মঙ্গলে সফল অবতরণ: সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে চায় চীন
প্রাচীনকালে আকাশের দিকে তাকিয়ে জ্ঞানী-গুণীরা ভাবনার জগতে হারিয়ে যেতেন বলে জানি। হযরত ইব্রাহিম (আ.) তরুণ বয়সে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার স্রষ্টাকে খুঁজেছিলেন। আকাশের উজ্জ্বল এক তারকা দেখে তিনি ভাবলেন, এটাই স্রষ্টা, প্রতিপালক। কিন্তু সেটি অস্ত গেলে তিনি হতাশ হলেন। পরে চাঁদকে দেখে ভাবলেন, এটিই তার প্রতিপালক। যখন চাঁদ ডুবে গেল, তখন তিনি বুঝলেন স্রষ্টা নিজে তাকে সঠিক পথ না দেখালে তিনি পথভ্রষ্ট হবেন। আবার দিনের বেলা সূর্যের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, এটা বড় ও উজ্জ্বল, এটাই স্রষ্টা। পরে সূর্যও যখন দিন শেষে অস্তমিত হলো, তখন তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র নয়, বরং এসব যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই প্রকৃত স্রষ্টা।
খ্রিষ্টের জন্মের ৩৪০ বছর আগে জন্মেছিলেন প্রাচীন চীনের বিখ্যাত কবি ছু ইউয়ান (Qu Yuan)। আকাশের দিকে তিনিও তাকাতেন, খুঁজতেন বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর। তার মনে প্রশ্ন জাগতো, চাঁদ কেন ওঠে? সূর্য কেন ওঠে? কেন আবার এ দুটি অস্ত যায়? চাঁদের আলো কেন এত স্নিগ্ধ ও কোমল এবং সূর্যের আলো কেন এত উষ্ণ ও তীব্র? আর এ ধরনের প্রশ্নের সমাহার দেখা যায় তার রচিত একটি কবিতায়। কবিতার নাম ‘থিয়ান ওয়েন’ (Tian wen)। চীনা ভাষায় ‘থিয়ান’ মানে ‘আকাশ’ এবং ‘ওয়েন’ মানে ‘প্রশ্ন’।
চীনের এই প্রাচীন কবিতার নামেই নামকরণ করা হয়েছে চীনের প্রথম মঙ্গল অনুসন্ধানযান ‘থিয়ানওয়েন-১’-এর। এই মহাকাশযানটি গত বছরের ২৩ জুলাই লংমার্চ-৫ হেভি-লিফ্ট রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপণ করা হয়; গন্তব্য ছিল মঙ্গল গ্রহ, সৌরজগতের গ্রহগুলোর মধ্যে পৃথিবীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পান বিজ্ঞানীরা যার সঙ্গে। ৪৮টি ছোট-বড় ইঞ্জিনের সাহায্যে ‘থিয়ানওয়েন-১’ মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অতিক্রম করে প্রায় ৪৭ কোটি কিলোমিটার পথ।
মহাকাশযানটি মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছায় চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি। তখন পৃথিবীর সঙ্গে মঙ্গলের দূরত্ব ছিল ১৯ কোটি ৩০ লক্ষ কিলোমিটার। সৌরজগতের এই দুটি গ্রহের মধ্যে তখনকার সরাসরি দূরত্ব এটি হলেও, পৃথিবী থেকে মঙ্গলে পৌঁছাতে ‘থিয়ানওয়েন-১’-কে পাড়ি দিতে হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি পথ। কারণ, পৃথিবী ও মঙ্গল উভয়ই নিজ নিজ কক্ষপথে তীব্র বেগে ঘুরছে। পৃথিবী থেকে কোনো মহাকাশযানকে মঙ্গলে পৌঁছাতে, অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। বর্তমানে মহাকাশযানটির অরবিটার (orbiter) অংশটি মঙ্গলকে যে কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করছে, সেই কক্ষপথে সেটি প্রবেশ করেছিল ২৪ ফেব্রুয়ারি।
