জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি : ভ্যাভিলভের চিরস্মরণীয় অবদান
লেখাটি শুরু করার আগে একজন ব্যক্তির গল্প বলা উচিত। আমাদের গল্পের নায়ক কোনো যোদ্ধা বা রাজপুত্র নন। তবে নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন একজন বীরপুরুষ। তার নাম নিকোলাই ভ্যাভিলভ (Nikolai Vavilov)। তিনি ছিলেন একজন খ্যাতিমান রুশ এবং সোভিয়েত কৃষিবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং জিনবিজ্ঞানী।
আজ বিশ্বব্যাপী যেসব উদ্ভিদের চাষ হচ্ছে, সেগুলোর উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে আমাদের বর্তমান জ্ঞানের ভিত্তি গড়ে তোলার পেছনে তার অপরিসীম অবদান রয়েছে। তার জীবনের গল্প বিজ্ঞান, রাজনীতি এবং নিষ্ঠুর বাস্তবতার এক মর্মস্পর্শী সংমিশ্রণ।
১৮৮৭ সালে মস্কোতে জন্ম নেওয়া ভ্যাভিলভ ছোটবেলায় তার বাবার কাছে রাশিয়ায় ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সব দুর্ভিক্ষের গল্প শুনতেন। সবসময় তার মনে হতো, রাশিয়ার প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে মানুষ কতটা অসহায়। তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞান ও কৃষির প্রতি আকৃষ্ট হন এবং মস্কো কৃষি ইন্সটিটিউট থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর, উদ্ভিদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি উদ্ভিদের জিনগত বৈচিত্র্য এবং রোগ প্রতিরোধের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে গভীর গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।
তৎকালীন স্টালিন সরকার রাশিয়ায় গমের উৎপাদনে বিপ্লব আনার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছিল। তবে, ভ্যাভিলভের মত ছিল যে গম ফসলটি রাশিয়ার আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে এই ফসলটির উৎপত্তিস্থল আফ্রিকার উষ্ণ অঞ্চল, যা রাশিয়ার ঠান্ডা আবহাওয়ার উপযোগী নয়। ভ্যাভিলভের এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সোভিয়েত সুডো—কৃষিবিজ্ঞানী এবং স্টালিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ট্রফিম লিসেনকো (Trofim Lysenko)-এর মতবাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
লিসেনকো মেন্ডেলের জিনতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে সমর্থন করতেন। তার তত্ত্ব, যা দ্রুত কৃষি উন্নয়নের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, রাজনৈতিকভাবে সমর্থন লাভ করে। লিসেনকোর তত্ত্বটি ছিল বেশ হাস্যকর। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, গমের বীজকে দীর্ঘ সময় ধরে ঠান্ডায় রেখে দিলে বীজের মধ্যে শীত সহ্য করার ক্ষমতা তৈরি হবে। এর ফলে, সেই বীজ থেকে অত্যন্ত হিমশীতল আবহাওয়াতেও সফলভাবে গম উৎপাদন সম্ভব হবে।
ভ্যাভিলভের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতি নিষ্ঠার কারণে লিসেনকো তাকে রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। ১৯৪০ সালে ভ্যাভিলভ গুপ্তচরবৃত্তি ও ষড়যন্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে গ্রেফতার হন। এই অভিযোগগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং শুধুমাত্র লিসেনকোর সঙ্গে তার মতবিরোধের ফল।
১৯৪৩ সালে একটি সোভিয়েত শ্রম শিবিরে, গোলাগিতে, কারাবন্দি অবস্থায় ভ্যাভিলভ অনাহারে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে তিনি এক অসাধ্য সাধন করে গেছেন। ভ্যাভিলভ উদ্ভিদ চাষের উৎপত্তিস্থান চিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক গবেষণা করেন এবং ‘ফসলের উৎপত্তি কেন্দ্র’ তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে নির্দিষ্ট ফসলের চাষ প্রথম শুরু হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফসলের বৈচিত্র্য ধরে রাখার উদ্দেশ্যে তিনি বিশ্বের বৃহত্তম বীজ ব্যাংকগুলোর একটি প্রতিষ্ঠা করেন। তার গবেষণা ফসলের বৈচিত্র্যের গুরুত্ব এবং দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে।
বিশ্বব্যাপী কৃষি ব্যবস্থায় যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন একটি অন্যতম প্রধান ক্রীড়ানায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। আজ বিশ্বব্যাপী টমেটো, ভুট্টা ও তরমুজের যে ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়, তা সম্পূর্ণভাবেই মানুষের উদ্ভাবন ও প্রয়াসের ফল।
