বাংলাদেশের অর্থনীতি : ২০২৫ সালের গতি-প্রকৃতি
বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সবকিছু দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলে দিয়েছিল। তা পেরিয়ে বর্তমানে অর্থনৈতিক সমস্যার মূল কারণ ঐতিহাসিক এবং অভ্যন্তরীণ।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকট, খেলাপি এবং কু-ঋণ, অর্থ পাচার, অর্থনীতিতে ব্যাপ্ত অনাচার, দুর্নীতি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। বিত্তশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নানা অনিয়মতান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান, নানা অর্থনৈতিক অনাচারের মাধ্যমে সমাজে বিশাল অসমতা ও বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি জনজীবনকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। নতুন কর্মসংস্থানের চিত্র নয় আশাব্যঞ্জক। শিল্পখাতে উৎপাদন এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। পোশাক-শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কিছুদিন আগে দেশের বিরাট অঞ্চলে বন্যার কারণে নতুন নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
তবে এটা সত্য যে, ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নানান ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কিছু কিছু উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন বাইরে থেকে আসা অর্থের প্রবাহ বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের উন্নতি হয়েছে, সম্পদ পাচার আটকানো গেছে।
ব্যাংকিং খাতে যেসব ব্যাংক ভেঙে পড়েছে, তাদের পুনর্গঠনে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদগুলো পুর্নবিন্যস্ত করা হয়েছে। ২০২৪-এর প্রান্তে এসে বাংলাদেশ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে কেমন হবে ২০২৫ এর বাংলাদেশ অর্থনীতির গতি প্রকৃতি।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নানান ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কিছু কিছু উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন বাইরে থেকে আসা অর্থের প্রবাহ বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের উন্নতি হয়েছে, সম্পদ পাচার আটকানো গেছে।
পেছনের দিকে যখন তাকাই, তখন দেখতে পাই যে, ২০২৩ এর অর্থনৈতিক সংকটগুলো ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পরেও স্থির ছিল এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে এসব সংকটগুলো আরও গভীর হতে পারে।
২০২৫ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি মোটাদাগে দুটো প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হবে। তার একটি হচ্ছে ২০২৫ সালের বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবণতা এবং অন্যটি হচ্ছে দেশজ অর্থনীতির গতিময় পরিস্থিতি। সামনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, ২০২৫ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতির তিনটি ধারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—
১। বর্ধিত অসমতা ২০২৫ সালের বিশ্বে এক গভীরতর অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হবে। অসমতা আরও বাড়বে দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে, অঞ্চলে-অঞ্চলে, গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে, মানুষে-মানুষে। আগামী দিনগুলোতো এ অসমতা, বৈষম্য আরও বাড়লে তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশেও।
২। সংঘাত ও সন্ত্রাস আজকের বিশ্বের ব্যতিক্রম হওয়ার পরিবর্তে নিয়মে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্যালেস্টাইনের ওপর ইসরায়েলি নগ্ন আক্রমণই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে, ইয়েমেনে নতুন করে সংঘাত দেখা দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক অস্থিরতা আরও বাড়বে। এ সবকিছু থেকে বাংলাদেশ নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
৩। অস্থিরতা বাড়তে পারে অর্থনৈতিক অঙ্গনেও। বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি কমে আসলেও, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে পারে। বিশ্বের নানান দেশে, বিশেষত উন্নত বিশ্বে এক ধরনের ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা আগামী দিনগুলোতে আরও জোরদার হতে পারে।
আরও পড়ুন
উন্নত বিশ্ব ক্রমে ক্রমে অন্তর্মুখী নীতিমালার প্রতি ঝুঁকবে, অভিবাসন এবং শরণার্থীদের প্রতি বিরূপ মনোভাব থাকবে এসব দেশের এবং সেই সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় উন্নত দেশগুলো পর্যাপ্ত অর্থায়ন করবে না। ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সংকট আরও ঘনীভূত হবে। এ জাতীয় অস্থিরতা বাংলাদেশকেও প্রভাবিত করবে।
