ওস্তাদ জাকির হোসেন : তবলার জাদুকরী সুর স্রষ্টা
সংগীতের বিচিত্র ধারার মধ্যে তবলা অন্যতম একটি মাধ্যম। এই তবলার মূল মন্ত্র হলো ‘সম’। তবলার সব বিষয়বস্তু বাজানো শুরু হয় সম থেকে এবং সমাপ্তি ঘটে এই সম-এ এসেই। ওস্তাদ জাকির হোসেন হলেন এই ‘সম’-এরই একটি সমার্থক।
তাকে নিয়ে বলতে গেলে দু-একটি কথাতে যথোপযুক্ত অনুভূতি ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তার পিতা ওস্তাদ আল্লা রাখা খান পাঞ্জাব ঘরানার একজন প্রাণপুরুষ। তাকে সংগীত জগতে সম্মান প্রদর্শনের জন্য সবাই ‘আব্বাজি’ বলে সম্বোধন করতেন। তারই সুযোগ্য সন্তান হলেন ওস্তাদ জাকির হোসেন, যিনি ভারতীয় সংগীত ইতিহাসে খুব অল্প বয়সেই ‘ওস্তাদ’ খেতাব পেয়েছিলেন।
তিনি এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি সব সংগীতজ্ঞদের কাছেই ছিলেন সমাদৃত। বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে তবলাকে দেখলেই বা এই বিষয়ে আলোচনা হলে খুব সাবলীল ভাবেই যে নামটি উঠে আসে তিনিই হলেন ওস্তাদ জাকির হোসেন। তিনি শুধু তবলাতেই তার জাদু দেখাননি বরং সাধারণ মানুষের মাঝে তবলাকে নিয়ে গিয়েছেন খুব সাবলীল একটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এবং তবলা যে একটি মনের ভাব আদান-প্রদানের মাধ্যম হতে পারে তা তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তবলার শাস্ত্রীয় বাদনগত বিষয়ে তথা বোলবাণীর উপস্থাপন, প্রয়োগ বিধি, বাদন শৈলী, লয় কল্পনা ইত্যাদিতে তিনি যেমন ছিলেন সিদ্ধহস্ত তেমনই তিনি খুব সাবলীলভাবেই তবলার শাস্ত্রীয় বোল ও বাণীর সংমিশ্রণে উপস্থাপন করতেন বৃষ্টির শব্দ, বাঘ ও হরিণ শিকার, ট্রেন চলাচলের শব্দ, ঘোড়ার চলার শব্দ ও গতি, ইঁদুরের শব্দ, ছোট ও বড় হাতির নানা রকম গতিবিধি, শঙ্খ বা শাঁখের ধ্বনি, শিবের ডমরু, দৈনন্দিন জীবনের নানান রকম ঘটনা, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলাসহ পশ্চিমা দেশের ব্যান্ড মিউজিক যেমন জ্যাজ, ব্লুজ, ফিউশন ইত্যাদি ভিন্ন ধরনের বিষয়বস্তু। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিমাদেশসহ বিশ্বের সব দেশে তবলা হয়ে ওঠে জনপ্রিয়।
এমনকি যেসব দেশে যারা তবলা শব্দটি কোনোদিন শোনেননি বা জানেনও না তাদের সবার কাছেও তবলা হয়ে ওঠে একটি অসাধারণ বাদ্যযন্ত্র এবং ধীরে ধীরে জাকির হোসেনের হাত ধরেই তবলার সব পরিভাষা যেমন পেশকার, কায়দা, রেলা, গত, পড়ন ইত্যাদি নানান বিষয় তারা জানতে ও বুঝতে, এমনকি শিখতেও শুরু করেন।
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে তবলাকে দেখলেই বা এই বিষয়ে আলোচনা হলে খুব সাবলীল ভাবেই যে নামটি উঠে আসে তিনিই হলেন ওস্তাদ জাকির হোসেন। তিনি শুধু তবলাতেই তার জাদু দেখাননি বরং সাধারণ মানুষের মাঝে তবলাকে নিয়ে গিয়েছেন খুব সাবলীল একটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে
অতীতের তবলার ইতিহাস পড়ে যতদূর জানা যায়, তবলা যথেষ্ট অবহেলিত একটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হতো এবং বিশ্বের দরবারে এটি মূলত পরিচিত ছিল সংগত-সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হিসেবে। কিন্তু ওস্তাদ জাকির হোসেন এই বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে গেছেন হিমালয়ের চূড়ায়।
তবলার বাদন ও উপস্থাপন শৈলীতে ছিল ঘরনাগত নানান গোঁড়ামি যেগুলো তিনি ভেঙে দেন এবং শুরু হয় তবলার এক নতুন জয়যাত্রা। তিনি ঘরানাগত শাস্ত্রীয় অবকাঠামো বজায় রেখে সব ঘরানার বোলই বাজাতেন। এ বিষয়ে তার অনেক সাক্ষাৎকারে বলতে দেখা গেছে, পূর্বজরা যা করে গেছেন আমরা সেই পথ অনুসরণ করে তবলা বাদনশৈলীকে বহন করে চলেছি।
আরও পড়ুন
সংগীতাঙ্গনে যারাই যে গুরুর কাছে তবলার তালিম গ্রহণ করুক না কেন ওস্তাদ জাকির হোসেনকে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। এই বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার উপস্থাপন না করলেই নয়। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অধ্যাপক সুধীরকুমার সাক্সেনা এবং পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর কাছে তালিম গ্রহণ করার। একবার তালিম নেওয়ার সময় পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন যে, ‘সব তবলাবাদকের চেয়ে জাকির ভাই দশ বছর এগিয়ে।’ এত বড় কিংবদন্তি তথা পণ্ডিতদের কাছ থেকে তালিম গ্রহণ করা সত্ত্বেও আমি ব্যক্তিগতভাবে ওস্তাদ জাকির হোসেনকে আমার ভাবগুরু হিসেবে শ্রদ্ধা করি।
আরও অভিজ্ঞতা আছে যা এখনো সজীব। ২০১৩ সাল। ব্লুজ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন ঢাকায়। অনুষ্ঠানস্থল চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র, বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। সংগীতশিল্পী শারমিন সাথী ইসলাম ময়না ‘সৃজন ছন্দে’ নামক একটি ধ্রুপদ আঙ্গিকের নজরুল সংগীত গেয়েছেন। আমি বড় মুখের একটি পাখোয়াজে সংগত করি। অনুষ্ঠান শেষে আমার মতো ক্ষুদ্র একজন তবলা শিক্ষার্থীকে আশীর্বচন দিতে পিছ পা হননি ওস্তাদ জাকির হোসেন। সেই আশীর্বাদবাণী আমার তবলায় চলার পথকে বিশালভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলাদেশে যখন শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎসব বসতো তখন তার বাজনা শুনতে সংগীত গুণীজনসহ সংগীত শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটতো। এরমধ্যে একদল ছিলেন, যারা শুধুমাত্র জাকির হোসেনকে দেখতেই আসেন। সাধারণ মানুষের ধারণা হলো, তবলাবাদক হতে হলে তার মতো সুদর্শন হতে হবে, অন্তত আর কিছু হোক না হোক তার মতো চুলের ধরন তো হতেই হবে।
ওস্তাদ জাকির হোসেন ছিলেন অসম্ভব বিনয়ী একজন মানুষ। বেঙ্গল ক্লাসিক্যাল মিউজিক ফেস্টিভ্যালে পণ্ডিত শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাজিয়েছেন। তার বাজনা শেষে জাকির হোসেন নিজে এসে শুভঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘শুভঙ্কর ভাই আপনার সঙ্গতের চিন্তা তথা লয়-লয়কারী, তেহাই-এর ধরন পুরোপুরি ভিন্ন এক দর্শনের। যা সচরাচর খুব একটা তবলাবাদকের মধ্যে দেখা যায় না।’