থিয়ানওয়েন-১ মিশনের লক্ষ্য ছিল মঙ্গলে পৌঁছানো, মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করা, মঙ্গলে অবতরণের জন্য সুবিধাজনক স্থান নির্ধারণ করা, মঙ্গলে অবতরণ করা এবং মঙ্গলের বুকে রোভারের (rover) চলাচল নিশ্চিত করা। ১০ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলের কক্ষপথে পৌঁছালেও, তখনই সেটি মঙ্গলের বুকে অবতরণ করেনি। বিগত প্রায় তিন মাস এটি মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করেছে, মঙ্গলের একটি সুবিধাজনক জায়গা খুঁজে বেড়িয়েছে অবতরণের জন্য। বিজ্ঞানীরা মহাকাশযানটিকে এভাবেই প্রোগ্রামড করেছিলেন। মহাকাশযানটি সেভাবেই কাজ করেছে, সুবিধাজনক স্থান চিহ্নিত করেছে এবং মঙ্গলের বুকে ল্যান্ডার (lander)-কে অবতরণ করিয়েছে। আর এর মাধ্যমেই চীন মহাকাশ-গবেষণার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছে আরেকটি নতুন ইতিহাস। কিছুদিন আগেই চীন তার নিজস্ব মহাকাশকেন্দ্রের মূল অংশ সফলভাবে কক্ষপথে পাঠিয়েছে; তারও আগে চাঁদে মহাকাশযান পাঠিয়ে চাঁদের নমুনা সংগ্রহ করে তা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে; জিপিএস-এর মতো একটি পূর্ণাঙ্গ বৈশ্বিক ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কও প্রতিষ্ঠা করেছে। আর এখন দেশটি বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসেবে মঙ্গলের বুকে মহাকাশযান অবতরণ করিয়েছে।
থিয়ানওয়েন-১ মিশনের লক্ষ্য ছিল মঙ্গলে পৌঁছানো, মঙ্গলকে প্রদক্ষিণ করা, মঙ্গলে অবতরণের জন্য সুবিধাজনক স্থান নির্ধারণ করা, মঙ্গলে অবতরণ করা এবং মঙ্গলের বুকে রোভারের (rover) চলাচল নিশ্চিত করা।
থিয়ানওয়েন-১ মহাকাশযানের ল্যান্ডার অংশ মঙ্গলের বুকে অবতরণ করে চীনা সময় ১৫ মে সকাল ৭টা ১৮ মিনিটে। ঠিক তখন পৃথিবীর সঙ্গে মঙ্গলের দূরত্ব ছিল প্রায় ৩২ কোটি কিলোমিটার। ল্যান্ডারের অবতরণের গোটা প্রক্রিয়াটিই সম্পন্ন হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। ‘থিয়ানওয়েন-১’ যেভাবে প্রোগ্রামড করা হয়েছিল, ওই বিশেষ সময়ে সেটি সেভাবেই কাজ করেছে। আর অবতরণের স্থানটি পছন্দ করা হয়েছে একাধিক কারণে, প্রথমত এখানকার আবহাওয়া মহাকাশযানের অবতরণের জন্য সুবিধাজনক এবং দ্বিতীয়ত এ অঞ্চলে প্রাচীন সমুদ্রের অংশ বিশেষের সন্ধান পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। বলাই বাহুল্য, আজও বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে পানি খুঁজে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেননি।
মঙ্গলের বুকে থিয়ানওয়েন-১ মহাকাশযানের ল্যান্ডার অংশটি একটি রোভারও বহন করে নিয়ে গেছে। এই রোভারের নাম ‘চুরং’ (Zhurong)। রোভারের নামটি রাখা হয়েছে প্রাচীন চীনের আগুনের দেবতার নামে। এটি নির্দিষ্ট সময় পর ল্যান্ডার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে, মঙ্গলের বুকে চলাফেরা করবে, ছবি তুলবে, মঙ্গলের ভূমির ম্যাপিং করবে, বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করবে। আশা করা হচ্ছে, চলতি মাসের শেষ দিকে চুরং পৃথিবীতে মঙ্গলের প্রথম ছবি পাঠাবে। মনে রাখতে হবে, থিয়ানওয়েন-১ মহাকাশযানের অরবিটার অংশ মঙ্গলকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। চুরং-এর সঙ্গে পৃথিবীর কমান্ড সেন্টারের সংযোগ থাকবে এই অরবিটারের মাধ্যমে।
