নতুন বছরে শিক্ষা ভাবনা
স্বাগত ২০২৫। আরও একটি নতুন বছরের শুরু। প্রতিটি দিনই আমাদের জন্য হয়ে উঠুক আনন্দময় এই প্রত্যাশা। মানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদার অন্যতম প্রধান চাহিদা হলো শিক্ষা। তা নিয়ে নতুন ভাবনা, নতুন স্বপ্ন বুনতে চাই আমরা।
শিক্ষা সবসময় মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে ধাবিত করে। শিক্ষা মানুষের জন্য সুযোগ নয় বরং একজন মানুষের অধিকার আর রাষ্ট্র ও সংবিধান স্বীকৃত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ১৭ নং অনুচ্ছেদে এই ব্যাপারে সুস্পষ্টভাবে বলা রয়েছে এবং আরও বলা রয়েছে রাষ্ট্র তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্র কর্তৃক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইনসহ বেশকিছু আইন ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০সহ বেশকিছু সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারিত রয়েছে।
ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে শিক্ষার মোট ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করে পরিবার। পাকিস্তানে যা ৫৭ শতাংশ। ভারতে আর্থিক দিক থেকে ভালো অবস্থানে থাকা ২০ শতাংশ পরিবার, খারাপ অবস্থায় থাকা ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় সরকারি, বেসরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং অনুদানবিহীন সব রকম স্কুলে প্রায় চারগুণ বেশি ব্যয় করে।
আবার আমরা যদি জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ২০১৮-এর মধ্যে ১:৩০-এ পৌঁছানোর কথা থাকলেও ২০২৪ সাল পর্যন্ত নিচে নামেনি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতনের পরিমাণের দিক থেকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৫তম আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম।
আবার দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ; দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত; তৃতীয় অবস্থানে ভুটান; চতুর্থ অবস্থানে নেপাল। তবে বাংলাদেশে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে এমপিও বহির্ভূত বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো এবং এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিও বহির্ভূত শিক্ষকরা।
আবার দক্ষিণ এশিয়ার আট দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে মালদ্বীপ; দ্বিতীয় অবস্থানে ভারত; তৃতীয় অবস্থানে ভুটান; চতুর্থ অবস্থানে নেপাল।
আর্থিক সুবিধার দিক থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে থাকলেও সত্যিকারভাবে ভালো অবস্থায় নেই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বিশ্বব্যাংক ও ইউনেস্কোর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সবসময় প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়ে আসছে সেই সাথে অন্যান্য স্তরকেও সমান গুরুত্ব প্রদান করার কথাও বলেছে।
শিক্ষা খাতের নানা অংশীজনের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান অংশীজন হলো শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর পাশাপাশি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিভাবক, সমাজের মানুষ এবং রাষ্ট্র সবাই শিক্ষাখাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন। তবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী শ্রেণি কার্যক্রমের মাধ্যমে পুরো সিস্টেমটিকে সচল রাখতে মুখ্য ভূমিকা এবং অন্যান্য অংশীজন সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।
এতকিছু বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের শিক্ষা নিয়ে নতুন দিনে ভাবতে হলে উপরের বিষয়গুলো কোনোভাবেই বাদ নিয়ে বরং সুবিবেচনায় রেখে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হাবে। পুরোনোকে ফেলে আগামীর জন্য ২০২৫ সালের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এগিয়ে যেতে প্রয়োজন প্রয়োজনীয় সংস্কার আর পরিমার্জনের। আর এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন শিক্ষার গুণগত আর পরিমাণগত মান উন্নয়নের।
আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে প্রযুক্তি নির্ভর, শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষাকার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। যার অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে শিক্ষকদের মান উন্নয়ন যেখানে শিক্ষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, গবেষণা সহায়তা এবং তাদের প্রয়োজনীয় মানসম্মত বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা।
আরও পড়ুন
শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকারী শিক্ষকের মতামতের প্রতি কার্যকর গুরুত্ব দিয়ে তার আর্থ-সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিতে বিশ্বব্যাপী শিক্ষায় একটি নতুন সামাজিক চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ ও আহ্বান নিয়ে ২০২৪-এ পালিত বিশ্বশিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভ্যালুইং টিচার ভয়েসেজ : টুয়ার্ডস এ নিউ সোশ্যাল কনট্রাক্ট ফর এডুকেশন’।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়—করোনা মহামারিসহ নানা সংকটেও এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, অনুকূল পরিবেশ এবং স্বায়ত্তশাসন পেলে শিক্ষকরা শিক্ষায় যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং এমন সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারেন, যা শিক্ষা ও শিক্ষার্থীর উন্নয়ন নিশ্চিত করে।