তার মৃত্যুর পরেও ভ্যাভিলভের কাজ বিজ্ঞান ও কৃষিক্ষেত্রে বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছে। তার প্রতিষ্ঠিত বীজ ব্যাংক, যা লেনিনগ্রাদের অবরোধকালেও তার নয়জন উত্তরসূরি নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে সংরক্ষিত রেখেছিলেন, যা আজও বৈজ্ঞানিক গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে টিকে আছে।
ভ্যাভিলভের এই গল্প মনে করিয়ে দেয় যে, আজ বিশ্বব্যাপী ফসলের জাতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে, তার পেছনে রয়েছে বিজ্ঞানীদের শত-সহস্র বছরের পরিশ্রম। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে অগণিত গবেষণা, অসংখ্য জীনগত পরিবর্তন, সংকরায়ণ এবং ফসলকে অভিঘাত সহনশীল করে তোলা। বিভিন্ন আবহাওয়া ও জলবায়ুতে উৎপাদনযোগ্য অসংখ্য প্রজাতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। আজ বিশ্বের ৮.০২৫ বিলিয়ন মানুষের খাদ্যের জোগান সেই নিরলস গবেষণা ও উদ্ভাবনের ফল।
বিশ্বব্যাপী কৃষি ব্যবস্থায় যে বিপ্লব সাধিত হয়েছে, তার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তন একটি অন্যতম প্রধান ক্রীড়ানায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। আজ বিশ্বব্যাপী টমেটো, ভুট্টা ও তরমুজের যে ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়, তা সম্পূর্ণভাবেই মানুষের উদ্ভাবন ও প্রয়াসের ফল। এগুলোর কোনোটিই প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত ফসল নয়।
আরও পড়ুন
বিশ্বে শুধুমাত্র একটি প্রজাতির শস্যদানা, সবজি বা ফলের পেছনে যত প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটেছে এবং এখনো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে চলেছে, তা বিশদভাবে বর্ণনা করতে গেলে একাধিক পুস্তক রচনা করা প্রয়োজন। তবে এখানে আমাদের সবচেয়ে পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ ফসল, ধানের সম্পর্কিত কিছু ঘটনা, তথ্য এবং উপাত্ত তুলে ধরা হবে।
ধারণা করা হয়, ওরাইজা রুফিপগন (Oryza rufipogon) এবং ওরাইজা বার্থি (Oryza barthii) নামক দুটি ঘাসের প্রজাতি, যা মূলত এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশে পাওয়া যেত, সেখান থেকেই আজকের ধানের উৎপত্তি। তবে প্রথম উচ্চফলনশীল ও অভিঘাত সহনশীল ধানের জাত আবিষ্কৃত হয় ১৯৬০-এর দশকের সবুজ বিপ্লবের সময়। এটি ছিল IR8, যা ‘মিরাকল রাইস’ নামে পরিচিত।
১৯৭০-এর দশকে হাইব্রিড ধান প্রযুক্তি চালু হয়, যা ক্রস-পরাগায়নের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী জাতের তুলনায় ১৫-৩০ শতাংশ বেশি ফলন দিতে সক্ষম। চীন এই প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করেছে এবং এর মাধ্যমে ধান উৎপাদনে অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করেছে।
উচ্চফলনশীলতার বাধা আমরা পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু এখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট অনিশ্চিত আবহাওয়া, পানি সংকট বা খরা, এবং নতুন প্রজাতির পঙ্গপাল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। তবুও, নিকোলাই ভ্যাভিলভের মতো বিজ্ঞানীদের উদ্যম ও অনুপ্রেরণায় আমরা এসব বাধাকে জয় করে চলেছি।
যেমন, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (IRRI) উদ্ভাবিত স্বর্ণা সাব-১ নামক জাতটি দীর্ঘস্থায়ী বন্যাতেও টিকে থাকতে সক্ষম, যা ১৫ দিন পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে থাকলেও ফলন দিতে পারে। অন্যদিকে, সহভাগী ধান জাত খরা-প্রবণ এলাকায় ফলন দিতে সক্ষম, যা ভারত এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া পোক্কালি এবং ব্রি ধান ৪৭ লবণাক্ত পানির এলাকায় ভালো ফলন দিচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে ধান চাষের জন্য কার্যকর সমাধান প্রদান করে।
নতুন গবেষণা বলছে, ধানক্ষেতে নিরবচ্ছিন্ন পানি রাখার পরিবর্তে নিয়মিত ভেজানো ও শুকানোর পদ্ধতি বেশি কার্যকর। এ পদ্ধতি সেচ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক সুবিধা এনে দিতে পারে...
