মাস্ক, মাস্ক এবং মাস্ক
করোনা, মাস্ক আর ভ্যাকসিন এই শব্দ তিনটি সম্ভবত গত দেড় বছরের সবচাইতে আলোচিত শব্দ এবং তা শুধু এদেশেই নয় বরং পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পুরো পৃথিবী জুড়ে। অথচ ২০১৯-এ করোনার নামগন্ধও ছিল না আমাদের ডিকশনারিতে। আমরা কেউ কেউ তখনও মাস্ক পরতাম দূষণ আর শ্বাস কষ্টের ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য। কিন্তু মাস্ক যে এভাবে আমাদের জীবনের এমন অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে তা বোধহয় ভাবিনি আমরা কেউ-ই। অথচ এটাই আজকের নিউ নরমাল বাস্তবতা।
মাস্কে অবিশ্বাসীর সংখ্যা অবশ্য এখনও নেহায়েতই কম না। যে কারণে প্রায়ই মাস্ক, নাক-মুখ না ঢেকে ঝুলে থাকে থুতনির তলায় কিংবা লুকিয়ে থাকে পকেটে। অনেকেরটা আবার ঝুলতে থাকে বাসায়, দিনের পর দিন দরজার কোনো ছিটকিনিতে। এর বাইরেও কিছু মানুষ আছেন যারা মাস্কে শুধু অবিশ্বাসীই নন, বরং মাস্ক বিরোধীও বটে। তারা মাস্কের বিরুদ্ধে নানা যুক্তি দেন। মাস্ক পরলে নাকি শ্বাসকষ্ট বাড়ে, মাস্ক থেকে ইনফেকশন ফুসফুসে গিয়ে ঝামেলা আরও বাড়ায়, এমনি আরও কত কী?
একটা সময় ছিল যখন খালি গায়ে ঘর থেকে বের হওয়া ছিল অভদ্রতা, আজকে শার্ট-টিশার্টের সেই জায়গাটায় মাস্ক। মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরি করলে লোকে আড়চোখে তাকায়, বিরক্ত হয়, একটু সরে বসে।
আর কোনো টিভি সাংবাদিকের সামনে পড়লে তো কথাই নেই, রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যেতে পারেন টিভিতে নিজের মাস্ক বর্জিত সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হওয়ার পর।
পুলিশের হাতে পড়লে অবশ্য একটু বেকায়দায় বটে। বলা যায় না ঘ্যাঁচ করে ধরিয়ে দিতে পারে ফাইনের ফর্দটি। প্রশ্ন হচ্ছে, মাস্ক নিয়ে কেন এত মাতামাতি? উত্তরটা প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দেই। এই গেল মার্চের কথাই ধরুন। করোনাকে হারিয়ে দিয়েছি এই আনন্দে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম কক্সবাজারের সৈকতে আর সুন্দরবনের জঙ্গলে। কেউ কেউ ছুটেছিলাম সিলেটে তো কেউ বান্দরবান।
আরেক দলতো রাস্তায় নেমে গাড়ি-বাড়ি জ্বালিয়ে সরকারকে প্রায় ফেলেই দিল বলে। কারোরই মাস্কের কোনো বালাই ছিল না। ফলাফলটাও আমরা পেলাম হাতেনাতে। ধাই-ধাই করে বাড়তে থাকল করোনা। হাসপাতালগুলোয় ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। সেখান থেকে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি সরকারের কঠোর বিধিনিষেধগুলো ঢিলেঢালাভাবে মেনে চলে তো বটেই, সেই সাথে মাস্ক পরেও।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউটা আসার আগে ঢাকার রাস্তায় বেশিরভাগ মানুষের মুখেও ছিল না মাস্ক। আর সেই মাস্কই যখন মানুষের মুখে-মুখে তখন আবারও একটু স্বস্তিতে আমরা। কাজেই মাস্কের মাহাত্ম্য অস্বীকার করার উপায়ই নেই।
আজ যারা কথায় কথায় মাস্ক নিয়ে গীবত করেন তারা একটু জাপানের দিকে তাকিয়ে দেখতে পারেন। সে দেশে মাস্ক পরাটা ওদের রক্তে ঢুকে গেছে এবং তা করোনার বহু আগে থেকেই। ওদেশে বাচ্চারা স্কুলে যায় স্কুল ড্রেস পরে, সাথে মুখে কিন্তু থাকে মাস্ক। একইভাবে ট্রেন ভর্তি ঘর ফিরতি মানুষ কিংবা শপিং সেন্টারে ভিড় করছেন যারা, মাস্ক সবার মুখে-মুখে। অথচ কোথাও কি পড়েছেন বা শুনেছেন যে জাপানিদের মধ্যে শ্বাসের রোগ বেশি?
বরং পৃথিবী জুড়ে হাতে গোনা যে দু’চারটি দেশ করোনাকে সামাল দিয়েছে ভালোভাবে, তাদের মধ্যে জাপান অন্যতম এবং তার অনেকখানিই মাস্কের কারণেই।
তবে মাস্ক পরার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতার বিষয় আছে। তিন লেয়ারের সার্জিক্যাল মাস্ক ভালো। দামেও সস্তা, কিন্তু একদিনের বেশি দু’দিন ব্যবহার করা ঠিক না। কাপড়ের মাস্ক অবশ্য বারবার ধুয়ে ব্যবহার করা যায়, কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে কোনোভাবেই ভেজা মাস্ক মুখে ঝোলানো যাবে না। এটুকু সতর্কতা আমাদের করোনাকালীন সুস্থতার গ্যারান্টি দিতে পারে।
সামনে আমরা করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কায় আছি। শোনা যাচ্ছে, ঈদের সময় ঘরে ফেরা নিয়ে আমাদের যে অন্তহীন ছোটাছুটি তাতে এমন আশঙ্কা অমূলকও নয় মোটেই। সরকার নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নিবেন সেই শঙ্কাটি যাতে বাস্তবে রূপ না নেয়।
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে চলমান বিধিনিষেধ আগামী ২৩ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সরকার তার কাজ করবে, যেমনটি করেছে এই করোনাকালে প্রয়োজনমতো দফায় দফায়। তবে আমাদেরও আমাদের কাজটি ভুলে গেলে চলবে না।
ভুললে চলবে না ঘরের বাইরে বের হতে মাস্ক অবশ্যই পরতে হবে। বিশ্বাস করুন, মাস্কের সাথে হাত ধোয়া আর শারীরিক দূরত্ব মেনে চলাটা চালিয়ে গেলে, করোনাভাইরাসের তৃতীয় ওয়েভই আসুক, চাই আসুক ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট, কিছুই আমাদের কাবু করতে পারবে না।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব ।। চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়