কৃষিতে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব কতটা ভয়াবহ?
বাংলাদেশে শীতের ব্যাপ্তি ক্রমাগতভাবে কমে যাচ্ছে। কখনো তীব্র শীত, কখনো ঘন কুয়াশা আবার কখনো শৈত্যপ্রবাহও দেখা দিচ্ছে। এতে ফসলের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং ফলন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে এবং ফসলের পরাগায়ন ব্যাহত হচ্ছে। অতি ঠান্ডায় আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ ইত্যাদি ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাবে।
তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নষ্ট হবে বোরোর বীজতলা। শিম, লাউ, করলা, মিষ্টি কুমড়া, আলু, শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষি খেত নষ্ট হচ্ছে। উল্লেখ্য, মৌসুমের এ সময়ে মাঠে শীতকালীন ফসল আলু, টমেটো, বেগুন, মরিচ, সরিষা, শিমসহ বিভিন্ন জাতের সবজি রয়েছে। এছাড়া কোথাও কোথাও বোরোর বীজতলা রয়েছে আবার কোথাও বোরো চারা রোপণ করা হয়েছে।
চলমান শৈত্যপ্রবাহে বোরো বীজতলা ও রোপা ধানের কোল্ড ইনজুরি এবং আলুর লেটব্লাইট বা আলুর মড়ক রোগ আক্রান্ত হওয়ার দুশ্চিন্তায় কৃষক ও মাঠ পর্যায়ের কৃষিবিদরা। এ ধরনের আবহাওয়া গম উৎপাদনে সহায়ক হলেও বৃষ্টি নামলে ছত্রাকবাহী ‘ব্লাস্ট’ রোগের সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা সর্বনিম্ন রেকর্ড করা হয়েছে ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে রোপা বোরোর বীজতলা এবং আলু নিয়ে কৃষকের দুশ্চিন্তা ক্রমশ বাড়ছে। বোরো বীজ রোপণ ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলেও বীজতলা নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। পাশাপাশি আলু নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে কৃষকের।
অপরদিকে, কয়েক বছর ধরে ছত্রাকবাহী ব্লাস্ট রোগের কারণে সরকার কিছু এলাকায় গম আবাদ নিরুৎসাহিত করলেও এবার পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে বোরোর বীজতলা। বিভিন্ন ধরনের ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
...তীব্র শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে নষ্ট হবে বোরোর বীজতলা। শিম, লাউ, করলা, মিষ্টি কুমড়া, আলু, শাকসবজিসহ বিভিন্ন কৃষি খেত নষ্ট হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, উত্তর অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। শস্যভাণ্ডারখ্যাত উত্তরাঞ্চলে তাপমাত্রা তলানিতে নামতে শুরু করেছে। এ অবস্থায় বীজতলা মরে বোরোর চারা সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হতে পারে।
কৃষকরা বলছেন, তারা বীজতলায় ছত্রাকনাশক ছিটাচ্ছেন। কুয়াশার হাত থেকে চারা বাঁচাতে বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকেও রাখছেন। তীব্র শীত-কুয়াশার কারণে বোরো বীজতলাতেও সমস্যা হয়। আবার শীতে বিশেষ করে কুয়াশা বাড়লে আলুর মড়ক দেখা দেয়।
আলুগাছ অতি ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে না। তাই কুয়াশা ঝরলে কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়ে। শুধু আলুই নয়, টমেটোর খেতেও মড়ক দেখা দেয়। কয়েকদিনের ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতে বগুড়া, রাজশাহী ও জয়পুরহাটে আলু চাষিদের মধ্যে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। বিঘার পর বিঘা জমির আলুর পাতা কুঁকড়ে যাওয়াসহ পাতা ও কাণ্ড পচে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চারদিন পরপর তারা জমিতে ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন।
আলু রোপণের দেড় থেকে দুই মাস পর কাণ্ড ও পাতা লেটব্লাইট বা মড়ক রোগে আক্রান্ত হয় বলে জানিয়েছেন কৃষক। লেটব্লাইট বা মড়ক নামের এই পচন রোগ থেকে রক্ষা পেতে জমিতে সপ্তাহে অন্তত একদিন ছত্রাকনাশক ছিটাতেই হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।
কৃষকরা বলছেন, কয়েকদিনে রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা বেশ বেড়েছে। দিনের বড় অংশই কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকায় খেতে ছত্রাকের আক্রমণ দেখা দিয়েছে।
কোনো কোনো জায়গায় ধানের চারা হলুদাভ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকের বীজতলায় চারা পোড়া ও ঝলসানো রোগও দেখা দিয়েছে। জমিতে ১০-১৫ দিন বয়সী চারাগুলো সাদা ও লালচে রং ধরে মারা যাচ্ছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা ও ঘন কুয়াশার কবল থেকে বোরো ধানের বীজতলার চারা রক্ষার জন্য এখন যা করা দরকার তা হলো—
