প্রশাসন ক্যাডাররা টেকনিক্যাল মন্ত্রণালয়ের সচিব হন কেন?
বিশ্বব্যাপী সরকারের মূল কাজগুলোর একটি পলিসি প্রণয়ন কমিটি থাকে, যা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার রাষ্ট্রীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে, জনসেবা ও জনস্বার্থ নিশ্চিত করে। সরকারের এই পলিসি প্রণয়নে রাজনীতিবিদ বা ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা করে সিভিল সার্ভেন্ট।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যারিয়ার সচিবরা মন্ত্রণালয়/বিভাগের প্রশাসনিক প্রধান সচিবের দায়িত্ব পালন করেন এবং রাজনীতিবিদদের পলিসি সাপোর্ট দেন। এসব সচিবরা অনেক সময়ই যে মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন ঐ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন না এবং অনেকটা জেনারেলিস্ট প্রকৃতির হন।
যেমন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুলের জনপ্রশাসনের পারফরম্যান্সের ওপর করা ২০২৪ সালের একটি র্যাংকিং এ বিশ্বের এক নম্বর দেশ সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য সচিব একজন ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট এবং অনেকটাই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যদের মতো অনুরূপ সিঙ্গাপুর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের সদস্য।
প্রশ্ন হলো কেন বিশেষ জ্ঞান বা প্রাসঙ্গিক শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই এসব উন্নত সমাজের সচিব পদে ক্যারিয়ার সচিবদের নিয়োগ দেওয়া হয়? কেন জেনারেলিস্টদের স্পেশালিস্টদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়?
আরও পড়ুন
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সচিব পদে কারা নিয়োগ পান, তাদের এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড কী দেখে নেওয়া প্রয়োজন:
দেশ |
পদ |
নাম |
ক্যারিয়ার |
শিক্ষাগত যোগ্যতা |
যুক্তরাজ্য |
শিক্ষা সচিব |
সুসান এলিজাবেথ |
ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট |
ক্যামব্রিজ জাজ বিজনেস স্কুল |
কৃষি সচিব (ব্রিটেনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে পরিবেশ, খাদ্য, ও রুরাল এফেয়ার্স ডিপার্টমেন্ট) |
টামারা মার্গারেট ফিংগেলস্টাইন |
ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট |
অর্থনীতি |
|
ভারত
|
স্বাস্থ্য সচিব |
স্যার ক্রিস উরমাল্ড |
ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাট |
বিএ অনার্স, এমবিএ |
কৃষি সচিব |
দেবেশ চতুর্বেদী |
ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস |
বিএসসি ইন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ার |
|
স্বাস্থ্য সচিব |
শ্রী অপূর্ব চন্দ্র |
ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস |
বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার |
|
শিক্ষা সচিব |
সঞ্জয় কুমার |
ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস |
পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স |
|
পাকিস্তান |
কৃষি সচিব |
ওয়াসিম আজমল চৌধুরী |
পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস |
ইঞ্জিনিয়ার |
স্বাস্থ্য সচিব |
নাদিম মাহবুব |
পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস |
মাস্টার্স ইন ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজমেন্ট |
|
শিক্ষা সচিব |
মহিউদ্দিন আহমেদ ওয়ানি |
পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস |
ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার |
|
শ্রীলঙ্কা |
কৃষি সচিব |
ডিপি বিক্রমাসিংহে |
শ্রীলঙ্কান বিমান বাহিনী |
|
স্বাস্থ্য সচিব |
ডা. আনিল |
ডাক্তার ও মেডিক্যাল সার্ভিসেস |
অর্থাৎ, উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে পলিসি মেকিং-এ রাজনীতিবিদদের সাহায্যকারী লিড (সচিব) সাধারণত জেনারেলিস্ট! উপরের উদাহরণগুলোয় শ্রীলঙ্কা ছাড়া কোনো দেশের স্বাস্থ্য সচিব ডাক্তার নয়, কোনো দেশের কৃষি সচিব কৃষিবিদ নয়, কোনো দেশেরই শিক্ষা সচিব শিক্ষক নয়। অর্থাৎ বেশিরভাগ সচিব জেনারেলিস্ট। কেন? কেন স্পেশালিস্টদের বদলে জেনারেলিস্ট ক্যারিয়ার ব্যুরোক্র্যাটদের সচিব হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল উভয় দেশেই প্রাধান্য দেওয়া হয়?
