবেচনা করলে মিস ফ্রিল্যান্ড যদি দলের নেতৃত্বে আসেন এবং অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তাহলে জনগণের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরে আসতে পারে। তবে করের বোঝা কমিয়ে কীভাবে সরকারি অর্থে জনগণের জন্য সেবামূলক খাতগুলো সচল রাখবেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন। সেদিক থেকে লিবারেল দলের পরিবর্তে বিকল্প পছন্দ হিসেবে এগিয়ে থাকবেন কনজারভেটিভ দলের পিয়েরে পলিয়েভরের।
মূলত ২০২১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই ট্রুডো অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে সামনের দিনগুলোতে দলের অবস্থা আরও খারাপ হতে পারে এবং হয়তো সরকার গঠনের মতো অবস্থায় আর প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব হবে না।
পিয়েরে পলিয়েভরের যদি দায়িত্ব নেন, তাহলে তার শাসনকালে এমন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সফল হতে হবে, যা ট্রুডো পারেননি। সত্যি বলতে, এক্ষেত্রে তিনি সাময়িক সফল হলেও এই সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখা খুব একটা সহজ বিষয় নয়। ট্রুডো মূলত বিশাল আকারের কানাডার জন্য অভিবাসনের মতো বিষয়ে উদার হয়েছেন বটে, তবে দিনশেষে বিষয়টি তার জন্য হিতে বিপরীত হয়েছে।
তিনি জলবায়ু পরিবর্তন এবং শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলার মতো বিষয়গুলোতে উদারতা প্রদর্শন করলেও বিষয়গুলো নিজ দেশের ভেতর একটা সময়ে এসে খুব একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। এক্ষেত্রে রক্ষণশীল দলকে সত্যিকারের রক্ষণশীলতার পরিচয় দিতে হবে, যা একটা পর্যায়ে কানাডার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করতে পারে।
সবকিছু মিলিয়ে ১১ বছর সময় ধরে দলের নেতৃত্ব এবং ৯ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বের অবসান হতে গেলেও কানাডার মত বিশাল রাষ্ট্র পরিচালনায় ট্রুডোকে খুব একটা ব্যর্থ বলা যাবে না, কেননা সমস্যাগুলো মোকাবিলা যেকোনো নেতৃত্বের জন্যই কঠিন। বিষয়টি কেবল পরিবর্তন, যার একটা হাওয়া বইছে বেশ কিছুদিন ধরে।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়