শরীরে আমিষ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
সুস্বাস্থ্যের জন্য আমিষ অপরিহার্য। আমিষ হলো একজন ব্যক্তির পেশি, ত্বক, হাড়, অঙ্গ, হরমোন, এনজাইম এবং শরীরের অন্যান্য অংশের প্রধান উপাদান। আমিষ একটি পুষ্টি, যা শরীরের কোষ তৈরি করে এবং মেরামত করতে এর প্রয়োজনীয়তা গুরুত্বপূর্ণ। আমিষ অ্যামিনো অ্যাসিড নামক বিল্ডিং ব্লক দ্বারা গঠিত, যাদের কিছু শরীর নিজে সংশ্লেষিত করতে পারে।
নয়টি অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, যা শরীর সংশ্লেষিত করতে পারে না, এগুলো একজন ব্যক্তির খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হয়। আমিষ ছাড়া কোষের বৃদ্ধি ও মেরামত এবং হরমোন, লোহিত রক্তকণিকা ও এনজাইম উৎপাদন করতে পারে না।
আমিষ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বা কম খেলে কী হয়?
আমিষ অতিরিক্ত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে কারণ মানবদেহ মাত্র ১৬ শতাংশ আমিষ, ৬১ শতাংশ পানি, ১৬ শতাংশ চর্বি, ১ শতাংশ শর্করা ও ৬ শতাংশ মিনারেল দিয়ে গঠিত। আবার শুধু আমিষ কিংবা শুধু নিরামিষ খেলেও দেহ প্রয়োজন মতো তার উপাদানগুলো পাবে না। ফলে শারীরিক সমস্যা দেখা দেবে।
দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গঠনের দিক থেকে মানুষ একই সাথে মাংসাশী ও তৃণভোজী। মানুষ মাংসাশী হলেও তাদের গঠন প্রক্রিয়াটি বেশিরভাগ নিরামিষভোজী। ফলে মানুষ যদি মাংসাশী প্রাণীর মতো শুধুমাত্র প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ করে, তাহলে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, থাইরয়েড, মুটিয়ে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ বা লাইফ স্টাইলজনিত নানা রোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে।
আমিষ কম পরিমাণে খেলেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন—শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি অনুভব করা, পেশির দুর্বলতা, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, শরীরের ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া...
অপরদিকে, আমিষ কম পরিমাণে খেলেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেমন—শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি অনুভব করা, পেশির দুর্বলতা, ক্ষুধা বৃদ্ধি পাওয়া, শরীরের ক্ষত শুকাতে দেরি হওয়া, অপুষ্টিজনিত কোয়াশিওরকর (Kwashiorkor) রোগ সৃষ্টি হওয়া, ত্বক, চুল ও নখের ক্ষয় সাধন করে অল্প বয়সে বার্ধক্য দেখা দেওয়া, পেট, হাত ও পা ফুলে গিয়ে এডিমা সৃষ্টি হওয়া, নিউরোট্রান্সমিটার (Neurotransmitter) বৃদ্ধি, ডোপামিন (Dopamine) এবং সেরোটোনিন (Serotonin) হরমোন নিঃসরণ কমে যেতে পারে।
এর ফলে হতাশা বা অতিরিক্ত রাগান্বিত থাকা, ফ্যাটি লিভার, সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়া, লিভার ও কিডনি রোগ, প্রদাহজনক অন্ত্রের রোগ, অন্যান্য পুষ্টি শোষণের সমস্যা এবং উন্নত ক্যান্সারের কারণ ঘটতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি অতিরিক্ত প্রোটিন গ্রহণের ফলে অন্যান্য প্রয়োজনীয় ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টগুলো হ্রাস করে, বিভিন্ন গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল অভিযোগ, যেমন—কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট ফাঁপা হতে পারে, এবং দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ প্রোটিন গ্রহণ কিডনি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকারক হতে পারে।
মানবদেহের মৌলিক পুষ্টির চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ
মানুষের শরীরের ওজনের প্রতি কিলোগ্রামের জন্য দৈনিক ০.৮ গ্রাম আমিষ প্রয়োজন। এটি হলো মানবদেহের মৌলিক পুষ্টির চাহিদা মেটাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ। এক অর্থে, এটি হলো ন্যূনতম পরিমাণ যা আপনাকে অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কারও ওজন ৭৫ কেজি হয় তবে তার দৈনিক ৬০ গ্রাম আমিষ খাওয়া উচিত। কেউ খুব সক্রিয় হলে তার আমিষের চাহিদা বাড়তে পারে। ক্রীড়াবিদদের দৈনিক শরীরের ওজনের প্রতি কিলোগ্রামে ১.২ থেকে ২ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণ করা উচিত।