উনি এমনভাবেই সব মানুষদের প্রতি সম্মান, স্নেহ ও ভালোবাসা প্রকাশ করতেন আর তার এই গুণই তাকে করেছে অনন্য। জগৎখ্যাত কিংবদন্তি বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মুখে এটা শোনা। ওস্তাদ জাকির হোসেন এত বিশ্ব ভ্রমণ করেছেন যে, উনার প্রতিটি ফ্লাইটের রুট এবং সময় মুখস্থ ছিল। এছাড়া কত স্বল্প সময়ের মধ্যে একজন শিল্পী এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারবেন সেটিও উনি খুব ভালোভাবে বলে দিতে পারতেন।
অতীতের তবলার ইতিহাস পড়ে যতদূর জানা যায়, তবলা যথেষ্ট অবহেলিত একটি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হতো এবং বিশ্বের দরবারে এটি মূলত পরিচিত ছিল সংগত-সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হিসেবে। কিন্তু ওস্তাদ জাকির হোসেন এই বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে গেছেন হিমালয়ের চূড়ায়।
এমনও নাকি হয়েছে যে, অনেক কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞরা তাকে ফোন করে ফ্লাইটের বিষয়ে গাইড লাইন নিতেন। এত বড় মাপের ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি খুব আনন্দের সাথেই এগুলো শেয়ার করতেন এবং তার মধ্যে কোনো অহমিকা বোধ ছিল না।
তার স্মৃতিশক্তি এতটাই প্রখর ছিল যে উনি যদি একবার কারও সাথে দেখা বা পরিচিত হতেন তাকে সারাজীবন মনে রাখতে পারতেন।
কোনো তবলাবাদকের সাথে পরিচিত হলে তিনি জিজ্ঞাস করতেন, ‘তোমহারা গুরু কন হ্যায়?’ যখন তিনি গুরুর নাম জানতেন তাকে শ্রদ্ধার সাথে সম্মান জানাতেন, এমনকি তাকে না চিনলেও সেই সম্মান জানাতেন। এই গুণটা খুব কম সংখ্যক তবলাবাদকদের মধ্যে আছে বলেই আমার ধারণা।
গান, নৃত্য, যন্ত্র সংগীত, ফিউশন, ইউরোপিয়ান তথা বৈশ্বিক সংগীতের যেকোনো ক্ষেত্রেই ওস্তাদ জাকির হোসেনের সাথে সঙ্গতের তুলনা নেই। তার বাদনশৈলী দর্শকদের হিপনোটাইজ করে রাখতো। তিনি যখন যার সাথে সংগত করতেন গোটা বিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করতেন যেন তার সংগতের মাধ্যমে মনে হতো পুরো মঞ্চ, শিল্পী ও শ্রোতা তার দখলে। তার বাদনশৈলী এবং সংগীতচিন্তা বিশ্লেষণে বলা যায়, তিনি হলেন তাল বাদ্যের রাজা।
আমরা সবাই জানি যে শিল্পীর মৃত্যু হলেও শিল্পের কখনো মৃত্যু হয় না। ওস্তাদ জাকির হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তার রেখে যাওয়া শিল্পকর্মগুলো থেকে যাবে আমৃত্যু। তিনি সব সংগীতজ্ঞের আত্মার ওস্তাদ। তার মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত কিন্তু তার রেখে যাওয়া অজস্র ভাণ্ডারের কোনো পরিসমাপ্তি নেই। তার এই সংগীতকর্ম এবং রেখে যাওয়া অজস্র ভাণ্ডারের মাধ্যমেই তিনি থাকবেন অমর।
স্বরূপ হোসেন ।। সহকারী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়