কোন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছে তারা?
কওমি মাদ্রাসাগুলোতে রাজনীতি হবে না মর্মে ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনটি। কোনো দেশের অন্যতম বৃহত্তম শিক্ষাব্যবস্থায় ‘রাজনীতি’ বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা দেশটির জন্য খুব স্বাভাবিক ঘটনা ভাববার কোনো কারণ নেই। আজকে যদি দেশের বাংলামাধ্যম তথা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা আসতো তাহলে তার প্রতিক্রিয়া কী ভয়ানক হতো সেটা ভাবলে আমাদের মনে এই প্রশ্ন ওঠে যে, কেন কওমি মাদ্রাসায় রাজনীতি বন্ধ করার ঘোষণায় দেশের ভেতর কোথাও কোনো হেল-দোল নেই?
এর আগে আবরার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল, তখনও টিভি টকশো থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার ক্ষেত্রে সেটি হয়নি, এর মূল কারণ কি এটাই যে, বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা মূলত একটি ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা এবং এখানে যদি কেবল ধর্মশিক্ষাই দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে সেখানে ‘রাজনীতি’ বলতে আমরা প্রচলিত জ্ঞানে যা বুঝি তার চর্চা কেন থাকবে সে প্রশ্নটিই মূলত মুখ্য হয়ে ওঠে? সবচেয়ে বড় কথা কোন রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিচ্ছে তারা? আধুনিক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি নাকি বাংলাদেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া উগ্র ধর্মভিত্তিক জঙ্গিবাদী রাজনীতি?
২০১৩ সালের ৫ মে’র কথা স্মরণ করি তাহলে আমরা প্রমাণ পাই যে, একটি নিরীহ কিন্তু আকারে বিশাল জনগোষ্ঠীকে ধর্মের নামে উসকানি দিয়ে কীভাবে সশস্ত্র অবস্থায় রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য আর কিছুই না, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ছাড়া।
আমরা হেফাজতে ইসলাম বলে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমের নাম শুনে আসছি বিগত বছর কয়েক ধরে। আমরা এটা সকলেই জানি যে, এই প্ল্যাটফর্মটি মূলত এই কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে উঠে আসা ধর্মাশ্রয়ী একটি প্ল্যাটফর্ম যারা এতদিন দেশের মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষকে দ্বীনি শিক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু হঠাৎ করেই তাদেরকে রাজনীতিতে টেনে এনে ফেলার দায় কয়েকজন বিপথগামী বাম রাজনীতিবিদদের, যারা নিজেদের যৌবনকাল ব্যয় করেছেন বামপন্থার প্রচারণায়। এখন জীবনের শেষপ্রান্তে এসে হঠাৎ করে ধর্মবাদী হয়ে এই সহজ-সরল কিন্তু বিশালসংখ্যক দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিতদের রাজনীতির ময়দানে এনে ফেলতে চাইছেন। তাতে লাভটা কী হবে? এর ফলে মূলত বাংলাদেশের মূলধারার সেক্যুলার রাজনৈতিক ধারাটির বিপক্ষে একটি বিশাল ভোট ব্যাংক পাওয়া যাবে এবং প্রয়োজনে তাদেরকে দিয়ে দেশের ভেতর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে দেশের ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকেও বিভ্রান্ত করে এই মুহূর্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে।
আমরা যদি ২০১৩ সালের ৫ মে’র কথা স্মরণ করি তাহলে আমরা প্রমাণ পাই যে, একটি নিরীহ কিন্তু আকারে বিশাল জনগোষ্ঠীকে ধর্মের নামে উসকানি দিয়ে কীভাবে সশস্ত্র অবস্থায় রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য আর কিছুই না, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করা ছাড়া।
একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শাহবাগে জড়ো হওয়া তরুণদেরকে নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে এই ধর্মাশ্রয়ী বিপুলসংখ্যক মানুষকে লেলিয়ে দেওয়া। স্মরণ করতে পারি যে, তখনকার দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাটি প্রতিদিন শাহবাগের তরুণদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে অপপ্রচার শুরু করেছিল এবং তার ফলশ্রুতিতে কয়েকজন ব্লগারকে যে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়েছিল তার বিচার কিন্তু আজও হয়নি।
মোটকথা দেশের তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা থেকে শুরু করে দেশের সকল উগ্রবাদী শক্তি একত্রিত হয়ে এই কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর ভরসা করে তাদেরকে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এনে জড়ো করেছিলেন।
এই ঘটনার অনেকগুলো দিক আছে, এই পরিসরে সেসব নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই। তবে একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, সেদিন যদি এই বিশাল জনগোষ্ঠী ঢাকা শহর দখল নিয়ে সরকার পতনে সফল হতো (যা করার লক্ষ্য নিয়ে তারা এসেছিল) তাহলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যারাই আসীন হতেন তাদের সঙ্গে ধর্মবাদী এই গোষ্ঠীটির নিঃসন্দেহে ক্ষমতার ভাগাভাগি হতো এবং শেষ পর্যন্ত এদেশের সেক্যুলার চরিত্র বদলে ধর্মভিত্তিক পরিচয় কেবল নয়, ভূপ্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশ একটি বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রায় পেটের ভেতর অবস্থিত হওয়ায় এই রাষ্ট্রটির অস্তিত্বই বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো, সেটা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