প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় বীজতলা সেচের পানি দিয়ে ডুবিয়ে রাখতে হবে এবং পরদিন সকাল বেলায় পানি বের করে দিতে হবে। চারাগাছে সূর্যের রোদ লাগার ব্যবস্থা করতে হবে। বীজতলায় ২-৫ সেন্টিমিটার (০.৭৮ থেকে ২ ইঞ্চি) পানি রাখতে হবে এবং মাঝে মাঝে জমে থাকা পানি বের করে পুনরায় নতুন পানি দিতে হবে।
বোরো ধানের বীজতলা প্রতিদিন সকালে একবার পরিদর্শন করতে হবে। বীজতলার চারা যদি হলুদ হয়ে যায়, তাহলে প্রতি শতাংশ বীজতলার জন্য ২০০ গ্রাম হারে ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করা দরকার এবং এতে হলুদ না কমলে, প্রতি শতাংশ বীজতলার জন্য ১০০ গ্রাম হারে জিপসাম সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
বীজতলা পাতা ঝলসানো রোগে আক্রান্ত হলে সকালবেলা রশি টানা দিয়ে চারা থেকে কুয়াশার পানি ফেলে দিতে হবে এবং বীজতলায় প্রতি শতাংশের জন্য ৫০ গ্রাম হারে পটাশ সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। অতিরিক্ত ঠান্ডায় বীজতলায় ছাই ছিটিয়ে তাপমাত্রা ধরে রাখা যায়। কাজেই এ অবস্থায় বীজতলায় কৃষকরা ছাই ছিটাতে পারেন।
স্বচ্ছ পলিথিন আবৃত ধানের শুকনা বীজতলা তৈরি করতে হবে। বীজতলা থেকে চারা তোলার এক সপ্তাহ আগে অনুমোদিত হারে কীটনাশক ছিটানো যেতে পারে। এতে বীজতলার চারা পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। বিস্তারিত জানার জন্য কৃষকরা নিকটস্থ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার সাথে অথবা উপজেলা কৃষি অফিসে যোগাযোগ করতে পারেন।
উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগণ বলেন, শৈত্যপ্রবাহের সময় বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। তা না হলে এর প্রভাব সামগ্রিক বোরো উৎপাদনে পড়বে। মাঠ পর্যায়ে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাব থেকে বাঁচতে বীজতলায় নলকূপের পানি দিয়ে তা ধরে রাখতে হবে। এছাড়া বীজতলা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখা যেতে পারে। শিশির পড়লে তা ঝরিয়ে দিতে হবে। এর সঙ্গে ছত্রাকনাশক এবং প্রতিশতক জমিতে ২৮০ গ্রাম করে ইউরিয়া সার দিতে হবে বলে নির্দেশনা প্রদান করেন।
অতিমাত্রায় শীতের পাশাপাশি অসময়ের বৃষ্টিতে কৃষকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অসময়ের তুমুল বর্ষণেও অনেক কৃষক সর্বশান্ত হন। সবজি ফসলের চারা পুরোটাই মারা পড়ে। নতুন করে আবার চারা লাগাতে হয়।
আমাদের মতো দেশে যেখানে উষ্ণ আবহাওয়ার এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া এবং তাপমাত্রার (গরম এবং শীত) অনাকাঙ্ক্ষিত ঘন ঘন পরিবর্তন দেখা দেয় বা বিভিন্ন বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে মাটির জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়। তাই আমাদের মাটিতে সাড়ে তিন পার্সেন্ট জৈব পদার্থ থাকলেও হয়।
বর্তমানে আমরা দেখেছি যে, জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে। মাটির জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে অভিহিত করেন বিজ্ঞানীরা। আবহাওয়ার এই যে ঘন ঘন পরিবর্তন বা অধিক গরম বা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, বৃষ্টি সবকিছুই মাটির প্রাণ জৈব কার্বন শূন্য হওয়ার একটি বড় কারণ বলে মনে করেন পরিবেশ ও মাটি বিশেষজ্ঞরা।
আরও পড়ুন
অতিমাত্রায় শীতের পাশাপাশি অসময়ের বৃষ্টিতে কৃষকদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অসময়ের তুমুল বর্ষণেও অনেক কৃষক সর্বশান্ত হন। সবজি ফসলের চারা পুরোটাই মারা পড়ে। নতুন করে আবার চারা লাগাতে হয়। এরকম দুর্যোগে যদি গাছ টিকে যায় এই আশায় তার একমাত্র ভেলা।
ফসল চাষে রবি মৌসুম, লাভের মৌসুম। বেশ খরচ করে তারা ফসল ফলায় লাভের মুখ দেখবে বলে। সেখানেই অতি শীত এক বড় ধাক্কা। কুমিল্লা, রংপুরের, বগুড়া, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ, ময়মনসিংহ, সিলেট ও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অসময়ের বৃষ্টি এবং শৈত্যপ্রবাহের শঙ্কায় রয়েছেন তারা।
জানা যায়, তাদের দুঃখ-দুর্দশা, আশা প্রত্যাশার কথা। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি না হওয়ার জন্য তারা কৃষকদের পাশে সচেষ্ট রয়েছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগ, কৃষকদের নিরাপদ ফসল চাষের জন্য সার্বিক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।
সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]