চুরং রোভারটির দৈর্ঘ্য ১.৮৫ মিটার ও ওজন প্রায় ২৪০ কিলোগ্রাম। এর আছে ৬টি চাকা ও চারটি সোলার প্যানেল (এই প্যানেলই রোভারের জন্য প্রয়োজনীয় সৌরশক্তির সৃষ্টি করবে)। মঙ্গলের বুকে এটি প্রতিঘণ্টায় ২০০ মিটার পথ অতিক্রম করতে পারবে। রোভারটিতে সংযুক্ত আছে ক্যামেরা, রাডার, সেন্সরসহ ৬টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।
মঙ্গলের আবহাওয়া বিরূপ। এই আবহাওয়ায় কোনো মহাকাশযান সেখানে অবতরণ করানো যেমন কঠিন, তেমনি সেখানে কোনো রোভারের টিকে থাকাও কঠিন। আর তাই, চুরংকে ডিজাইন করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে সেটি চরম আবহাওয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ বন্ধ রাখতে ও অনুকূল আবহাওয়ায় আবার কাজ শুরু করতে পারে। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুসারে চলে, তবে এই রোভার মঙ্গলের বুকে অন্তত তিন মাস টিকে থাকবে এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবে। চুরংয়ের আগে পাঁচটি রোভার মঙ্গলের বুকে চলাচল করেছে বা করছে। বলা বাহুল্য, এই পাঁচটি রোভারই যুক্তরাষ্ট্রের।
মঙ্গলকে এর রঙের কারণে ডাকা হয় লাল গ্রহ। এই লাল গ্রহটি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বহুকাল ধরেই। মঙ্গলে মানুষের অভিযান শুরু হয়েছিল সেই ১৯৬০ সালে। প্রথম প্রচেষ্টা চালিয়েছিল ইউরি গ্যাগারিনের দেশ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু সেই মিশন ব্যর্থ হয়। তবে প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৯টি মঙ্গল অভিযাত্রাকে ‘সফল’ বলে গণ্য করা হয়। অবশ্য মঙ্গলের বুকে মহাকাশযান অবতরণের ২০টিরও বেশি চেষ্টার অর্ধেকেরও বেশি ব্যর্থ হয়েছে লাল গ্রহের বিরূপ আবহাওয়ার কারণে। আর চীনের আগে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযানই মঙ্গলের বুকে অবতরণে সক্ষম হয়।
চলতি বছরেও যুক্তরাষ্ট্র একটি রোভার মঙ্গলের বুকে অবতরণ করিয়েছে। শুধু তাই নয়, একই মিশনে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি ড্রোন হেলিকপ্টারও (যেটির নাম Ingenuity) পাঠিয়েছে মঙ্গলে। যতদূর জানি, বর্তমানে মঙ্গলকে কেন্দ্র করে ৮টি অরবিটার ঘুরছে ও সক্রিয় আছে। আর মঙ্গলের বুকে সক্রিয় আছে তিনটি রোভার, যুক্তরাষ্ট্রের কিউরিওসিটি (Curiosity) ও পারসিভারেন্স (Perseverance) এবং চীনের চুরং।
মঙ্গল অভিযানের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র চীনের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। তবে, এক্ষেত্রেও চীন একটি দিকে যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। চীন মাত্র একটি মিশনে তিনটি লক্ষ্য পূরণ করতে যাচ্ছে, মঙ্গলকে প্রদক্ষিণের মাধ্যমে গ্রহটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা; মঙ্গলের বুকে মহাকাশযানের অবতরণ ঘটানো এবং মঙ্গলের বুকে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি রোভার মোতায়েন করা। খোদ যুক্তরাষ্ট্রও একই মিশনে এই তিনটি লক্ষ্য পূরণ করেনি কখনও। চীন প্রথম দুটি লক্ষ্য ইতোমধ্যেই পূরণ করেছে। এখন রোভার চুরং যদি ঠিকঠাক মতো কাজ শুরু করে, তবে তৃতীয় লক্ষ্যটিও পূরণ হবে এবং চীন পৌঁছে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়।
মঙ্গলের বুকে থিয়ানওয়েন-১ মহাকাশযানের ল্যান্ডার অংশটি একটি রোভারও বহন করে নিয়ে গেছে। এই রোভারের নাম ‘চুরং’ (Zhurong)। রোভারের নামটি রাখা হয়েছে প্রাচীন চীনের আগুনের দেবতার নামে।
না, মঙ্গল গ্রহকে নিয়ে চীনের গবেষণা এই অর্জনের মাধ্যমেই থেমে যাবে না। চীনের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আরও বড় লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন। এই তো সেদিন, প্রায় চার দশক পর প্রথম চন্দ্রযান হিসেবে, চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে চীনের ‘ছাং এ’। এবার মঙ্গল গ্রহ থেকেও নমুনা সংগ্রহ করে মহাকাশযান পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে চায় চীন। ‘থিয়ানওয়েন-১’-এর প্রধান পরিকল্পনাকারী চাং রংছিয়াও (Zhang Rongqiao) সম্প্রতি জানিয়েছেন, চীন ইতোমধ্যেই মঙ্গল থেকে নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার মিশন নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এ কাজ এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশই করতে পারেনি।
পৃথিবীর কোনো দেশ করতে পারেনি, এমন অনেক কাজ চীন ইতোমধ্যেই করে দেখিয়েছে। বিশ্বের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র মহাকাশকেন্দ্র নির্মাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৬টি দেশ সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। অথচ চীন একাই একটি মহাকাশকেন্দ্র নির্মাণের পথে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে। ২০২২ সালের মধ্যে যে চীনের মহাকাশকেন্দ্র পুরোপুরি চালু হবে, এ ব্যাপারে বহু বিদেশি বিজ্ঞানীর মনেও কোনো সন্দেহ নেই। তবে, চীনের দৃষ্টি মহাকাশকেন্দ্র বা মঙ্গল পর্যন্তও সীমিত নয়! চীনা বিজ্ঞানীরা আমাদের সৌরজগতের একেবারে শেষ প্রান্তে মহাকাশযান পাঠানোর সম্ভাব্যতাও যাচাই করে দেখছেন। চীনের চন্দ্রাভিযান মিশনের প্রধান ডিজাইনার উ ওয়েইরেন সম্প্রতি এ কথা জানিয়েছেন। সম্ভাব্য এই প্রকল্পের অধীনে চীনের মহাকাশযান পৃথিবী থেকে ১৫০০ কোটি কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সৌরজগতের শেষ প্রান্তে পৌঁছাবে (পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব প্রায় ১৫ কোটি কিলোমিটার)। আর এই কাজটা চীন করতে চায় ২০৪৯ সালের মধ্যে। ওই বছরই নয়া চীন প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকী পালিত হবে।
উ ওয়েইরেন বলেন, যদি এই প্রকল্প সফল হয়, তবে তা হবে বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য চীনের অবদান; আর এই লক্ষ্য পূরণের যোগ্যতা চীনের মহাকাশ শিল্পের রয়েছে। বস্তুত, চীন একে একে এতসব আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে যে, এখন আর কোনোকিছুই এই দেশটির পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হয় না।
আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)