পাকিস্তানে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি আসবে কবে?
পাকিস্তান পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। কিছুদিন ধরে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের সরকারবিরোধী অবস্থান সহিংস পরিস্থিতিতে রূপ নেওয়ার পর এবং সরকারের পক্ষ থেকে দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের পর হঠাৎই ইমরান খানের মুক্তি ছাড়া আন্দোলনের মাঠ না ছাড়তে ঘোষণা দেওয়া পিটিআই পিছু হটেছে।
তাদের পক্ষ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘ব্যাপক দমনমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার রাজধানী ইসলামাবাদকে কসাইখানায় রূপান্তর করতে চেয়েছে।’ এই যুক্তি দিয়ে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে দলীয় প্রধান ইমরান খানের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
এদিকে ইমরান খানের সূত্রে জানা গেছে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তিনি তার সমর্থকদের আন্দোলন কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন ইমরানের স্ত্রী বুশরা বিবি। তিনিও ইমরান খানকে না নিয়ে ফিরবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করলেও শেষ পর্যন্ত তাদের কর্মসূচি স্থগিত করতে হয়।
জানা গেছে, এই আন্দোলনে লাখ লাখ কর্মী এবং সমর্থক জড়ো হলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতি আন্দোলনের সাফল্যের ক্ষেত্রে বড় বাধা হিসেবে কাজ করেছে। পাকিস্তানের একমাত্র খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ইমরানের দল পিটিআই সরকার গঠন করেছে। সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন খান গন্ডাপুর এবং বুশরা বিবির নেতৃত্বে মূলত পিটিআই সমর্থকদের ইসলামাবাদমুখী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল।
শহরের ডি-চক এলাকায় ছিল এর গন্তব্য, যেখানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী অফিস, সংসদ ভবন এবং সুপ্রিম কোর্টসহ আরও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা অবস্থিত। সরকার শহরের প্রবেশ মুখগুলো বন্ধ করে দেয়। কমপক্ষে ৭০০ শিপিং কন্টেইনার বসিয়ে বাধা সৃষ্টি করা হয়।
মূলত যে তিনটি দাবিকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজন করা হয় সেগুলো হচ্ছে, ইমরান খানের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ এবং সংবিধানের বিতর্কিত ২৬তম সংশোধনী বাতিল করা।
পুলিশ এবং সীমান্ত রক্ষী বাহিনী রেঞ্জার্সের সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে গুলি এবং কাঁদানি গ্যাস নিক্ষেপ করে। ৮ জন নিহতের কথা জানা গেছে, যার মধ্যে ৪ জন রেঞ্জার্সের সদস্য এবং ২ জন পুলিশ সদস্য রয়েছেন। সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থায় রাখা হলেও তাদের গুলিতে কোনো নিহতের বিষয় জানা যায়নি। এই বিক্ষোভ কর্মসূচি ভণ্ডুল হওয়ার পর রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ পুরো দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ডি-চক অভিমুখী এই মিছিলটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিবন্ধকতায় বাধাপ্রাপ্ত হলে অনেক বিক্ষোভকারী পালিয়ে যান। একপর্যায়ে এর নেতৃত্বদানকারী বুশরা বিবি এবং আলী আমিন খান গন্ডাপুরও পালিয়ে যান। পরবর্তীতে তাদের পক্ষ থেকে সরকারের দমনমূলক নীতির সমালোচনা করে বিবৃতি দেওয়া হয়।
পুরো বিষয়টি থেকে যা উঠে আসে, তা হচ্ছে এই আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে দলের ভেতরে সমন্বিত সিদ্ধান্তের অভাব ছিল। গোটা আন্দোলনটি দানা বেঁধে ওঠে মাত্র ৪ দিন সময়ের মধ্যে। যদিও কয়েকমাস ধরে ইমরান খানের মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিলেন তার কর্মী এবং সমর্থকরা, তা নিয়ে দলগত সিদ্ধান্তের বাইরে ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলে একটি আন্দোলন কর্মসূচি সাফল্যের মুখ দেখেনি।
মূলত যে তিনটি দাবিকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভ কর্মসূচি আয়োজন করা হয় সেগুলো হচ্ছে, ইমরান খানের মুক্তি, সরকারের পদত্যাগ এবং সংবিধানের বিতর্কিত ২৬তম সংশোধনী বাতিল করা। উপরোক্ত দুটি দাবির বাইরে এই ২৬তম সংশোধনী নিয়ে দলের অবস্থা হলো, এর মধ্য দিয়ে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংসদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে।
