স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা রুখবে কে?
পিসিআর টেস্টের অভাবে করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে না, একইভাবে স্বাস্থ্য খাতের মৃদু সংক্রমণ (দুর্নীতি) যা এতদিন শনাক্তের বাইরে ছিল, করোনা পরিস্থিতিতে তা পরিপূর্ণ উপসর্গ নিয়ে হাজির। শুধু তাই নয় সাম্প্রতিক ঘটনা স্বাস্থ্য খাতের এই দুর্নীতি আজ বিশ্বের মিডিয়ায় আলোচিত। কিন্তু সরকারের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ খাতটি বরাবরই দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চলতি বাজেটে এডিপির মাত্র ২৫ শতাংশ প্রথম নয় মাসে খরচ করতে পেরেছে! যা বড় মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম। শুধু তাই না করোনার জন্য বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ যা মূলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে করোনা মোকাবিলার উপযোগী করে তোলার জন্য এসেছিল তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাস্থ্য খাতের এই অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারেরই দুই মন্ত্রণালয় উষ্মা প্রকাশ করেছে।
করোনা কালে ও তার আগে এই মন্ত্রণালয়ে গাড়িচালক আব্দুল মালেকের দুর্নীতি, সাবরিনা-শাহেদ কাণ্ড, নিম্নমানের পিপিই-মাস্ক সরবরাহ, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভাগবাটোয়ারাসহ নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাত অর্থ ব্যয়ে অদক্ষতা দেখালেও, সিন্ডিকেট, পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা বহির্ভূত কেনাকাটার মাধ্যমে দুর্নীতির কারণে অনেকবার শিরোনাম হয়েছে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে এসেছে, স্বাস্থ্য খাতে ৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়মের খবর।
করোনার জন্য বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে প্রাপ্ত বরাদ্দ যা মূলত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে করোনা মোকাবেলার উপযোগী করে তোলার জন্য এসেছিল তাও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
একটার পর একটা ঘটনার জন্ম দিয়েও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কাঙ্ক্ষিত ব্যয়টা করতে পারল না। প্রশ্ন উঠতেই পারে, দুর্নীতি করার ইচ্ছে থাকলে তো যা বরাদ্দ থাকে তা সবই খরচ করা উচিত। এই খরচ করতে না পারার মূল কারণ হলো স্বাস্থ্য বিভাগে দক্ষ লোকবলের অভাব এবং কিছু খাতের প্রতি অতি আগ্রহ। যেমন যন্ত্রপাতি ক্রয়, স্থাপনা নির্মাণে যতটা উৎসাহ দেখা যায়, তা মেরামত করে কার্যকর রাখার ব্যাপারে সেই পরিমাণ উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না।
রাজনৈতিক শক্তি, ব্যবসায়িক দল ও প্রশাসনের একটা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এই কার্য পরিচালনা করছে বলে অনেকের অভিযোগ রয়েছে। আর এই একই কারণে খরচ বেশি হলেও তা স্বাস্থ্য খাতের সেবার মান বৃদ্ধিতে কতটা সহযোগিতা করবে সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। তাই স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির জন্য এই অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি দূর করা অত্যাবশ্যক। অব্যবস্থাপনার মূলে রয়েছে সঠিক জায়গায় সঠিক লোক নিয়োগ করতে না পারা।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনেক জটিল। এই বিভাগ পরিচালনার জন্য যেমন স্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান থাকা আবশ্যক একই সাথে প্রশাসনিক দক্ষতাও প্রয়োজন। কিন্তু উচ্চপদগুলোতে যারা আসীন খুব কম লোকই এই দুই গুণের অধিকারী। দেখা যায় মেডিকেল কলেজের একজন অধ্যাপককে উচ্চপদে আনা হয় যার প্রশাসনিক জ্ঞান থাকে সীমিত অথবা প্রশাসনের একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয় যার স্বাস্থ্য বিষয়ে জ্ঞান সীমিত। যার ফলে কর্তা ব্যক্তিরা বিদ্যমান জনবলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং চলমান অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান থাকে। তাই যাদের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকে, জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্য অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা থাকে তাদেরকেই কেবল উচ্চপদে পদায়ন করা যেতে পারে। দরকার হলে তাদেরকে আগে এই বিষয়ে ট্রেনিংও দেওয়া যেতে পারে।