গর্ভবতী আর দুগ্ধদানকারী নারীদেরও কিছুটা বাড়তি আমিষ চাহিদা পূরণ করতে হয় বিধায় তাদের স্বাভাবিক আমিষের সঙ্গে বাড়তি দৈনিক ১৩-১৯ গ্রাম আমিষ যোগ করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আমিষ থেকে ক্যালোরি শরীরের মোট ক্যালোরির ১০ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে থাকা প্রয়োজন।
আমিষ জাতীয় খাদ্যের প্রধান উৎসসমূহ
সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় আমিষের ৮৫ শতাংশ উদ্ভিদ থেকে ও ১৫ শতাংশ প্রাণিজ উৎস থেকে গ্রহণ করা উচিত। শিম জাতীয় বীজ, ডাল, ছোলা, শাকসবজি, কাঠ বাদাম, কাজু বাদাম, অলনাট, পাইন নাটস, ব্রাজিল নাটস ও অন্যান্য বীজ, অলিভ অয়েল, মেডিসিনাল নারিকেলের তেল, তিলের তেল, ইত্যাদি উদ্ভিদ জাতীয় আমিষের প্রধান উৎস। অপরদিকে, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শুঁটকি মাছ, বাটার, ইত্যাদি প্রাণিজ আমিষের অন্যতম উৎস।
উদ্ভিদ জাতীয় ও প্রাণিজ আমিষের মধ্যে কোনটি খাওয়া উচিত
উদ্ভিদ জাতীয় ও প্রাণিজ আমিষ দুটোতেই মেলে ২২টি অ্যামাইনো এসিড। মানুষের স্বাস্থ্যগত অবস্থার ওপর ভিত্তি করে বুঝতে হবে কোন প্রোটিনে কী ধরনের সমস্যা। উদ্ভিদ জাতীয় এবং প্রাণীজ উভয় উৎস থেকে প্রোটিন গ্রহণ করা দরকার। এতে সহজেই প্রয়োজনীয় আমিষ উপাদানের চাহিদা মিটে যায়।
প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস হলো মাছ। ফিনফিশ এবং শেলফিশ উভয়ই মানুষের পুষ্টিতে আমিষের অত্যন্ত মূল্যবান উৎস, যা বিশ্বের প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তার প্রায় ৭.৯ শতাংশ এবং মোট প্রাণিজ আমিষের ১৫.৩ শতাংশ সরবরাহ করে।
উদ্ভিদ জাতীয় আমিষের কারণে হৃদরোগ, ডায়াবেটিকস এবং স্থূলতার কারণ হয় না। তাই এই আমিষ বেশি বেশি নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়। প্রাণিজ আমিষ বা মাছ-মাংস অতিরিক্ত খেলে দেহে কিছু ক্ষতিকর প্রভাব দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে শাকসবজি থেকে প্রাপ্ত প্রোটিন কিছুটা দুর্লভ হলেও আমিষের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য নানা ধরনের পুষ্টিগত উপাদান মেলে।
আমিষের চাহিদা পূরণে প্রাণিসম্পদের অবদান
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২০২৪ সালে বাংলাদেশে মাংস ও ডিমের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ৯২.২৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২,৩৭৪.৯৭ কোটি। ২০২৩-২০২৪ সালে, দুধ ২৫০ মিলি/দিন, মাংস ১২০ গ্রাম/দিন এবং ডিম প্রতি বছর ১০৪টি এর চাহিদার বিপরীতে প্রাপ্যতা ছিল যথাক্রমে ২২১.৯ মিলি/দিন, ১৪৩.৭৭ গ্রাম/দিন এবং মাথাপিছু ১৩৫.০৯টি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৪৮ শতাংশ মাংস আসে গবাদি পশু (গরু ও মহিষ), ৪০ শতাংশ হাঁস-মুরগি এবং ১২ শতাংশ ভেড়া ও ছাগল থেকে।
প্রাণিজ আমিষের উৎস হিসেবে মাছের ভূমিকা
প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস হলো মাছ। ফিনফিশ এবং শেলফিশ উভয়ই মানুষের পুষ্টিতে আমিষের অত্যন্ত মূল্যবান উৎস, যা বিশ্বের প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তার প্রায় ৭.৯ শতাংশ এবং মোট প্রাণিজ আমিষের ১৫.৩ শতাংশ সরবরাহ করে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতিদিন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের কমপক্ষে ৪৫-৬০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করা উচিত যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষ।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ সালে মাছের উৎপাদন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ প্রায় ৬০ শতাংশ আমিষের জোগান দেয়। জনপ্রতি বাৎসরিক ২১.৯০ কেজি মাছের চাহিদার বিপরীতে জনপ্রতি বাৎসরিক মাছ গ্রহণ ২৪.৭৫ কেজি। মাছ ভিটামিন 'এ', 'ই' সমৃদ্ধ এবং এর চামড়ায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন 'সি' আছে।
