বেকারত্ব দূর করতে বিশ্বব্যাপী দক্ষ জনশক্তির গুরুত্ব বেড়েছে
বেকারত্ব বর্তমান সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কোনো কোনো রাষ্ট্রে শিল্পায়নের অভাব, পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের অভাব, সমন্বয়হীন শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সমাজ ব্যবস্থার সমন্বয়হীনতা, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির উন্নয়নের অভাব, কর্মমুখী শিক্ষাব্যবস্থার অভাবের কারণেই বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আবার কোনো কোনো রাষ্ট্র এসবের যথাযথ সমাধানের মধ্য দিয়ে নিজেদের দেশকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করেছে। বেকারত্ব নিয়ে মনীষীদের বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, বেকারত্বের সবচেয়ে খারাপ দিক ক্ষুধা নয় বরং সবচেয়ে বড় খারাপ হলো অলসতা। সাফল্য তোমার কাছে আসবে না। তোমাকে অর্জন করতে হবে। আর এটা না বুঝলেই তোমাকে বেকারত্বের শিকার হতে হবে।
করোনাকালীন দুর্যোগের পর অনেক দেশের শ্রমবাজার শক্তিশালী হয়েছে প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। আর যারা বেকারত্ব দূর করতে সক্ষম হয়েছে—তারা মূলত অলসতাকে দূর করে শ্রম ও মেধাকে কাজে লাগিয়েছে। ধনী বিশ্বে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশেরও কম। যা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কম। তবে ধনী দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও পর্তুগালের মতো দেশে বেকারত্বের হার সবসময়ই বেশি থাকে। উন্নত বিশ্বের সাম্প্রতিক শ্রমবাজারের শক্তিশালী সূচকে অবাক অনেক অর্থনীতিবিদ।
বিভিন্ন অবকাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে কাজে লাগিয়ে উন্নত দেশগুলো ২-৩ বছরে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে বেকারত্বকে অনেকটা না বলে দিয়েছে। এমনকি সারাবিশ্বে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রের সুযোগ-সুবিধা এবং জীবনযাত্রার ভারসাম্যের জন্য লুক্সেমবার্গ হলো সেরা দেশ। গেল কয়েক বছর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শ্রমবাজার উন্নত হয়েছে।
আবার ইউরোপের দেশগুলোতে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপোড়া এবং সংহতি বাড়িয়ে নিজেদের অঞ্চলকে মোটামুটিভাবে বেকারত্বকে শূন্যের কোটায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। তাদের ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে একটি বিরাট সংহতিব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রের সুযোগ-সুবিধা এবং জীবনযাত্রার ভারসাম্যের জন্য লুক্সেমবার্গ হলো সেরা দেশ। গেল কয়েক বছর উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় শ্রমবাজার উন্নত হয়েছে।
এর মধ্যে সাইপ্রাস হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র, যারা ভৌগোলিকভাবে ইউরোপ মহাদেশের অংশ না হলেও সাংস্কৃতিক কারণে এবং একই সঙ্গে গ্রিসের মধ্যস্থতায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ লাভ করে। প্রশাসনিকভাবে ব্রাসেল্স, লুক্সেমবার্গ সিটি, ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ এবং জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট—এই চার শহরকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজধানী বলা হয়।
এদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মূল পার্লামেন্টের অবস্থান বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেল্সে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোর্ট অব জাস্টিসের অবস্থান লুক্সেমবার্গ সিটিতে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সেন্ট্রাল ব্যাংক জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে।
অন্যদিকে ইউরোপীয় কাউন্সিল থেকে শুরু করে ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটসসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার সদর দপ্তর ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহরে অবস্থিত। বিশ্ব রাজনীতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে অন্যতম প্রধান নিয়ামক শক্তি।
পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম অর্থনৈতিক অঞ্চল। শান্তি ও মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্ববাসীর কাছে ইতিমধ্যে অন্যতম এক আস্থার প্রতিশব্দ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্য স্থাপনে সংস্থাটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বিশেষ করে ফ্রান্স, জার্মানি কিংবা গ্রেট ব্রিটেনের মতো চির বৈরী দেশগুলোর মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নকে বিশেষভাবে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ২০১২ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এছাড়া ইউরোপের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোয় অর্থনৈতিক সংস্কারে এবং বেকারত্ব দূরীকরণে এ সংস্থাটির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো।
আরও পড়ুন
সেনজেন চুক্তির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর নাগরিকেরা কোনো ধরনের পাসপোর্ট এবং ভিসা ছাড়া এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারেন এবং তাদের পছন্দ অনুযায়ী স্থায়ীভাবে যেকোনো দেশে বসবাসের পাশাপাশি চাকরি করতে পারেন কিংবা ব্যবসা করতে পারেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, আইসল্যান্ড ও লিখটেনস্টেইন সেনজেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কারণে ইউরোপ মহাদেশের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে এক কাতারে আনা সম্ভব হয়েছে। যেকোনো প্রয়োজনে তারা একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে। বেকারত্ব দূর করতে তাদের এই সংহতি কিংবা সংযুক্তি একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করেছে। অনেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধী।
যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে চলে যেতে পারে। নেদারল্যান্ডসের রক্ষণশীল জোটের অনেক রাজনৈতিক নেতা বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরোধী। অনেকের ধারণা, সেখানে নিম্নমানের চাকরি বাড়িয়েছে। কিন্তু আশার কথা হলো, বেকারত্ব দূরীকরণে যথেষ্ট ভারসাম্যও তৈরি হচ্ছে।
বেকারত্ব দূরীকরণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্রে। ছোট হলে কী হবে, লুক্সেমবার্গ অনেক ধনী রাষ্ট্র। গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের তথ্যমতে, বিশ্বের ধনী দেশের প্রথম কাতারে হচ্ছে লুক্সেমবার্গ। বেকারের হার তেমন উল্লেখযোগ্য না। সামাজিক সুরক্ষা অভাবনীয়। এই ছোট দেশে ১৪০টির বেশি ব্যাংক রয়েছে।
বলতে পারেন ইউরোপের অর্থনৈতিক রাজধানী এই দেশ। দেখতে অনেক সুন্দর ছোট, বড় মিলিয়ে প্রায় ১০০ এর বেশি দুর্গ বা প্রাসাদ আছে এই দেশে। দুর্গের দেশও বলা হয়ে থাকে লুক্সেমবার্গকে। এই দেশে পর্যটকদের জন্যও বিশেষ সুবিধা করে দিয়ে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়েছে।
উইলিয়াম স্কয়ারে প্রতি সপ্তাহে রাস্তায় বাজার বসে। এই দেশকে ট্যাক্সের স্বর্গ দেশ বলা হয়। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে ব্যবসা করলে ব্যবসায়ীকে অনেক ট্যাক্স বা কর দিতে হয়, কিন্তু লুক্সেমবার্গে ঠিক উল্টো। এজন্যই অনেক কোম্পানির সদর দপ্তর এই দেশে অবস্থিত। তাছাড়া ব্যবসায়ীরা চাইলে কোনো অসাধারণ আইডিয়া নিয়ে কাজ করতে পারেন। সরকার সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ট্যাক্স নিয়ে তেমন ঝামেলায় ফেলবে না।
আধুনিককালে বৈদেশিক বাণিজ্যের অনেক কিছু নির্ভর করে বড় এবং ধনী দেশগুলোর আনুকূল্যের ওপর। বেকারত্ব দূরীকরণেও এর ব্যতিক্রম নেই। অনেক ক্ষেত্রে ছোট এবং মাঝারি দেশগুলো তাদের ভেতর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য পরিচালনার জন্য জোটবদ্ধ হয়ে কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে।
বিশ্বায়ন সর্বঅবস্থাতেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অগ্রগতি একটি দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও বর্তমান বিশ্ব অনেক এগিয়েছে। ইন্টারনেট সুবিধা বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই বিদ্যমান। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বহু দেশ বেকারত্ব দূর করেছে। চীনে শিল্প উৎপাদন দ্রুততর হচ্ছে এবং পরিষেবা শিল্প ভালোভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশব্যাপী বড় আকারের শিল্পের সংযোজিত মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থান পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে।
বেকারত্ব দূর করতে একটি দেশের উন্নয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নে আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান উভয়ের ক্ষেত্রে সমগুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে। কেননা আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠান অধিক হারে প্রতিষ্ঠা করলে কেবল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয় না বরং দীর্ঘমেয়াদে একটি রাষ্ট্র সুস্পষ্ট উন্নয়নের সুযোগ পায়। অন্যদিকে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়লে এবং উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা গেলে তা থেকে লাভ সরাসরি দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে থাকে।
বেকারত্ব দূর করতে একটি দেশের উন্নয়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়নে আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান উভয়ের ক্ষেত্রে সমগুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে।
আমরা সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রত্যাশা করি। কিন্তু কীভাবে সেই উন্নয়ন হবে তা নিয়ে যথাযথ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন হওয়া না হওয়া নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন থেকে তরুণ যুব গোষ্ঠীকে দক্ষ করে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনো এ বিষয়ে আশানুরূপ ফলাফল আসেনি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে তরুণদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে দেশ কাজ করলেও আমাদের এ বিষয়ে হতাশা রয়েছে। আমাদের দেশে তরুণদের নিজেদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পরিমাপে আত্মবিশ্বাসের সংকট রয়েছে।
তাদের বিদ্যমান এই শঙ্কা ও হতাশা দূর করতে হলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং ব্যক্তিগতভাবে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাংস্কৃতিক খাতে যুব সমাজের জন্য শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, সেটির যথাযথ ব্যবহার করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
দেশের ৪ কোটি ৫৯ লাখ তরুণ-যুবগোষ্ঠীকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হলে, দেশকে কোনোভাবেই এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ এই তরুণগোষ্ঠীই সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল এবং কর্মক্ষম। তাদের সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন দ্রুততর এবং টেকসই করা সম্ভব। আর এ জন্য শুধু রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ নয়, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আমরা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে দেশে বিনিয়োগের কার্যকর অনুকূল পরিবেশ নেই।
অন্যদিকে সরকারি খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে, এটি ঠিক। কিন্তু সরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে দুর্নীতির হার বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ যদি আগামী দিনের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে অবশ্যই যুব সম্প্রদায়কে যথাযথ এবং দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার প্রতি আন্তরিক দৃষ্টি স্থাপন করতে হবে।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়