আমরা জানি, একটি সরকার ব্যবস্থায় এই বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংসদ, সরকার, আদালতের নিজের উপর বা রাষ্ট্রপতির উপর—যেভাবেই ন্যস্ত থাকুক না কেন, সরকারের একটা পরোক্ষ প্রভাব সবসময় থেকে যায়। মূলত অন্য দুই দাবিকে বৈধ করার জন্যই এটিও আন্দোলনের অন্যতম বিষয়বস্তু করা হয়েছে।
একথা ঠিক যে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইমরান খান এই মুহূর্তে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছেন। এর প্রমাণ পাকিস্তানের জনগণ বিগত সাধারণ নির্বাচনে দিয়েছেন। দলীয় প্রতীক এবং তার দলকে নিষিদ্ধ করার পরও স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে তার দল এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন (১০১টি) লাভ করেছিল। পাকিস্তানের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবক সেনাবাহিনীর সমর্থন হারানোই ছিল তার ক্ষমতাচ্যুতর একমাত্র কারণ।
পাকিস্তানের অতীত ইতিহাস ঘেটে দেখা যায়, স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংঘাতের কারণে সেনাবাহিনীর সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর সম্পর্ক খুব বেশি সময় ভালো থাকে না। এর প্রমাণ আমরা দেখেছি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো এবং নওয়াজ শরীফের ২ দফা এবং ৩ দফায় অসম্পূর্ণ মেয়াদ সরকার পরিচালনার মধ্য দিয়ে।
সেনাবাহিনীর পাশাপাশি রয়েছে দেশটির রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব, যা সবসময় সেনাবাহিনী দ্বারা সমর্থিত। এটিই ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে কাজ করেছিল।
পাকিস্তানের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সবসময় মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশকে সমর্থন করে।’ এই বক্তব্যের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ ছিল। বিষয়টি নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
একথা ঠিক যে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে ইমরান খান এই মুহূর্তে অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছেন। এর প্রমাণ পাকিস্তানের জনগণ বিগত সাধারণ নির্বাচনে দিয়েছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জনগণের নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতার স্বার্থে এমন ব্যাখ্যা যেমন যৌক্তিক, অন্যদিকে সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জনগণের জমায়েত হওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে এটাও সত্য।
এইসব সত্যের বাইরে যে আসল সত্য, তা হচ্ছে সরকার দেশের সেনাবাহিনী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো দ্বারা এখন পর্যন্ত ব্যাপকভাবে সমর্থনপুষ্ট, যার মধ্য দিয়ে এত কঠোর অবস্থানের পরও সরকারের ভিত অটুট রয়েছে। দেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সমাবেশকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়ার মতো ঘোষণা সরকারের কঠোর অবস্থানকেই নির্দেশ করে।
এর বিপরীতে বিরোধী পিটিআই-র সে রকমভাবে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মতো সামর্থ্য এই মুহূর্তে আছে বলে মনে হয় না। পাকিস্তানে একটি সরকার গঠন হয়েছে মাত্র ৮ মাস হলো। পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) মধ্যকার জোট সরকারের মধ্যে এখনো সুসম্পর্ক অটুট রয়েছে।
মনে রাখতে হবে, শক্তিমত্তার দিক দিয়ে এই দুই দলের অবস্থান ইমরান খানের পিটিআই-এর চেয়ে বেশি। আন্দোলন কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকা বাঞ্ছনীয়, এক্ষেত্রে এর অভাব ছিল, সাথে দলীয় সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত, এটাও ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়।
সবকিছু মিলে একটি আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক সমন্বয় যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ পিটিআই-র সাম্প্রতিক ব্যর্থ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তা আবারও প্রমাণিত হলো। তবে সরকারের দিক থেকেও এটা নিয়ে স্বস্তিতে থাকার কোনো কারণ নেই, কারণ জনসমর্থন এবং সহানুভূতির দিক দিয়ে ইমরান খান এখনো অনেক এগিয়ে।
ড. ফরিদুল আলম ।। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়