২০২৫ সালের যোগাযোগ ব্যবস্থা : গতানুগতিক নাকি আদর্শিক?
সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পঙ্গু হয়েছে এর কয়েকগুণ বেশি মানুষ। পঙ্গপালের মতো বিপদজনক যান যেমন ব্যাটারি রিকশা, নছিমন, করিমন ইত্যাদিকে নামানো হয়েছে সড়কে। বাসের মতো ক্যাপাবল একটি পরিবহন ব্যবস্থাকে দমিয়ে রেখে ইচ্ছামতো মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ইত্যাদি ছোটবাহনকে রাস্তায় সুযোগ দেওয়াসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও অনেক অনিয়ম আর চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে ২০২৪ সালের শেষ দিনটাও চলে গেল।
আমরা ৩১ ডিসেম্বর রাতে পুলিশের সব নিষেধ, অনুরোধ বা নির্দেশনা উপেক্ষা করে ইচ্ছামতো আতশবাজি ফাটিয়ে গতানুগতিক প্রক্রিয়ায় নতুন বছর ‘২০২৫’-কে বরণ করলাম।
বিদায়ী বছরে সড়ক খাতে ভালো কিছু যে একেবারেই হয়নি তা বলছি না, যেমন সারা বছর আমরা পদ্মা সেতুর সুবিধা পেয়েছি। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেকগুলো সড়ক ও সেতু নির্মাণ/প্রশস্তকরণ হওয়ায় তার সুবিধাও মানুষ পেয়েছে।
বিশেষ করে ২০২৪ সালে দুটি ঈদে সড়ক ব্যবস্থাপনার কারণে মহাসড়কে যানজট সমস্যা অনেকটুকুই নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছিল। নতুন বছর যোগাযোগ ব্যবস্থায় মনে রাখার মতো কিছু করা যায় কিনা তা ভাবার এখনই সময়। তাই ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমার কাছে সম্ভাবনার চেয়ে, সদ্য ভূমিষ্ঠ এই বছরকে যোগাযোগ খাতে অনেক চড়াই উতরাই পাড়ি দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।
২০২৫ সাল আস্তে আস্তে কৈশোর, যৌবন পাড়ি দিয়ে বুড়িয়ে গিয়ে শেষ হবে নিশ্চিত। তাই এই সদ্য ভূমিষ্ঠ বছরকে যোগাযোগ খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতার জন্য কিছু বিষয়ে নিয়ে কাজ করা যেতে পারে।
প্রথমত, আমাদের প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সব স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে সমন্বয়। অদ্যাবধি সমন্বয় বলতে যা ছিল তা হচ্ছে বছরে কয়েকটি মিটিং-এ সব স্টেক হোল্ডারদের মধ্যে ১ জন প্রতিনিধি নিয়ে কিছু সময় আলোচনা করা আর তার চেয়ে দ্রুত তা ভুলে যাওয়া।
....মানসম্মত বলতে এমন ব্যবস্থা যেখানে অল্প কয়েকটি রুটকে নিয়ে ওই রুটে চলাচলকারী ও আগ্রহী ছোট-বড় কোম্পানিগুলো একসাথে এক ছাতার নিচে থাকবে, চালকের বেতন কাঠামো থাকবে, সম্ভব হলে একটা আলাদা লেন প্রদান করা হবে।
একটি কার্যকর সমন্বয় বলতে বোঝায় প্রত্যেক স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে একটি ফর্মাল Terms of Reference (TOR) থাকবে যার মধ্যে প্রত্যেকের আলাদা কর্মপরিকল্পনা থাকবে, যা একটি ব্যাপক-অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্ম পদ্ধতির মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে এবং সবশেষে সবার মিলিত কার্যক্রমে নির্দিষ্ট সময়ে একটি সর্বজনীন লক্ষ্য বাস্তবায়িত হবে।
আমাদের সিস্টেমে সমন্বয় করার একটি বড় বাধা হলো স্টেক হোল্ডাররা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে যার ফলে তাদের কর্মপরিকল্পনা আলাদা, উদ্দেশ্য, সময়সীমা ও লক্ষ্য আলাদা। ফলে প্রায়শই অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা আলাদা কর্মপদ্ধতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক না হওয়াতে একটি কাজ বারবার করতে হয় যার ফলে সবসময় আমরা শূন্য থেকেই শুরু করি। তাই যোগাযোগ খাতে একটি টেকসই সমন্বয় করা খুব প্রয়োজন।
এ পর্যন্ত আমার জানামতে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরে সড়ক নিরাপত্তায় সমন্বিত কাজ করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) এর মধ্যে একটি সমঝোতা সাক্ষর হয়েছে এবং সে আলোকে ২টি সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। একে একটি উদাহরণ ধরে আরও বড় পরিসরে, বিভিন্ন শহরে বা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় পরিকল্পনা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, সমন্বয় করার জন্য কোনো অর্থের প্রয়োজন নেই, দরকার সদিচ্ছা ও বহুদূর দেখার ক্ষমতা।