এর কারণটা লুকিয়ে আছে জেনারেলিস্টদের কাজ ও প্রশিক্ষণের সাথে। যারা জেনারেলিস্ট যেমন বাংলাদেশে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার তারা পলিসি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন দুটো কাজের সাথেই জড়িয়ে থাকে। মাঠের অভিজ্ঞতার কারণে পলিসি আইডিয়া, প্রস্তাব বিশ্লেষণ ও সমন্বয় করা তাদের জন্য সহজ হয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো এসব প্রস্তাবের মধ্যে কোনগুলো বাস্তবায়নযোগ্য তা সম্বন্ধেও জেনারেলিস্টদের ধারণা স্পেশালাইজড সিভিল সার্ভেন্টদের চেয়ে সাধারণত উন্নততর হয় বলেই অনুমান করা হয়।
শাব্দিক অর্থেই পাবলিক পলিসি, পাবলিক বা জনতার জন্য প্রণীত হয়। ফলে, কারিগরি সাইডের বাইরেও পলিসির হিউম্যান সাইড আছে। একাধিক গবেষণার অনুসন্ধান বলে, জেনারেলিস্টরা অভিজ্ঞতার কারণেই টেকনিক্যাল পলিসির হিউম্যান সাইড অর্থাৎ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক স্পেশালিস্টদের চেয়ে ভালো বুঝতে পারেন।
এছাড়া জেনারেলিস্টরা যেহেতু মাঠে নানা পলিসি সমন্বয় করে থাকেন তাই তৈরিকৃত পলিসির সাথে অন্যান্য পলিসির সংযোগটা তারা সাধারণত ভালো বোঝেন এবং কীভাবে পলিসি প্রবলেমের সমাধান নানা দপ্তরকে সংযুক্ত করে তৈরি করা যায় এটাও তারা ভালো বোঝেন।
একটা পলিসি সমস্যায় জেনারেলিস্টদের সবচেয়ে বড় অবদান পলিসির রাজনৈতিক দিকটা বিশ্লেষণে নিয়ে আসা যেই অভিজ্ঞতা জেনারেলিস্টরা মাঠ থেকে অর্জন করেন।
মূলত তাত্ত্বিকভাবে এই বিষয়গুলোয় মুনশিয়ানার কারণেই নানা দেশে সচিব পদে জেনারেলিস্টরা প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। কিন্তু সচিব পদে জেনারেলিস্ট নিয়োগে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান কম থাকা যে কারণে এসব দেশে সচিবদের এক্সপার্ট প্যানেলের ওপর নির্ভর করতে হয় যেই চর্চা বাংলাদেশেও আছে।
তবুও, পলিসি টেবিলে জেনারেলিস্ট যা আনছে এবং স্পেশালিস্ট যা আনছে তার কস্ট-বেনিফিট অ্যানালাইসিস করেই নানা দেশে জেনারেলিস্টদের মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব নিয়োগ দেওয়া হয় যদিও দেশভেদে এই চর্চায় ভিন্নতা আছে। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের সদস্যরা মূলত জেনারেলিস্ট যারা মাঠে সরকারের সব পলিসি বাস্তবায়ন সমন্বয় করে এবং জেনারেলিস্ট হিসেবে তাদের এই অভিজ্ঞতার কারণেই তাদের পৃথিবীর নানা দেশের মডেল অনুসরণ করে সচিব পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।
সোহেল রানা ।। সিনিয়র সহকারী সচিব, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়