বায়ু দূষণে ঢাকা, পরিত্রাণ কোথায়?

সাম্প্রতিককালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয়ও পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে বায়ু দূষণ অধিকতর প্রাধান্য পাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অন্যান্য সমস্যার মধ্যে যেটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মহামারির থেকেও বেশি ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি হলো বায়ু দূষণ। এছাড়া দেশের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রগুলোয় সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
দ্য ইকোনোমিস্ট-এর ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রতিবছর বসবাস যোগ্য শহরগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে থাকে এবং দুঃখজনকভাবে ঢাকা পৃথিবীর বসবাস যোগ্য শহরগুলোর তালিকায় তলানিতে অর্থাৎ নিচের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর ঢাকাকে বসবাস অযোগ্য শহরে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে যে কারণগুলো দায়ী তার অন্যতম একটি হলো এই বায়ু দূষণ।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ু দূষণ বিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ (একিউএলআই-২০২৩) এ বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস এবং সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা আয়ু হারাচ্ছেন গড়ে প্রায় ৮ বছর।
বাংলাদেশে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস থেকে প্রাপ্ত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ঢাকার ৯ বছরের বায়ুমান সূচক বা AQI এর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)। প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায় যে, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি দূষণ ছিল যার ধারাবাহিকতা ২০২৪ সালেও পরিলক্ষিত হয়। দূষকের মাত্রা অনুযায়ী সূচকের মান বাড়ে।
২০২১ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৫৯, ২০২২ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৬৩ এবং ২০২৩ সালের গড় বায়ুমান সূচক ১৭১। অপরদিকে ২০২৪ সালের প্রথম ১১ মাসের গড় বায়ুমান সূচক ১৬০-তে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার সবচেয়ে কম গড় বায়ুমান সূচক পাওয়া যায় ২০১৭ এবং ২০২০ সালে যা যথাক্রমে ১৪৬ এবং ১৪৫।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস এবং সবচেয়ে দূষিত শহর ঢাকার বাসিন্দারা আয়ু হারাচ্ছেন গড়ে প্রায় ৮ বছর।
২০২০ সালে লকডাউনের কারণে বায়ু দূষণের উৎসগুলো বন্ধ থাকায় দূষণের পরিমাণ কম দেখা যায়। পর্যবেক্ষণ থেকে আরও দেখা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ২০২২ সাল ব্যতীত প্রতি বছরই জানুয়ারি মাসে সর্বোচ্চ গড় বায়ুমান সূচক (২৫০) ছিল এবং সর্বনিম্ন মানগুলো পাওয়া যায় জুলাই (৮৯) এবং আগস্ট (৯৮) মাসের দিকে।
৯ বছরের ডাটা থেকে পাওয়া যায়, জানুয়ারি মাসের গড় বায়ুমান সূচক ২৫০, জানুয়ারি মাস ছাড়া নভেম্বর (১৭৭), ডিসেম্বর (২১৮) এবং ফেব্রুয়ারি (২২১) সারা বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় দূষণের পরিমাণ বেশি ছিল। এ যাবৎকালের ১০৭ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত বায়ু ছিল ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে (২৮১) এবং সর্বনিম্ন গড় বায়ুমান সূচক ছিল ২০২১ সালের জুলাই মাসে (৭৬)।
ক্যাপস-এর গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় বায়ুমান সূচক বা AQI পূর্ববর্তী আট বছরের (২০১৬-২০২৩) নভেম্বর মাসের গড় মানের (১৭৬.৬৬) তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের গড় মান শতকরা ১০.৩৭ ভাগ বেড়েছে এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের বায়ুমান সূচক শতকরা ১১.০৫ ভাগ বেড়েছে।
৯ বছরের মধ্যে ২০১৬ সালে ঢাকার নভেম্বর মাসের বায়ুমান সূচক গড়ে ১৬৯ ছিল, ২০১৭ সালে ১৭৮ ছিল, ২০১৮ সালে ১৯৭ ছিল, ২০১৯ সালে ১৫৯ ছিল, ২০২০ সালে ১৬৩ ছিল ২০২১ সালে ১৯৪.৮ ছিল, ২০২২ সালে ১৭৬ ছিল এবং ২০২৩ সালে ১৭৫.৬ ছিল। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের বায়ুমান সূচক ২০২৩ সালের চেয়ে বেড়ে গিয়ে ১৯৫ এ এসে দাঁড়িয়েছে।
আরও পড়ুন
গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার মানুষ প্রতিনিয়ত দূষিত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে অর্থাৎ চলতি বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার মানুষ একদিনও ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হয়নি। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে ১ দিনের বায়ুমান ছিল ‘মধ্যম’ প্রকৃতির, ৪ দিনের বায়ুমান ছিল ‘সতর্কতামূলক’, ১২ দিনের বায়ুমান ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ১৩ দিনের বায়ুমান ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’।