দুর্নীতি সবদেশে কম-বেশি থাকলেও দুর্নীতি দূরীকরণের একক কোনো পন্থা নেই। একেক দেশ একেকভাবে দুর্নীতি-দমনে সফল হয়েছে। বিভিন্ন দেশের আলোকে কিছু সুপারিশ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি সাধারণত ক্রয়-সংক্রান্ত বিষয়ে বেশি হয়ে থাকে। তাই এটা বলাই যায় যে, বর্তমান ক্রয়-সংক্রান্ত নীতিমালায় একটা দুর্বলতা রয়েছে যার ফাঁকফোকর দিয়ে এই মহাযজ্ঞ চালানো হয়। তাই ক্রয় প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা অতীব জরুরি।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি সাধারণত ক্রয়-সংক্রান্ত বিষয়ে বেশি হয়ে থাকে। তাই এটা বলাই যায় যে, বর্তমান ক্রয়-সংক্রান্ত নীতিমালায় একটা দুর্বলতা রয়েছে যার ফাঁকফোকর দিয়ে এই মহাযজ্ঞ চালানো হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সরকারি-অর্থ ব্যবস্থাপনা সংস্কার করে দুর্নীতি কমাতে সফল হয়েছে। একই সাথে স্বায়ত্তশাসিত স্পেশাল নিরীক্ষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেও ক্রয়সংক্রান্ত দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা কমাতে সফল হয়েছে। আমাদের দেশে যে নিরীক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান তারা নিজেরাই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত বলে অভিযোগ রয়েছে। আর বিদ্যমান নিরীক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতির লাগাম ধরা সম্ভব নয়।
তাছাড়া তথ্য প্রবাহ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে সেগুলো বাদে সকল তথ্য সহজলভ্য করা একান্ত জরুরি। যেমন এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যখন কোন খাতে কত বরাদ্দ এবং একদম নিচ থেকে উপর পর্যন্ত বিস্তারিত খরচের হিসেব সহজলভ্য করা হয়, তখন দুর্নীতি করা কঠিন হয়ে যায়।
বিশ্বের কোনো দেশই রাঘববোয়াল না ধরে দুর্নীতি দমনে সফল হয়নি। উদাহরণ হিসেবে জর্জিয়ার কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। জর্জিয়া একসময় অতি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তারা দুর্নীতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনতে সফল হয়। অভিযান শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় ১০০০ জন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে বিচারের আওতায় আনে। এতে অন্যরাও সাবধান হয়ে যায়।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা মনে হয় তার উল্টোদিকে যাচ্ছি। সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে অনুমোদনের প্রয়োজনীয়তা এবং কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা মূলত দুর্নীতি দমনের চেয়ে দুর্নীতির জন্য প্রণোদনা দেওয়ারই সামিল।
একদিকে যেমন দুর্নীতিবাজদের কাঠগড়ায় আনতে হবে একই সাথে যারা সৎ ও নিষ্ঠাবান ব্যক্তি রয়েছেন তাদেরকে পুরস্কৃত করাও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীর দেশে বিদেশে সম্পদের হিসেবে নিয়মিত দেওয়া বাধ্যতামূলক করা উচিৎ। এটা সরকারের সকল বিভাগের জন্যই প্রযোজ্য, তবে এই ব্যবস্থা স্বাস্থ্য বিভাগ দিয়েই শুরু হতে পারে।
সর্বশেষে এমআইটির এক অধ্যাপকের উক্তিটি স্মরণ করতে চাই, ‘দুর্নীতি কোনো রোগ নয়, বরং উপসর্গ’। তাই রোগ সারাতে হলে রোগের কারণ জানা জরুরি। আইনের শাসনের অভাব, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অভাব ও দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে বিদ্যমান সেসব দেশে দুর্নীতি কমানোর ইতিহাস নেই কারণ সেক্ষেত্রে সরকারের অন্যান্য অঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে দুর্নীতি দমনও সফল হয় না।
ড. শাফিউন নাহিন শিমুল ।। সহযোগী অধ্যাপক, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়