শুধু ধানের জাত নয়, চাষের পদ্ধতিতেও এসেছে অভাবনীয় পরিবর্তন। নতুন গবেষণা বলছে, ধানক্ষেতে নিরবচ্ছিন্ন পানি রাখার পরিবর্তে নিয়মিত ভেজানো ও শুকানোর পদ্ধতি বেশি কার্যকর। এ পদ্ধতি সেচ ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক সুবিধা এনে দিতে পারে, যেখানে পানি ব্যবহার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়, মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায় এবং ফলন স্থিতিশীল থাকে বা বৃদ্ধি পায়।
এছাড়া আরেকটি নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে, নার্সারি বা সিড বেডে চারা তৈরি না করে সরাসরি জমিতে বীজ বপন করাও অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে। এতে শ্রম এবং পানির সাশ্রয় যেমন সম্ভব, তেমনি মিথেন গ্যাসের নিঃসরণও উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো যায়। আরও রয়েছে ক্রিস্পার প্রযুক্তি, যা ধানের জিনগত বৈশিষ্ট্য উন্নত করতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ধান গাছের নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হচ্ছে।
তাছাড়া আইওটি সেন্সরের মাধ্যমে জমির মাটির আর্দ্রতা পর্যবেক্ষণ এবং সেচ ও সারের সঠিক ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। এছাড়া এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ সম্পর্কে সতর্কতা প্রদান করছে, যা চাষির জন্য অত্যন্ত সহায়ক।
বিশ্বব্যাপী বায়োফর্টিফাইড রাইস বা পুষ্টি সমৃদ্ধ ধান, যেমন জিঙ্ক সমৃদ্ধ ধান (ব্রি ধান ৬২), পুষ্টিহীনতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর। এই জাতগুলো উদ্ভাবনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আরও রয়েছে জলবায়ুবান্ধব ধান জাত যেমন IR64-LowCH4, যা ধানের চাষের সময় কম মিথেন গ্যাস নিঃসরণ করে।
নিকোলাই ভ্যাভিলভের সেই অন্ধকার সময় পার করে আমরা আজ অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। ভ্যাভিলভ ও তার সহযোগী নয়জন বিজ্ঞানী আমাদের যে আলোর পথ দেখিয়েছিলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় আমরা সেই পথ ধরে সামনে এগিয়ে চলেছি। হয়তো আর কখনোই লিসেনকোর মতো কোনো খলনায়ক আমাদের এই বিপ্লবের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে পারব না, কিন্তু এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৃষি প্রযুক্তির উদ্ভাবন অব্যাহত রাখব। মানব ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষগুলো যেন আর কখনো ফিরে না আসে—সে প্রচেষ্টা আমরা চালিয়ে যাব। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং মানবতার অদম্য প্রয়াস আমাদের এই পথচলাকে আরও দৃঢ় করবে।
ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়