দ্বিতীয়ত, বহুল আকাঙ্ক্ষিত এবং চর্চিত কিন্তু অদ্যাবধি নাগালে না পাওয়া ‘বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজি’ সিস্টেম এ বছর মানসন্মতভাবে চালু করার লক্ষ্য নেওয়া উচিত।
আরও পড়ুন
মানসম্মত বলতে এমন ব্যবস্থা যেখানে অল্প কয়েকটি রুটকে নিয়ে ওই রুটে চলাচলকারী ও আগ্রহী ছোট-বড় কোম্পানিগুলো একসাথে এক ছাতার নিচে থাকবে, চালকের বেতন কাঠামো থাকবে, সম্ভব হলে একটা আলাদা লেন প্রদান করা হবে, যাত্রী সেবার সব উপকরণ স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ পরিকল্পনা করা হবে এবং কঠোর মনিটরিং করার ব্যবস্থা থাকবে। যেহেতু ইতিমধ্যে এ সিস্টেমের অনেকটুকুই হোমওয়ার্ক করা হয়েছে তাই ২০২৫ সালে এর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ নেওয়া যেতেই পারে।
তৃতীয়ত, যানজট নিরসন হবে বা কমিয়ে আনা যাবে এ ধরনের কথায় খুব একটা আশাবাদী না হলেও চাইলে এ বছর কিছু উদ্যোগ নিয়ে তা সহনীয় করে ভবিষ্যতে যানজটে টোটাল শাট ডাউন হয়ে রাস্তায় বসে থাকার সম্ভাবনা কমানো যায়। কিছু উদ্যোগকে এ বছর প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে যেমন রিকশাকে এলাকাভিত্তিক করা, রিকশার একটি নিরাপদ ডিজাইন করে নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশাকে কিছু কিছু মূল সড়কে চলতে দেওয়া যেতে পারে।
এছাড়া মেট্রোরেলের রুট বাড়িয়ে তার সাথে বাস রুটের সমন্বয় করা, ছোট গাড়িকে বিশেষ করে প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল ক্রয় বিক্রয়কে নিয়ন্ত্রিত করার কিছু পদক্ষেপ এ বছর নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি অন্তত ২০ কিমি ফুটপাত যা এখন হকারদের দখলে আছে তা পথচারীদের ফিরিয়ে দিয়ে আর ২০ কিমি রাস্তাকে সাইকেলবান্ধব করে তা সারা বছর সাইকেলের জন্যই নিশ্চিত করা গেলে ২০২৫ সালে শুধু স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাই নয় বরং একটি রেফারেন্স বছর হয়ে থাকবে।
...কিছু উদ্যোগকে এ বছর প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে যেমন রিকশাকে এলাকাভিত্তিক করা, রিকশার একটি নিরাপদ ডিজাইন করে নির্দিষ্ট সংখ্যক রিকশাকে কিছু কিছু মূল সড়কে চলতে দেওয়া যেতে পারে।
চতুর্থত, চাইলে ২০২৫ সালকে আমরা সচেতন সড়ক ব্যবহারকারী তৈরির বছর হিসেবে গ্রহণ করতে পারি আর তার জন্য প্রয়োজন সড়ক নিরাপত্তায় শিক্ষার্থীদের সচেতন করা ও সড়কের আচরণবিধি জানানো ও তা অভ্যাসে পরিণত করার জন্য নিয়মিত স্কুল প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া যেতে পারে।
আমি প্রায়শই দেখি, ছোট শিশুরা তার হাতের চিপসের খালি প্যাকেট রাস্তায় না ফেলে হাতে নিয়ে ঘুরছে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলবে বলে। তারা যা শিখবে সেভাবেই আচরণ করবে। তাই আমি বিশ্বাস করি, আমরা বড়রা যদি তাদের সড়কের আচরণ, চলাচলের নিয়ম জানাতে পারি তারা আজীবন তা মেনে চলবে।
তবে শিশুরা যেন হাতের কাছে ময়লা ফেলার জায়গা খুঁজে পায় তা নিশ্চিত করা যেমন আমাদের দায়িত্ব তেমনি করে নিরাপদে সড়ক ব্যবহারের সব ইন্সফ্রাস্ট্রাকচার যেন তারা দেখতে পায় সেটাও আমাদের দায়িত্ব। যেহেতু ২০৩০ সালের মধ্যে ‘Sustainable Development Goals (SDG)’ এর লক্ষ্য ‘৩.৬’ আর ‘১১.২’ আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে, তাই এ বছরকে প্রস্তুতিকাল হিসেবে নেওয়ার সুযোগ হারানো উচিত হবে না।
আমাদের জীবনের যেমন শিশু, কৈশোর, যৌবন আর বার্ধক্য মিলিয়ে ৪টা অধ্যায় থাকে তেমনি ২০২৫ সালকে ৪টা অধ্যায়ে ভাগ করে চাইলেই এই ৪টি কাজের মাধ্যমে আমরা অমরত্ব দিতে পারি। আশা করছি, ২০২৫ সাল গতানুগতিক না হয়ে অমরত্ব লাভ করুক আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায়।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট