প্রভু যিশুর আগমন ও বড়দিনের তাৎপর্য
যুগ যুগ ধরে ইহুদি জাতি তাদের মুক্তিদাতা মসীহ্র (যিশুর) জন্য অপেক্ষা করছিল কারণ তিনি এসে তাদের মুক্ত করবেন। বিভিন্ন নবী মুক্তিদাতার আগমনের কথা ঘোষণা করেছেন এবং তাদের প্রস্তুতও করেছেন। নবীরা ইহুদি জাতিকে তাদের মন পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রচার করেছেন তারা যেন মানুষের তৈরি দেবমূর্তিকে নয় বরং সব মন-প্রাণ ও শক্তি দিয়ে এক ঈশ্বরের পূজা করেন এবং তার নির্দেশ অনুসারে জীবনযাপন করেন, তাদের হৃদয় যাতে কঠোর না করে, তারা যাতে সৎ ও পবিত্র জীবন যাপন করে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসে, অভাবী, বিধবা ও দীন-দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা, দয়া ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।
খ্রিস্টের জন্মের ৭০০ বছর পূর্বে বিভিন্ন নবীরা তার সম্বন্ধে ভবিষ্যৎ বাণীও করেছেন, ‘হে আকাশমণ্ডল, ঊর্ধ্ব থেকে শিশিরপাত করুক, মেঘমালা ধর্মময়তা (ন্যায্যতা) বর্ষণ করুক। উন্মোচিত হোক মর্তের মুখ, অঙ্কুরিত হোক পরিত্রাণ আর সেই সঙ্গে ধর্মময়তা (ন্যায্যতা) ফুটে উঠুক। আমিই প্রভু, এই সবকিছুই আমি সৃষ্টি করেছি’ (ইসাইয়া: ৪৫:৮:)।
আবার তিনি শিক্ষা দিয়েছেন—‘ভয় করো না, সাহস ধর! ওই দেখ, তোমাদের ঈশ্বর! তোমাদের প্রতি যত অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে, যথাযোগ্য প্রতিফলন দিতে আসছেন তিনি’ (ইসাইয়া ৩৫:৪)।
মুক্তিদাতা মসীহ্ যখন আসবেন আকাশ থেকে শিশিরের মতো ন্যায্যতা ঝড়ে পড়বে। অসত্য, অন্যায় চিরতরে দূরীভূত হবে, প্রতিষ্ঠিত হবে প্রকৃত ন্যায্যতা। তিনি বাইরের দিকটা দেখে বিচার করবেন না, ধর্মময়তার ভিত্তিতে বিচার করবেন।
মানব জাতির প্রতীক্ষিত মুক্তিদাতা প্রভু যিশু ত্রিশ বছর বয়সে প্রকাশ্যে প্রচার কার্য শুরু করেন। বাণী প্রচারের সাথে সাথেই চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেক লোক তার অমৃতময় বাণী শোনার জন্য চারপাশে ভিড় জমায়।
আমাদের দেশে কত অন্যায্যতা, হিংস্রতা, শ্রমিকরা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত, নারীদের প্রতি বৈষম্য। যিশু—‘আশ্চর্য মন্ত্রণাদাতা, বিক্রমশালী ঈশ্বর, সনাতন পিতা, শান্তিরাজ। সীমাহীন শান্তিতে তিনি আধিপত্য প্রসারিত করবেন’ (ইসাইয়া ৯:৫-৬)।
যিশুর জন্ম কাহিনিতে আমরা শুনি—‘জয় ঊর্ধ্বলোকে পরমেশ্বরের জয়। ইহলোকে নামুক শান্তি তার অনুগৃহীত মানবের অন্তরে’ (লুক ২:১৪)।
যিশু তার শিষ্যদের জন্য শান্তি দান করেছেন—‘শান্তি তোমাদের জন্য রেখে যাচ্ছি, আমারই শান্তি তোমাদের দান করছি’ (যোহন ১৪:২৭)। এই শান্তি হলো শক্তিশালী, ঐশ্বরিক ও চিরস্থায়ী।
জগতের কষ্ট, বাধা, বিপত্তি এ শান্তি কেড়ে নিতে পারে না। শান্তি স্থাপনকারীকে বাইবেলে অনেক উঁচুতে স্থান দেওয়া হয়েছে—‘শান্তি স্থাপন করে যারা, ধন্য তারাই। তারা ঈশ্বরের সন্তান বলে পরিচিত হবে’ (মথি ৫:৯)।
আরও পড়ুন
বিশ্বের কোটি কোটি খ্রিস্টানরা ২৫ ডিসেম্বর মহাসমারোহে ক্রিসমাস অর্থাৎ বড়দিন পার্বণ উদযাপন করেন। আজ থেকে প্রায় দুই হাজার চব্বিশ বছর পূর্বে ঈশ্বর তনয় আশ্চর্যজনকভাবে ঐশী শক্তিতে মেরির কোলে বেথলেমের জীর্ণ গোশালায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
মানব জাতির প্রতীক্ষিত মুক্তিদাতা প্রভু যিশু ত্রিশ বছর বয়সে প্রকাশ্যে প্রচার কার্য শুরু করেন। বাণী প্রচারের সাথে সাথেই চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেক লোক তার অমৃতময় বাণী শোনার জন্য চারপাশে ভিড় জমায়।
শ্রোতাদের তিনি মন পরিবর্তনের আহ্বান জানান। পাপ, অসত্য, অন্যায় থেকে মন ফিরিয়ে সত্য, সুন্দর ও ভালো কাজে মনোনিবেশ করার আহ্বান জানান। তিনি শিক্ষা দেন আমরা যাতে পাপকে ঘৃণা করি, পাপীকে নয়। তিনি অবহেলিত, নির্যাতিত নিপীড়িত ও অস্পৃশ্যদের পক্ষ অবলম্বন করেন।
