বায়ু দূষণে যেসব রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ে
বায়ু দূষণের কারণে যক্ষ্মার তীব্রতা বাড়ে। যক্ষ্মা নিয়ে সবার ধারণা ছিল—‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’। আগে যক্ষ্মা রোগটা শুনলে মানুষ ভয় পেত, এমনকি যক্ষ্মা হয়েছে শুনলে মেয়ে বা ছেলেদের ওই পরিবারের সাথে বিয়ে দিতে চাইতো না। এখন মানুষ অনেক সচেতন হয়েছে, বুঝতে শিখেছে, যক্ষ্মা হলে রক্ষা হয় এবং ওষুধ খেলে যক্ষ্মা সম্পূর্ণরূপে ভালো হয়ে যায়। সচেতনতা এবং প্রতিরোধব্যবস্থা মানুষকে যক্ষ্মা থেকে রক্ষা দিয়েছে। এইরকম সচেতনতা সব বিষয়ে প্রয়োজন, ছোট-বড় সব রোগের ক্ষেত্রে।
এখন যক্ষ্মা থেকে ফিরি অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি বিষয়ে। অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির কারণ কী বা বাড়ে কেন? এলার্জির উপাদান, বায়ু দূষণ এবং অন্যান্য পরিবেশগত রাসায়নিকসহ অনেক পরিবেশগত কারণগুলোর জন্য হাঁপানি বাড়ে।
কিছু পদার্থ আছে যেগুলো মানুষের হাঁপানির কারণ বাড়ায় যেমন—কীটনাশক, পরাগ রেণু ও ফুলের রেণু, সূর্যরশ্মি ডাস্ট মাইট, বাসার কার্পেট, মোল্ড বা ছত্রাক, ডিটারজেন্ট ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, ল্যাটেক্স বা বিশেষ ধরনের রাবারের তৈরি গ্লাভস, ধাতু বা কাঠের ধূলিকণা, ফরমালডিহাইড, গ্লুটারালডিহাইড, অ্যানহাইড্রাইড, আঠা, রং, নির্দিষ্ট কিছু খাবার, ধুলাবালি, গরম অথবা ঠান্ডা আবহাওয়া, ঘাম ইত্যাদি।
কিছু বিষয় আছে যেগুলো হাঁপানি রোগ সৃষ্টি করে এবং তা দীর্ঘমেয়াদি হয়। বংশগত কারণেও অ্যাজমা হতে পারে। যেকোনো পশুর লোম, ছত্রাক হাঁপানির জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। বায়ু দূষণ, সিগারেটের ধোঁয়া শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে তোলে
তবে অ্যাজমার সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষণ নেই। কিছু বিষয় আছে যেগুলো হাঁপানি রোগ সৃষ্টি করে এবং তা দীর্ঘমেয়াদি হয়। বংশগত কারণেও অ্যাজমা হতে পারে। যেকোনো পশুর লোম, ছত্রাক হাঁপানির জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। বায়ু দূষণ, সিগারেটের ধোঁয়া শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে তোলে।
হাঁপানি বা অ্যাজমাতে কী হয়?
শ্বাসনালি সরু হয়ে যায় এবং ফুলে যায়। শ্বাসনালিতে অতিরিক্ত শ্লেষ্মা তৈরি হয়। কখনো কখনো হাঁপানি এবং তীব্র ব্রঙ্কাইটিস একসাথে হয়। এই অবস্থাকে হাঁপানি ব্রঙ্কাইটিসও বলা হয়।
হাঁপানি ব্রঙ্কাইটিস হলো, ব্রঙ্কাসে প্রদাহ এবং শ্লেষ্মা বৃদ্ধি, যা প্রায়শই অ্যালার্জি থেকে বিকাশ লাভ করে। তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD)। ফুসফুসের রোগের একটি প্রকার হলো, ব্রঙ্কাইটিস বা এমফিসেমা বা উভয়ই।
আরও পড়ুন
হাঁপানির সাথে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD)-এর বিভ্রান্ত হয়। যদিও উভয় রোগেই একই রকম উপসর্গ দেখা যায়, তবে অন্তর্নিহিত কারণ, শারীরিক উপস্থাপনা, রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভিন্ন।
কীভাবে হাঁপানি/অ্যাজমা নির্ণয় করা হয়?