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, শিক্ষকরা শিক্ষার বিষয়গুলো আয়ত্ত করে পাঠক্রমের বিষয়বস্তুকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করেন, সাধ্যমতো শ্রেণিকক্ষে সব ধরনের শিক্ষার্থীর দিকে মনোযোগ দেন এবং শ্রেণিকক্ষে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণে সচেষ্ট থাকেন।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় অর্জন, অগ্রগতি সাধন ও তাদের ভবিষ্যৎ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে যথাযথ ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও তাদের সৃজনশীলতা ও সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কথা বা পরামর্শ যথাযথভাবে বিবেচিত হয় না। শিক্ষকতা পেশাকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় তাদের কণ্ঠস্বর খুব কমই শোনা যায় বা মতপ্রকাশ করতে তাদের খুব একটা উৎসাহ দেওয়া হয় না।
যদিও শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাসংক্রান্ত যেকোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধির অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। আরও কিছু বিষয় নিয়ে আমরা নতুন করে ভাবতে তথা চলমান রাখতে পারি।
ডিজিটাল শিক্ষার সম্প্রসারণ ও হাইব্রিড লার্নিং মডেল—প্রযুক্তি ব্যবহার আরও বিস্তৃত করতে হবে, যেমন ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ভার্চুয়াল ক্লাসরুম এবং অ্যাডাপটিভ লার্নিং টুলস। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অনলাইন শিক্ষা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৫ সালে এটি আরও উন্নত এবং আধুনিক প্রযুক্তির সাথে একীভূত করা প্রয়োজন হবে। একইসাথে ফিজিক্যাল ক্লাসরুম এবং ডিজিটাল ক্লাসরুমের সমন্বয় ঘটানোর মাধ্যমে হাইব্রিড লার্নিং মডেল শিক্ষার্থীদের জন্য আরও নমনীয়তা এবং সুবিধা নিশ্চিত করবে।
মানুষ প্রতিনিয়ত শেখে, এক সময় মাইলের পর মাইল হেঁটে জ্ঞান অর্জন করেছে। এখন ঘরে বসেই ইউটিউব, গুগলে সার্চ দিলেই পৃথিবীর সব তথ্য বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারপরেও এগুলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হয়নি।
কাস্টমাইজড ও স্কিলভিত্তিক শিক্ষা—শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করার পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই এবং ডেটা অ্যানালিটিক্স ব্যবহার করে প্রতিটি শিক্ষার্থীর শক্তি, দুর্বলতা এবং আগ্রহ বুঝে তাদের জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রম তৈরি করা হতে পারে। সেইসাথে আধুনিক কর্মক্ষেত্রে সফল হতে তত্ত্বগত শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং স্কিল অর্জনেও গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ফলশ্রুতিতে পেশাদার স্কিল, সফট স্কিল এবং টেকনিক্যাল স্কিলের ওপর গুরুত্ব বাড়বে।
মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামাজিক দক্ষতা—শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক দক্ষতার উন্নয়নের ওপর অধিক মনোযোগ দিতে হবে, কারণ এসব দক্ষতা আধুনিক জীবনে অপরিহার্য। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও সামাজিক দক্ষতা নিশ্চিত ব্যতিরেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া খানিকটা দুষ্কর।
বিশ্ববিদ্যালয় ও চাকরি সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে বিভিন্ন শিল্পের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা কর্মমুখী প্রশিক্ষণ এবং ইন্টার্নশিপ সুবিধা পায়। এরাই পরবর্তীতে দক্ষ ও কর্মঠ মানবসম্পদ হিসেবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর প্রদান ও শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
মানুষ প্রতিনিয়ত শেখে, এক সময় মাইলের পর মাইল হেঁটে জ্ঞান অর্জন করেছে। এখন ঘরে বসেই ইউটিউব, গুগলে সার্চ দিলেই পৃথিবীর সব তথ্য বেরিয়ে আসে। কিন্তু তারপরেও এগুলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প হয়নি।
‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র / নানানভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র’। কবি সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতাটিতে কবির মনে হয়েছে এই গোটা পৃথিবী একটি পাঠশালা আর কবি সেখানে একজন ছাত্র। যিনি দিনরাত ধরে এই বিশ্ব প্রকৃতির কাছ থেকে নতুন নতুন জিনিস শিখছেন।
ব্র্যাকের শিক্ষা গবেষক সমীর রঞ্জন নাথ বলেন, ‘প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী এবং ১২ লাখ ৭২ হাজার শিক্ষকের সমন্বয়ে গঠিত এ শিক্ষাব্যবস্থাটি পথে আনতে একটু দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু কাজটি এখনই শুরু করতে হবে। সংস্কার কার্যক্রমকে ফলদায়ক ও টেকসই করার জন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এবং যৌক্তিকভাবে এগিয়ে নেওয়া এ সময়ের চ্যালেঞ্জ’ (প্রথম আলো, ০৪-০৯-২৪)। তারপরেও বাংলাদেশ সব চ্যালেঞ্জকে অতিক্রম করেই সামনে এগিয়ে যাবে আর শিক্ষা নিতে নতুন ভাবনাগুলোর প্রতিফলন ঘটানোর মাধ্যমেই আগামীর দিনগুলোতে সবার মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই জয় করবে গোটা বিশ্বকে। বাংলাদেশ তুমি সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার এই হোক নতুন বছরের প্রত্যাশা।
সৈয়দ মো. সিয়াম ।। সহকারী অধ্যাপক, শিক্ষা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়