ক্যাপস কর্তৃক সংগৃহীত ২০১৬ থেকে ২০২৪ সালের অর্থাৎ ৯ বছরের নভেম্বর মাসের প্রাপ্ত ২৫৬ দিনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ৯ বছরের নভেম্বর মাসের মোট ২৫৬ দিনের মধ্যে ১৩৮ দিন ছিল ‘অস্বাস্থ্যকর’ এবং ৬৪ দিন ছিল ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ এবং ঢাকার মানুষ মাত্র ১ দিন ভালো বা নির্মল বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে সক্ষম হয়েছিল। গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, ৯ বছরের নভেম্বর মাসের মধ্যে ২০২৪ সালের নভেম্বর মাস বায়ু দূষণের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে।
বায়ু দূষণ রোধে আমাদের কার্যকরী ভূমিকা রাখতে হবে, সবার আগে দূষণের উৎসগুলো চিহ্নিত করে দূষণ কমিয়ে আনতে হবে। শুধুমাত্র পরিবেশ অধিদপ্তর বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ করবে এই মানসিকতা থেকে বের হয়ে এসে যারা দূষণ করছে তারাই এই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করবে এই মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে।
নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে সুরক্ষার জন্য উন্নত মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। শিশু, অসুস্থ এবং গর্ভবতী নারীদের সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হবে। দিনে অন্তত দুই বেলা সকালে ও বিকালে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটাতে হবে। এছাড়াও সরকারের সিটি কর্পোরেশন হতে একটি অনুরোধ মূলক নির্দেশনা জারি করে প্রত্যেক ভবন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে পারেন, যেন তারা নিজ উদ্যোগে প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর তাদের ভবনের সামনের রাস্তায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করেন।
ঢাকার আশপাশের ইটের ভাটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আগুনে পোড়ানো লাল ইটের বিকল্প হিসেবে সিমেন্ট বালুর ব্লক ইটের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। ইটের ভাটাগুলোয় উন্নত ও দূষণমুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
নিজেদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে সুরক্ষার জন্য উন্নত মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। শিশু, অসুস্থ এবং গর্ভবতী নারীদের সাবধানতা অবলম্বন করে চলতে হবে। দিনে অন্তত দুই বেলা সকালে ও বিকালে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটাতে হবে।
মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। সপ্তাহের ভিন্ন দিনে জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলার ব্যবস্থা করতে হবে। সমন্বয়হীনভাবে রাস্তার খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সেবাদানকারী সংস্থার সংস্কার কাজে সমন্বয় এনে স্বল্প সময়ে সংস্কার শেষ করতে হবে।
নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্তভাবে ফেলে না রেখে সবকিছু ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, যাতে করে যেখানে সেখানে নগর বর্জ্য বা কৃষি বর্জ্য উন্মুক্তভাবে পোড়ানো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।
অন্যদিকে প্রচলিত আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। একইসঙ্গে প্রশাসনিক ব্যবস্থার সফল প্রয়োগ একান্তভাবে প্রয়োজন। সর্বোপরি, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাশাপাশি দেশের আপামর জনসাধারণকেও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
বায়ু দূষণ রোধ করা গেলে আমরা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি বসবাসযোগ্য নগরী রেখে যেতে পারব। এতে মানুষের গড় আয়ু এক বছরেরও বেশি বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা যাবে। মানুষ রোগ বালাই থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকতে পারবে।
মানুষের চিকিৎসা ব্যয় কমবে। কর্ম ক্ষমতা ও কর্ম ঘণ্টা বাড়বে। মানুষের আর্থিক সচ্ছলতা বাড়বে। জিডিপি-তে সমৃদ্ধি আসবে। ঢাকা হবে পৃথিবীর বসবাসযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম। আমাদের সমন্বিত উদ্যোগই পারে আমাদের প্রাণের নগরী ঢাকার এই অতিমাত্রার বায়ু দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করতে।
ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার ।। ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)