অতি সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের পর যে সকল তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে তার কিয়দংশও যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে।
অতি সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের পর যে সকল তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে তার কিয়দংশও যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে।
বাংলাদেশ একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভ করেছে পাকিস্তানের মতো পশ্চাৎপদ একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে। আজকের পাকিস্তানের দিকে তাকালেই বাংলাদেশের পথ পরিক্রমাকে আমাদের সামনে স্বচ্ছ এবং সফলতর মনে হয়। পাকিস্তান যেটি পারেনি ‘ধর্ম-সামরিকতন্ত্র-আমেরিকা’-তন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসতে, যা বাংলাদেশ সফলভাবে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলে দাবি করা যায় না কিন্তু বাংলাদেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর এই ত্রয়ী নেতিবাচক প্রপঞ্চ থেকে বের হওয়ার জন্য যে নৈতিক রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন সেটা পাকিস্তানে নেই, বাংলাদেশে এখনও আছে বলে আমি মনে করি, যদিও আমার সঙ্গে অনেকে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। যারা দ্বিমত পোষণ করেন তাদের জন্য এটুকু বলতেই চাই যে, একটি গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে আপনি ধর্মাশ্রয়ী এবং সামরিকতন্ত্রজাত রাজনৈতিক শক্তিকে এক জোয়ালে গেঁথে দিলে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে একা সফলভাবে দেশটিকে গণতন্ত্রের পথে টেনে রাখা সম্ভব হবে না, হয় না।
বাংলাদেশেও তাই সে কারণেই কখনও গণতন্ত্র, কখনও সামরিক ও সুশীল সহযোগে উদ্ভট তন্ত্র এবং কখনও ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেওয়া রাজনৈতিক দলের হাতে লুটপাট তন্ত্র ক্ষমতায় বসে। আর এর মাঝে বারবারই আমাদের চোখ রাঙায় উগ্র ধর্মান্ধ শক্তি, রাতারাতি তারা রাজনৈতিক শক্তি হয়ে বসতে পারে এই সকল সুবিধাবাদী ও ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্যই। আর গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই কখনও কখনও জমি দিয়ে, অর্থ দিয়ে, সনদ দিয়ে তাদেরকে কাছে রাখতে হয়, না হলে তাদেরকে বুকে টেনে নেওয়ার মতো রাজনৈতিক শক্তিরতো অভাব নেই এদেশে। অথচ সুযোগ পেলে এরা শুধু গণতান্ত্রিক শক্তিকেই নয় সকল শক্তিকেই খতম করে একা ক্ষমতা ভোগে দ্বিধা করবে না, উদাহরণ হিসেবে ইরানকে পাঠকের সামনে রেখে গেলাম। আজকের ইরানকে আমরা যা দেখি আশির দশকের আগে দেশটা সত্যিকার অর্থে একটি আধুনিক রাষ্ট্রই ছিল।
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এদেশে রাজনীতি করার সুযোগ সকলেরই থাকতে হবে, আধুনিক হতে হলে আপনাকে সে সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। কিন্তু ইউরোপের মতো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও কিন্তু নাৎসিবাদ কিংবা উগ্র ধর্মবাদী কোনো শক্তিকে রাজনীতির সুযোগ দেওয়া হয় না।
জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকারক কোনো শক্তি বা দলকে গণতন্ত্রের সুযোগ দেওয়ার মতো গণতন্ত্রিক রাষ্ট্র খোদ আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনেও নেই। কিন্তু বাংলাদেশে আজকে নব্য-লিবারেলরা দাবি করছেন তাদেরকে রাজনৈতিক সুযোগ দেওয়ার জন্য যারা রাষ্ট্রের ভালোতো দূরের কথা, এই রাষ্ট্রটিকেই চায়নি, তারা বাংলাদেশের জন্মেরই বিরোধিতা করেছিল। হয়তো তারা অদূর ভবিষ্যতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে দেশের ক্ষমতাও দখল করবে কিন্তু তখন এই লিবারেলদেরকেই যে জীবন দিয়ে তাদের উদারতার মূল্য দিতে হবে সে কথা ইরানের উদাহরণ দিয়ে একটু আগেই বলেছি।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না যে, কওমি মাদ্রাসায় রাজনীতি বন্ধের ঘোষণা দিলেও সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। বরং সেখানে গোপনে যে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া চলবে তা হবে ভয়ঙ্কর জঙ্গিবাদ, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য যা বড় ধরনের বিপদের কারণ হবে। তারচেয়ে বরং তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিক করে তাদেরকে ধর্মবাদী রাজনীতি নয়, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া দরকার। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাজনীতির বাইরে রাখতে পারবে না, পারাটা নৈতিকও হবে না, সেক্ষেত্রে তাদেরকে গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণের সুযোগটা অন্তত করে দিতেই হবে। না হলে তাদেরকে বারবার ঢাকায় এনে ক্ষমতা দখলের পায়তারা হবে কিংবা তারাই সশস্ত্র হয়ে ক্ষমতা দখলে নামবে। বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানানোর ঘোষণা থেকে তারা সরে এসেছে বলে আমাদের কাছে এখনও কোনো প্রমাণ নেই, তারা ঘোষণা দিয়েই এই যুদ্ধে নেমেছে।
মাসুদা ভাট্টি ।। এডিটর-ইন-চার্জ, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি