মনমোহন সিং : নির্বিবাদী ও প্রচারবিমুখ ব্যক্তিত্ব
মৃত্যু অবধারিত, একে ঠেকানোর সাধ্য কারও নেই। অনেক সময় অসময়ে প্রথিতযশা কারও মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করে, সময়ের মৃত্যু সান্ত্বনা দেয়। তবে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এর ৯২ বছরে প্রয়াণ আমাদের ব্যথিত করছে, করছে স্মৃতিকাতর। একজন মানুষ সারাজীবন ধরে তার পাণ্ডিত্য দিয়ে মানুষের মঙ্গল চিন্তা করেছেন, রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনে তার আহরিত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন।
হিমালয়ের মতো উঁচু মাপের একজন মানুষ যে কতটা সাধারণ হতে পারেন, মনমোহন সিং তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। একসময় (১৯৯১-১৯৯৬) ভারতের অর্থমন্ত্রী এবং পরবর্তীতে (২০০৪-২০১৪) প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে তিনি দেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে যেমন যুগান্তকারী অনেক ভূমিকা পালন করেছেন, তেমনি রাজনৈতিক জীবনের পুরোটাই ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
আর তাই তার মৃত্যুতে একসময়ের বিরোধী দল, যারা বর্তমানে সরকারে আসীন, সেই বিজেপি সরকার দেশে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে, এই সময় দেশের সব সরকারি অনুষ্ঠানাদি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে। এসব সম্মান একজন মানুষ তার সারাজীবনে মানুষের জন্য কাজের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছেন।
তারপরও তার মৃত্যুর শোক যেন সবার অন্তরকে ছাপিয়ে গেছে! তিনি যে কতটা সম্মানিত ছিলেন এর কিছুটা প্রমাণ মেলে তার মৃত্যুর পর প্রথম টুইটারে তার উত্তরসূরি নরেন্দ্র মোদির শোক জ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে, যিনি মনমোহন সিং-কে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী একজন ব্যক্তি হিসেবে তুলনা করেছেন।
মনমোহন সিং ভারতের প্রথম শিখ প্রধানমন্ত্রী। সারাজীবন শিক্ষকতা এবং অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করা মানুষটা যে একসময় দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত মানুষ হবেন, এটা ভাবেননি কেউ। রাজনীতিবিমুখ এই মানুষকে একসময় রাজনৈতিক অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, রাজনৈতিক অনেক অপবাদ, বিশেষ করে তার সরকারের সময়ের অনেক দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। এ সবকিছুর বিরুদ্ধে বাকরুদ্ধতাই ছিল তার জবাব।
তাকে ভারতের রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তিনি যখন অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থ সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, সে সময় দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখার্জি। দুজনে মিলে অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে অনেক পরামর্শ করতেন।
তার এমন স্বভাবের কারণে তাকে সে সময়ের বিরোধীদের অনেকে ‘মৌনমোহন’ বলে ঠাট্টা করতেন। তাকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়। তার সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে কেবল তিনি এটাই বলেছিলেন, ‘আমার বিশ্বাস, ইতিহাস আমাকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করবে’। বাস্তবে আসলে তেমনটাই হয়েছে। প্রতিবাদ করলেও ভারতের সব রাজনৈতিক দলের কাছেই তিনি সম্মানিত, আর সেজন্যই তার মৃত্যুতে দলমত নির্বিশেষে সবাই তাদের শোক জ্ঞাপন করছেন।
আজন্ম নির্বিবাদী এবং প্রচারবিমুখ এই মানুষটা নিজের শিক্ষা এবং নিজের প্রজ্ঞার গণ্ডির ভেতরই নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছেন। সময় তাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসে। সেই রাজনীতিই তাকে সারাবিশ্বে পরিচিত করে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.ফিল (Doctor of Philosophy) সম্পন্ন করে দেশের টানে ফিরে আসেন।
বিদেশে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার হতে পারত জেনেও দেশের জন্য কিছু করার তাড়নায় তার ফিরে আসা। যুক্ত হন দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিক্সে অধ্যাপনায়, পরবর্তীতে দায়িত্ব পালন করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে, এর পথ ধরে অর্থ সচিব, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর। আরও পরে অর্থনীতিতে তার অসামান্য দক্ষতার কারণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং-এর অর্থনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন।
একটা সময় ভারতের অর্থনীতি ছিল সংরক্ষণবাদী নীতি দ্বারা পরিচালিত। বিদেশি পণ্যের আমদানি নিষিদ্ধ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের অনুমোদন ছিল না। আগের সরকার এই সংরক্ষণবাদী নীতির স্বপক্ষে অনেক যুক্তি তুলে ধরেছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ভারত নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম এবং এর মধ্য দিয়ে তারা নিজস্ব উৎপাদিত পণ্যের বিস্তারের মাধ্যমে বরং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম।
১৯৯০-এর দশকে ভারতের অর্থনীতি তার স্বাভাবিক গতি হারাতে থাকে। অনেকটা বিশ্বায়নের প্রভাব এবং অনেকটা বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তনের ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট যখন প্রকট আকার ধারণ করেন সেই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে যুক্ত হন তিনি, যা অনেককেই অবাক করেছিল।
আরও পড়ুন
দায়িত্ব নিয়েই অর্থনীতিকে সংকট থেকে তুলে আনতে এমন কিছু সিদ্ধান্ত নেন, যা সে সময় অনেকে সমালোচনা করলেও পরবর্তীতে তার গৃহীত নীতি এবং সিদ্ধান্তই ভারতকে অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে টেনে তুলে। তার সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ভারতের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, যা পরবর্তীতে ব্যাপক বৈদেশিক বিনিয়োগ নিশ্চিত করে।
পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো বেসরকারিকরণ করার ফলে লোকসানের গণ্ডি থেকে বের হয়ে নতুন ধরনের উদারবাদী অর্থনীতির সূচনা হয় ভারতে। এর পথ ধরে আরও পরে আমরা উন্নয়নের আরেকটি চিত্র দেখতে পাই প্রযুক্তির প্রসারে ভারতের অন্যতম অবস্থান করে নেওয়ার মাধ্যমে। বলা যায় ভারতকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন মনমোহন সিং।
তবে তাকে ভারতের রাজনীতিতে আনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেন দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। তিনি যখন অর্থ উপদেষ্টা এবং অর্থ সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, সে সময় দেশের অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখার্জি। দুজনে মিলে অর্থনৈতিক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে অনেক পরামর্শ করতেন।
প্রণব মুখার্জির মন্ত্রণালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি মনমোহন সিং-এর কাছ থেকে অনেক উপকৃত হয়েছিলেন, যা পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন জায়গায় স্বীকার করেছেন। ১৯৯১ সালে যখন অর্থনৈতিক দৈন্যদশা থেকে দেশকে তুলে আনার বিষয়টি ছিল চ্যালেঞ্জিং, তখন প্রণব মুখার্জির পরামর্শেই তাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোর ক্ষেত্রে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন প্রণব মুখার্জি। এক সময়ের সফল অর্থমন্ত্রীকে তাই তিনি এবং কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব সবসময় সমীহ করতেন। ২০০৪ সালের নির্বাচনের পর যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন বিষয়টি সামনে চলে আসে এবং সোনিয়া গান্ধীকে অনেক প্রচেষ্টার পরেও এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য রাজি করানো যায়নি, এমন সময় প্রণব মুখার্জির পরামর্শেই মনমোহন সিং-এর নাম সামনে চলে আসে।
পরবর্তীতে অবশ্য মনমোহন সিং-এর মন্ত্রিসভায় প্রথমে প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পরবর্তীতে পররাষ্ট্র এবং অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রণব মুখার্জি। এদিক দিয়ে তাদের দুজনেরই দুজনের অধীনে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তাদের মধ্যকার পেশাগত এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছিল দারুণ।
ব্যক্তিজীবনের নির্লোভ এবং সাদামাটা জীবনের অধিকারী মনমোহন সিং এই দায়িত্ব নিতে প্রথমে রাজি না হলেও সোনিয়া গান্ধীর অনুরোধে অবশেষে রাজি হন। প্রথম মেয়াদে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালনের পর যখন দ্বিতীয়বারের জন্যও তাকে এই পদে বাছাই করা হয়, তখন তিনি চেয়েছিলেন তার স্থলে রাহুল গান্ধী যেন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন।
২০১০ সালে কানাডার টরেন্টোয় জি-২০ সম্মেলনের বক্তব্যে তার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওবামা বলেন, ‘যখন মনমোহন সিং কিছু বলেন, সারা বিশ্ব তখন তা শোনে’। শুধু বারাক ওবামা নয়, সারাবিশ্বের নেতাদেরই প্রশংসা, সম্মান এবং আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
সে সময় এক সংবাদ সম্মেলনে সোনিয়া গান্ধী বলেছিলেন, ‘রাহুল আমাকে বারবার অনুরোধ করছে, মনমোহন সিং-কে রাজি করানোর জন্য’। এমনই একজন ভক্তির মানুষ ছিলেন তিনি। সেই সাথে তার উপর দায়িত্ব অর্পণ করে অনেকটা নির্ভার ছিল কংগ্রেসের নেতৃত্ব। আর তাই তার এই প্রয়াণে সোনিয়া গান্ধী বলেছেন তিনি নিজের একজন ভালো বন্ধু এবং পরামর্শককে হারালেন। রাহুল গান্ধী নিজের একজন সবচেয়ে বড় মেন্টরকে হারালেন বলে জানিয়েছেন।
মনমোহন সিং ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় সোনিয়া গান্ধী কার্যত দেশ চালাচ্ছেন বলে বিরোধীরা মন্তব্য করলেও বাস্তবে এমন বিষয়টি প্রমাণিত নয়, বরং অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে তিনি স্বাধীনভাবেই দায়িত্ব পালন করতেন। তার সময়ে ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বেসামরিক পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
সে সময় বামদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি তার স্বভাবসুলভ শান্ত মেজাজে একে উপেক্ষা করে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যার ফলে এনপিটির স্বাক্ষরকারী দেশ না হয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পরমাণু অস্ত্রের বেসরকারি পর্যায়ে ব্যবহারের বিষয়ে চুক্তিতে উপনীত হতে সক্ষম হয়, যা ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নয়নের একটি শক্তিশালী ভিত্তি রচনা করে।
পরবর্তীতে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর মনমোহন সিং এর সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন তিনি। তার ব্যক্তিত্ব এবং পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করতে গিয়ে ২০১০ সালে কানাডার টরেন্টোয় জি-২০ সম্মেলনের বক্তব্যে তার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ওবামা বলেন, ‘যখন মনমোহন সিং কিছু বলেন, সারা বিশ্ব তখন তা শোনে’। শুধু বারাক ওবামা নয়, সারাবিশ্বের নেতাদেরই প্রশংসা, সম্মান এবং আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
একজন পণ্ডিতের চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়, তার অসংখ্য অসামান্য কীর্তি দিয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় অমর হয়ে থাকবেন মনমোহন সিং। তার স্মৃতির প্রতি হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়