১। চিকিৎসার ইতিহাস; ২। পরীক্ষা : স্পাইরোমেট্রি (Spirometry)—ফুসফুসের কার্যকারিতা পরীক্ষা। ইমেজিং পরীক্ষা—বুকের এক্স-রে। কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি (CT scan)। অ্যালার্জি পরীক্ষা—রক্ত পরীক্ষা। স্পুটাম (লালা) ইওসিনোফিল কাউন্ট।
অ্যাজমার প্রভাব
অ্যাজমা বা হাঁপানি হলো ফুসফুসে বাতাস চলাচলের জন্য শ্বাসনালিগুলোয় দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগ। শ্বাসযন্ত্রের প্রধান শ্বাসনালিগুলো ব্রঙ্কি নামে পরিচিত। এগুলোর ছোট ছোট শাখাগুলো বলা হয় ব্রঙ্কিওল। হাঁপানির সময় বিশেষত এই ব্রঙ্কি এবং ব্রঙ্কিওল-এ দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ঘটে, যার কারণে মসৃণ পেশিগুলো সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে সংকোচনের পুনরাবৃত্তির ফলে শ্বাসনালিগুলো ফুসফুসে বাতাস আদান প্রদানে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের ফলে তৈরি হয় অ্যাজমা।
অ্যাজমার কারণ
মূলত পরিবেশ, বংশগত ও বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার ওপর ভিত্তি করে তীব্র অ্যাজমা দেখা দেয়। জিনগত প্রভাবের কারণে ছোটবেলা বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে থেকেই হাঁপানি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অপরদিকে, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরে এই রোগ হওয়ার পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী থাকে পরিবেশগত প্রভাব।
বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি শ্বাসকষ্টের শিকার হয় শিশুরা। দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের ওপরই বেশি দেখা যায়। এর প্রভাবে হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয় তারা। আমাদের শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও বাতাসের গুণগত মান উন্নত করতে সবাইকে মিলে একসাথে পরিবেশ উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। বায়ু দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর।
বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি শ্বাসকষ্টের শিকার হয় শিশুরা। দূষিত বাতাসের ক্ষতিকর প্রভাব শিশুদের ওপরই বেশি দেখা যায়। এর প্রভাবে হাঁপানি ও নিউমোনিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হয় তারা
পরিবেশ দূষণের বেশ কয়েকটি ভাগ আছে, তার মধ্যে অন্যতম বায়ু দূষণ, পানি দূষণ ও শব্দ দূষণ। পরিবেশ দূষণের ফলে শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়, গর্ভাবস্থায় মা ও শিশু ঝুঁকির মধ্যে থাকে, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়ে, অসংক্রামক রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন সবকিছুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
এই শীতের সময় বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় নিউমোনিয়া। নিউমোনিয়া হলো এক ধরনের ফুসফুসের প্রদাহ। আমাদের ফুসফুসের আলভিওলি (Alveoli) বা ছোট ছোট বায়ু থলিতে জীবাণুর সংক্রমণের ফলে এই প্রদাহের সৃষ্টি হয়।
প্রতি বছর পৃথিবীতে লক্ষাধিক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন। বিশেষত শীতকালে শিশু এবং বয়স্কদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। এই রোগ থেকে দূরে থাকতে হলে জানতে হবে কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় এবং দ্রুত নিরাময় করা যায়।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধের কার্যকরী উপায়গুলো হলো—
১। ধূমপান বন্ধ করা;
২। প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের ফ্লু ভ্যাক্সিন দেওয়া;
৩। বাইরে বের হলে নাক ও মুখ মাস্কে ঢেকে রাখা;
৪। ধোঁয়া ও ধুলো এড়িয়ে চলা;
৫। পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস;
৬। নিয়মিত ব্যায়াম করা;
৭। রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা টানা ঘুমানো।
ডা. আয়শা আক্তার ।। উপ-পরিচালক, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল, ঢাকা