পরিবেশ ও নাগরিক জীবনে শীতের প্রভাব
বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্যের মধ্যে শীতকাল একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এটি একদিকে আরামের ঋতু, অন্যদিকে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার সময়। বাংলাদেশের শীতকাল সাধারণত নভেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময় দেশের আবহাওয়া, পরিবেশ, জনজীবন, স্বাস্থ্য এবং কৃষিক্ষেত্রে নানা পরিবর্তন ঘটে।
শীতকাল বাংলাদেশের একটি শুষ্ক ঋতু। এ সময় তাপমাত্রা সাধারণত ১০ ডিগ্রি - ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তবে দেশের উত্তরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় তাপমাত্রা কখনো কখনো ৬ ডিগ্রি - ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যেতে দেখা যায়। গভীর রাতে এবং ভোরবেলায় তাপমাত্রা আরও কমে যায়, যা অনেক সময় তীব্র ঠাণ্ডার সৃষ্টি করে।
শীতকালে আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং বৃষ্টিপাত প্রায় অনুপস্থিত থাকে। ভোরে কুয়াশা আর শিশিরে ঘাস, গাছপালা ও ফসল ঢাকা পড়ে। দক্ষিণ থেকে আসা শীতল বায়ু শুষ্ক পরিবেশ তৈরি করে। দিনেরবেলায় সূর্যের তাপ কম থাকায় আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক মনে হয়। তবুও রাতের তীব্র ঠাণ্ডা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দুর্ভোগ ডেকে আনে।
বাংলাদেশের ছয় ঋতুর মধ্যে শীতকাল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব প্রদর্শনী এবং উৎসবের ঋতু হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। এ সময় প্রকৃতি, জনজীবন এবং সামাজিক পরিবেশ এক নতুন রূপ নেয়। শীতকালকে ঘিরে যে আবহমান সংস্কৃতি ও আনন্দমুখর পরিবেশ গড়ে ওঠে, তা দেশের মানুষের জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
ভোরবেলায় ঘন কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ এবং গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু এক অনন্য দৃশ্য তৈরি করে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা গ্রামবাংলার ফসলি জমি ও সবুজ প্রকৃতি যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশের আভাস দেয়। বিশেষ করে সূর্যের প্রথম কিরণে শিশিরবিন্দু ঝলমল করে ওঠে, যা শীতকালের একটি চিরচেনা কিন্তু মুগ্ধকর দৃশ্য।
বাংলার মাটিতে শীতকালের অন্যতম আকর্ষণ সরিষার খেত। হলুদ সরিষা ফুলের বিশাল ক্ষেত এক মোহময় দৃশ্য সৃষ্টি করে। এটি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, বরং কৃষির গুরুত্বপূর্ণ অংশও। সরিষার ফুলে মৌমাছিদের গুঞ্জন শীতকালের সকালে এক বিশেষ সুরের আবহ তৈরি করে। শীতকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো আরও সুন্দর মনে হয়। এ সময় পাহাড়ে কুয়াশার আস্তরণ এবং নদীগুলোতে ধোঁয়াটে আবহাওয়া দেখা যায়। সিলেটের চা-বাগানগুলোও শীতকালে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণে পরিণত হয়।
শীতকাল বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের জন্য বায়ু মানের দিক থেকে অত্যন্ত সংকটপূর্ণ সময়। এ সময় বায়ুমণ্ডলে ধূলিকণা এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়া এবং নিম্ন তাপমাত্রার কারণে দূষিত বস্তুকণা বাতাসে বেশি সময় ধরে স্থির থাকে। শীতকালে ইটভাটার কাজ তীব্রভাবে চলে...
শীতকালের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো পিঠা উৎসব। গ্রাম থেকে শহর—সবখানেই শীতকালে পিঠার আয়োজন লক্ষ্য করা যায়। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, দুধপিঠা ইত্যাদি নানা ধরনের পিঠা তৈরি হয়। এই সময় পিঠা খাওয়ার উৎসব মানুষের মধ্যে আনন্দ ও মিলনের এক নতুন উপলক্ষ সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশে শীতকাল বিয়ের মৌসুম হিসেবে পরিচিত। ঠাণ্ডা ও আরামদায়ক আবহাওয়ার কারণে এ সময় বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হয়। গ্রামে-গঞ্জে ও শহরে নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। শীতকালে গ্রামে ও শহরে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা এবং পিকনিক আয়োজন করা হয়। বিদ্যালয়, কলেজ এবং অফিসে এ সময় পিকনিক একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কার্যক্রম হয়ে ওঠে।
শীতকাল বাংলাদেশে পর্যটনের সেরা সময়। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন, বান্দরবান এবং রাঙামাটিতে এ সময় দেশি-বিদেশি পর্যটকের ঢল নামে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া এবং পরিষ্কার আকাশ পর্যটনকে উপভোগ্য করে তোলে।
আরও পড়ুন
অপরদিকে, শীতকাল বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের জন্য বায়ু মানের দিক থেকে অত্যন্ত সংকটপূর্ণ সময়। এ সময় বায়ুমণ্ডলে ধূলিকণা এবং বিভিন্ন ক্ষতিকারক গ্যাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। শীতকালে শুষ্ক আবহাওয়া এবং নিম্ন তাপমাত্রার কারণে দূষিত বস্তুকণা বাতাসে বেশি সময় ধরে স্থির থাকে। শীতকালে ইটভাটার কাজ তীব্রভাবে চলে। এসব ভাটায় ব্যবহৃত নিম্নমানের জ্বালানি (কয়লা, কাঠ) এবং তাপ উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড ও ধূলিকণা বাতাসে মিশে যায়।
ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা অত্যধিক। এসব যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া বাতাসের মানকে দ্রুত খারাপ করে তোলে। শীতকালে কুয়াশা এবং ঠাণ্ডার কারণে বায়ুর গতিবেগ কমে যায়। ফলে ধূলিকণা এবং দূষিত গ্যাস বাতাসে জমাট বেঁধে থাকে।
শীতকালে বায়ু দূষণ মানুষের স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে PM₂.₅ ও PM₁₀-এর মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শীতকালে ঢাকাসহ বাংলাদেশের শহরগুলোতে বায়ুর মান বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকে। বায়ু দূষণ সরাসরি শ্বাসকষ্ট, ফুসফুস ক্যান্সার, হৃদরোগ এবং শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। দূষণের ফলে গ্রামীণ এলাকাতেও গাছপালার বৃদ্ধিতে বাধা তৈরি হয়।
শীতকালে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যার প্রাদুর্ভাব ঘটে। শুষ্ক আবহাওয়া, ঠাণ্ডা তাপমাত্রা এবং বায়ু দূষণ একত্রিত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্যকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করে। শীতকালে ভাইরাস সংক্রমণের হার বেড়ে যায়। সর্দি-কাশি, জ্বর এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা এই সময়ের সাধারণ রোগ। বয়স্ক এবং শিশুদের মধ্যে এসব রোগের প্রকোপ বেশি।
ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, যেমন নিউমোনিয়া এবং ব্রঙ্কাইটিস, শীতকালে সাধারণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্কদের এই রোগের ঝুঁকি বেশি। শীতকালের বায়ু দূষণ অ্যাজমা এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগকে তীব্র করে তোলে। শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকায় ত্বক শুষ্ক এবং ফাটল ধরা শুরু করে। ঠোঁট ফাটা এবং একজিমার মতো সমস্যা সাধারণ।
শীতকালীন তাপমাত্রা এবং কুয়াশার কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল এবং হাওর অঞ্চলের মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, শীতকালে নিম্ন তাপমাত্রা এবং বায়ু দূষণ হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। রক্ত সঞ্চালনের সমস্যা এবং উচ্চ রক্তচাপ এই সময় বেশি দেখা দেয়। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র ব্যবহার, পুষ্টিকর খাবার খাওয়া, ঘরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখা এবং ধূলিকণা থেকে বাঁচতে মাস্ক ব্যবহারে ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগান্তি কমিয়ে আনা যায়।
শীতকালীন তাপমাত্রা এবং কুয়াশার কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল এবং হাওর অঞ্চলের মানুষ শীতবস্ত্রের অভাবে প্রচণ্ড কষ্ট ভোগ করে। রাতে ঠাণ্ডার কারণে অনেক শিশু এবং বয়স্ক মানুষ রোগাক্রান্ত হয়। কুয়াশার কারণে যানবাহনের গতি কমে যায়। দৃশ্যমানতা কম থাকায় সড়ক দুর্ঘটনা এবং যানজট বৃদ্ধি পায়। ট্রেন এবং বিমানের সিডিউল ঠিক রাখতে সমস্যা হয়। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের জন্য শীতকাল অত্যন্ত কষ্টকর। ঠাণ্ডার কারণে কাজ করতে কষ্ট হয়, কিন্তু জীবিকা নির্বাহের জন্য তারা বাধ্য হয় বাইরে কাজ করতে।
বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে শীতকাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শীতকালে রবি শস্য এবং নানা ধরনের শাকসবজি উৎপাদিত হয়। বোরো ধানের চাষ শীতকালে শুরু হয় এবং এটি দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে বিবেচিত। সরিষার হলুদ ফুল শীতকালের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। সরিষা তেল উৎপাদনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শীতকালে বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, গাজর, শিম, বেগুন, এবং লাউয়ের মতো শাকসবজি ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়। এই সবজিগুলো দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। শীতকালে আলুর চাষ সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। এটি দেশের অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। শীতকালের কুয়াশা ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে। তাপমাত্রা খুব কমে গেলে ফসলের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের শীতকাল একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং উৎসবের সময়, অন্যদিকে এটি পরিবেশগত, স্বাস্থ্যগত এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। শীতকালীন বায়ু দূষণ এবং ঠাণ্ডাজনিত রোগ মোকাবিলায় সরকার ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শীতকাল দেশের কৃষিক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি একটি সংগ্রামের সময়। সঠিক পরিকল্পনা এবং পরিবেশবান্ধব কার্যক্রমের মাধ্যমে শীতকালকে একটি স্বাস্থ্যকর এবং আরামদায়ক ঋতুতে পরিণত করা সম্ভব। শীতকাল প্রকৃতির এক অপূর্ব উপহার। এটি প্রকৃতি এবং মানুষের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধনের প্রতীক। এর প্রভাব, সমস্যার দিকগুলো বিবেচনায় রেখে যথাযথ ব্যবস্থাপনা করলে এই ঋতুটি আরও উপভোগ্য হতে পারে।
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ।। ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)