আরও পড়ুন
সামুদ্রিক মাছে প্রচুর পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে, যা গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে। এছাড়াও এতে ক্যালসিয়াম, লৌহ, জিংক, ফসফরাস প্রভৃতি খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা হাড় গঠনে ভূমিকা রাখে। রিবোফ্লাবিন (Riboflavin), থায়ামিন (Thiamine) ইত্যাদির অভাব পূরণে মাছ বিশেষ ভূমিকা পালন করে। মাছ উচ্চ-মানের প্রোটিন এবং উপকারী ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি সুবিধাজনক উৎস।
উচ্চ রক্তচাপ বিশিষ্ট রোগীদের জন্য ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল মাছে নেই বললেই চলে। তাই প্রাণিজ আমিষ হিসেবে মাছ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, বাংলাদেশ এখনো তার নাগরিকদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচক-২০২৪ অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
এছাড়া বিশ্বের ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম। তবুও, অপুষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পরিসংখ্যানগত পরিমিতি উন্নত হয়েছে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অসাধারণ সাফল্য তার জনসংখ্যার বিপরীতে কম প্রোটিনযুক্ত খাদ্যকে বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ খাদ্যে রূপান্তরিত করেছে। বাংলাদেশ আজ এমন একটি ছোট দেশ, যারা মাছের উৎস থেকে অর্ধেকেরও বেশি আমিষ সরবরাহ করে।
মাছের আমিষ অন্যান্য প্রাণিজ আমিষের তুলনায় নিরাপদ
মাংস এবং সামুদ্রিক খাবার উভয়ই সম্পূর্ণ প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস, যার মধ্যে ১০টি প্রয়োজনীয় অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে। তাদের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা হলো—আনস্যাচুরেটেড চর্বি (ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড) এর পরিমাণ বেশি থাকে যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, মাংসে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে বিধায় তা কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তাছাড়া, প্রতিদিন মাছ খাওয়ার সামর্থ্য থাকলেও, মাংস কেনার সক্ষমতা দেশের অধিকাংশ মানুষের নেই। তাই, নিশ্চিতভাবে বলা যায় মাছের আমিষ অন্যান্য প্রাণিজ আমিষের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও নিরাপদ আমিষ।
সর্বোপরি, বাংলাদেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলে, আমাদের খাদ্যতালিকায় সাধারণত চাল, শাকসবজি, অল্প পরিমাণে ডাল এবং মাছ থাকে। এমনকি আয় বৈষম্যের কারণে মাংসের ব্যবহার কম হয়। এই জাতীয় সমস্যাগুলো ছাড়াও, ভাত এবং তরকারি খাওয়ার জন্য সহজ পছন্দ প্রোটিনের তুলনায় উচ্চ স্তরের কার্বোহাইড্রেট।
এই ধরনের খাদ্যতালিকাগত পছন্দের কারণে, আমাদের দেশ বছরের পর বছর ধরে অপুষ্টি এবং অপুষ্টির বোঝার সাথে লড়াই করছে। তবে, দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, হতদরিদ্র হ্রাস এবং মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রাণিজ খাদ্যের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মৎস্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য, পোল্ট্রি বিপ্লব এবং মাংসের ব্যাপক চাহিদা কৃষকদের এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করছে।
বাংলাদেশে গবাদি পশু রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে কারণ হাজার হাজার যুবক গবাদি পশুতে মোটা-তাজাকরণে বিনিয়োগ করছে। ফলে অতি দ্রুত এ দেশের সব মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণে সক্ষম হবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
অধ্যাপক ড. এম এম মাহবুব আলম ।। মৎস্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়