দেশীয় অঙ্গনে মূল্যস্ফীতি একটি প্রধানতম সংকটরূপে বিরাজ করবে। নানান রকম রক্ষণশীল মুদ্রানীতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু করে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। স্থানীয় অর্থনীতিতে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয় এবং আমদানি করা পণ্যসামগ্রীর মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। টানা আট মাস খাদ্যসামগ্রীর দাম ছিল দুই অঙ্কের ঘরে। সরকার বলছেন যে, ২০২৫ এর জুন নাগাদ মূল্যস্ফীতিকে ৭ শতাংশ নামিয়ে আনা হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রাভান্ডার অবশ্য বলছেন যে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরেই থাকবে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের যাপিত জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে যে, দুই বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ৭৮ লাখ মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গছে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ আমিষের ভোগ কমিয়ে দিয়ে ভাতের মতো শর্করার ওপরে বেশি নির্ভর করছে। ৩৪ মাসে মজুরির প্রবৃদ্ধি মূল্যস্ফীতির চেয়ে কম ছিল। ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ক্ষয়িষ্ণু ছিল। ২০২৫ সালে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান থাকলে এইসব প্রবণতা আরও সংকটময় হতে পারে।
সঙ্গত কারণেই, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে এসেছিল। অনেকেই বলছেন যে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনো তার আগের পর্যায়ে যেতে পারেনি। তেমনিভাবে, পোশাক শিল্পখাতের উৎপাদন এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অন্যান্য শিল্পখাতেও উৎপাদন হ্রাস এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এ সবকিছু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষয় করেছে।
এর ফলে সংশ্লিষ্ট সব মহল মনে করছেন যে, ২০২৫ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বড় জোর ৪ শতাংশের মতো হতে পারে। শ্লথ শিল্পখাত প্রবৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। জনসাধারণের সংকুচিত ক্রয়ক্ষমতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং শ্লথ রপ্তানি এর অন্যতম কারণ। সেই সঙ্গে ডলারের তুলনায় টাকা দুর্বল হয়ে যাওয়ার কারণে শিল্পখাতের কাঁচামাল এবং যন্ত্রাংশ আমদানি দুরূহ হয়ে পড়বে।
কৃষিখাতও নানান রকমের সমস্যার মধ্যে আছে। এই খাত কয়েক মাস আগের বন্যার ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেই সঙ্গে যদি কৃষকের কাছে বীজ, সার, সেচ এবং কৃষিঋণ সহজলভ্য না করে দেওয়া যায়, তবে কৃষিখাতও স্থবির হয়ে যাবে। সবটা মিলিয়ে ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চালচিত্রটি খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।
ব্যাংকিং খাতে নানান ব্যবস্থা সত্ত্বেও এই খাত এখনো অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। এই খাতে কিছুদিন আগেও অকার্যকর ঋণের অংশ মোট ঋণে (১৭ লাখ কোটি টাকার) ১৭ শতাংশ ছিল কয়েক বছরের মধ্যে উচ্চতম। দেশের মধ্যে যেসব বড় বড় গোষ্ঠী ঋণ খেলাপি, তাদের কাছ থেকে কতটা খেলাপি ঋণ আদায় করা যাবে, সে ব্যাপারেও সন্দেহ আছে।
২০২৫ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত করতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় নীতিমালা লাগবে, তেমনি অর্থনৈতিক সংস্কারও প্রয়োজন হবে...
মোট ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যে কোটি কোটি টাকা বাইরে পাচার হয়ে গেছে, সেগুলো ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা নিতান্তই ক্ষীণ। সুতরাং ২০২৫ সালে ব্যাংকখাতে জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাসের জায়গাটি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে, সে আশাটি প্রশ্নবিদ্ধ।
বেসরকারি বিনিয়োগ কিংবা বৈদেশিক বিনিয়োগের চিত্রটি খুব আশাব্যঞ্জক নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, উচ্চ সুদের হার এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বেসরকারি খাতে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ আসছে না। সেই সঙ্গে আমদানিকৃত যন্ত্রাংশের উচ্চমূল্য এবং বেসরকারি খাত ঋণলভ্যতাও বেসরকারি বিনিয়োগকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং শ্রমিক সমস্যা বিদেশি বিনিয়োগকে প্রতিহত করছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রপ্তানি বাণিজ্য প্রত্যাশিতভাবে বাড়ছে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ওপরে একটা চাপ আছে। তবে এতসব সংকটের মধ্যেও কিছু কিছু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। প্রবাসী শ্রমিকদের প্রেরিত অর্থের পরিমাণ ঊর্ধ্বমুখী। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের মধ্যে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আসছে।
২০২৫ সালের বাংলাদেশ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত করতে হলে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় নীতিমালা লাগবে, তেমনি অর্থনৈতিক সংস্কারও প্রয়োজন হবে এবং সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, পুরো ব্যাপারটির একটি রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষিত রয়েছে। সুতরাং ২০২৫ সালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র