তিনি বলতেন যে, অসুস্থদেরই ডাক্তার প্রয়োজন সুস্থদের জন্য নয়। পৃথিবীতে থাকাকালীন অবস্থাতে তিনি অনেক আশ্চর্য কাজ করেছেন—অন্ধকে দিয়েছেন দৃষ্টি, কালাকে দিয়েছেন শোনার ক্ষমতা, প্রতিবন্ধীকে দিয়েছেন হাঁটার শক্তি এমনি মৃতকে দিয়েছেন জীবন।
প্রভু যিশু একে অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শিক্ষা দেন। শুধু পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরই নয় এমনকি শক্রদের তিনি ভালোবাসতে বলেন। তিনি একে অপরকে ক্ষমা করতে শিক্ষা দেন। তিনি বলেছেন যে, সেবা পেতে নয় সেবা করতে এ জগতে এসেছেন। অন্যকে সেবা করার মধ্য দিয়েই আমরা মুক্তি এবং পরিত্রাণ লাভ করি।
প্রতিবেশী ভাইবোনদের, বিশেষ করে ক্ষুধার্তকে অন্ন দান, তৃষ্ণার্তকে জল, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র, অসুস্থের সেবা করি, অসহায় ও গরিব, দুঃখী মানুষদের যখন আমরা সেবা করি তখন তিনিই সেই সেবা গ্রহণ করেন। তার কাছে ব্যক্তির স্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে কারণ ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সে সৃষ্ট। তাই তো তিনি ধর্মের ঊর্ধ্বে তাকে স্থান দিয়েছেন। ধর্মের জন্য মানুষ নয় বরং মানুষের কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য ধর্ম।
২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে বিশ্ব ক্যাথলিক চার্চের অনেক বিশপগণ পোপ ফ্রান্সিসের উপস্থিতিতে ভ্যাটিকানে এক মাসের সিনডের দ্বিতীয় এবং শেষ সম্মেলন করেছেন। এখানে বিশ্ব ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে—ক্যাথলিক চার্চ হলো মানব মুক্তি ও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর, ভাষাভাষীর মানুষের মধ্যে বিশ্বে একতা ও মিলনের দৃশ্যমান চিহ্ন। চার্চ সব মানব জাতির মধ্যে একটা সেতু বন্ধন স্থাপন করতে আগ্রহী।
ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও একতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে গভীর ইচ্ছা প্রকাশ করে। এই একতা স্থাপনের জন্য এক সাথে সবাইকে চলতে হবে। একে অপরের কথা শুনতে হবে। নারীদের মর্যাদার কথা বলা হয়েছে—প্রতিটি নর-নারী ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিতে সৃষ্ট। তাই নারী- পুরুষের মধ্যে সম-মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারী-পুরুষের মধ্যে সব বৈষম্য দূর করতে হবে।
২০২৪ সালে আমরা যখন বড়দিন উদযাপন করছি তখন যিশুর জন্মস্থান পুণ্যভূমিতে চলছে যুদ্ধ, ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধেও আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক দেশ জড়িত হয়ে পড়েছে এবং সিরিয়াতে চলছে যুদ্ধ।
প্রভু যিশু একে অন্যকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে শিক্ষা দেন। শুধু পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধুদেরই নয় এমনকি শক্রদের তিনি ভালোবাসতে বলেন। তিনি একে অপরকে ক্ষমা করতে শিক্ষা দেন।
শান্তিরাজ প্রভু যিশু খ্রিষ্টের আগমনে এ বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছেন। ছাত্র-জনতা আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমরা প্রার্থনা ও প্রত্যাশা করি এই দেশটি হয়ে উঠুক—গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ ও উন্নত একটা দেশ।
পরিশেষে বড়দিন আমাদের আহ্বান করে হৃদয়-মন বড় করতে; উদার হতে, নিজের সংকীর্ণতা থেকে বেড়িয়ে আসতে। এই বড়দিনে আমাদের প্রার্থনা হোক—প্রভু যিশুর আগমন উপলক্ষে সব সংঘাত, হানাহানি ও যুদ্ধ বন্ধ হোক, এই ধরাতে নেমে আসুক স্বর্গীয় শান্তি।
বড়দিন আপনাদের প্রত্যেকের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল সুখ, শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, একতা ও সম্প্রীতি। আমি সবাইকে বড়দিন প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
বিজয় এন. ডি’ক্রুজ ।। আর্চবিশপ, ঢাকা মহাধর্মপ্রদেশ