অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে করণীয় কী?
এটা অনস্বীকার্য যে, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভঙ্গুর ও নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। চার-পাঁচ বছরের বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ভঙ্গুর এবং নাজুক পরিস্থিতির জন্য কিছুটা দায়ী। যেমন করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বের আর দশটা দেশের মতো, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শ্লথ করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক সংকটের কথা সবাই বলছে, তার কারণ কিন্তু আসলে দেশজ।
বর্তমানে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তার কারণ অতীতের দিনগুলোয় রাষ্ট্রের সব অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধ ভঙ্গ করা হয়েছে, জবাবদিহিতার সব কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে, সব ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা হয়েছে—এক কথায়, সার্বিক এক অর্থনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা বাংলাদেশ অর্থনীতিকে আজকের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকট, খেলাপি ঋণ, অর্থ পাচার এবং বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ব্যাপ্ত দুর্নীতির কারণে বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্ম হয়েছে। অতীত অর্থনীতিতে উদ্ভূত বিশাল এবং গভীর বহু সমস্যা বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোর কাছে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এটাও সত্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইতিমধ্যে কিছু কিছু বিষয়ে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন, বাইরে থেকে অর্থপ্রবাহ বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের উন্নতি হয়েছে, সম্পদ পাচার আটকানো গেছে। ব্যাংকিং খাতে যেসব ব্যাংক ভেঙে পড়েছে, তাদের পুনর্গঠনে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদগুলো পুর্নবিন্যস্ত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বেশকিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
এতদসত্ত্বেও, বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতি, যা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ উচ্চমূল্যের শিকার। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সংযোগ নেই।
উন্নত বিশ্বে যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৩ শতাংশ, ক্যানাডায় ১ শতাংশ। সব দেশই কোভিড সম্পর্কিত এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পৃক্ত উচ্চমূল্য কমিয়ে আনতে পেরেছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ভিন্ন অন্য সব দেশের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে কম।
দুই বছর আগেকার সংকট কাটিয়ে শ্রীলঙ্কা তার ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে বর্তমান সময়ে ১ শতাংশের নিচে কমিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যহ্রাস হয়নি।
বর্তমানে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, তার কারণ অতীতের দিনগুলোয় রাষ্ট্রের সব অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধ ভঙ্গ করা হয়েছে, জবাবদিহিতার সব কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে, সব ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করা হয়েছে...
নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথ গতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন যে, আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনো তার আগের পর্যায়ে যেতে পারেনি। তেমনিভাবে, পোশাক শিল্পখাতের উৎপাদন এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
অন্যান্য শিল্পখাতেও উৎপাদন হ্রাস এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এ সবকিছু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষয় করেছে।
দেশের সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যাও একদিকে যেমন মানুষের জীবন ও জীবিকা বিনষ্ট করেছে, সম্পদের ক্ষতি করেছে, অন্যদিকে উপদ্রুত অঞ্চলের উৎপাদন কাঠামো নষ্ট করেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির ওপরে বন্যার অর্থনৈতিক প্রভাব এখনো যথাযথভাবে নিরূপণ করা যায়নি, কিন্তু দেশের বিস্তৃত অঞ্চলের ব্যাপ্ত বন্যা যে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আমরা সবাই বলছি যে, বন্যার কারণে আমাদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে পারে। নিশ্চয়ই বন্যা উপদ্রুত অঞ্চলে নানান জিনিসের দাম বাড়বে। কিন্তু যখন পণ্য উৎপাদন অঞ্চলেও অন্যান্য জায়গার মতো জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, তখন শঙ্কিত হওয়ার কারণ থাকে বটে।
অর্থনৈতিক শ্লথ গতি যে শুধু দেশের উৎপাদন খাতের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাই নয়, তা দেশের সামাজিক খাতকেও প্রভাবিত করবে। সামাজিক খাত যেমন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি জায়গায় বিনিয়োগ কমে আসতে পারে, কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা।
অবশ্য বাংলাদেশ অর্থনীতির কোনো খাতে অর্থনৈতিক শ্লথ গতি সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে, তার ওপরে এ শ্লথ গতির সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে। বিগত সময়ে শিল্পখাতে কর্ম শূন্য প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে, যেখানে খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করে নিয়োজনের প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি।
আরও পড়ুন
এ অবস্থায় শিল্পখাতে উৎপাদন হ্রাস পেলেও হয়তো কর্মনিয়োজন তেমন একটা কমবে না তবে সেবাখাতের কর্মকাণ্ড হ্রাস পেলে মানুষের কর্মনিয়োজন এবং আয়ের ওপরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে। যেহেতু নানাবিধ অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বিদ্যমান, তাই কাঙ্ক্ষিত দেশজ এবং বিদেশি বিনিয়োগ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করছে না। ব্যাংকিং খাতও খুব যে ভালো একটা অবস্থায় আছে, তাও নয়। ফলে প্রবৃদ্ধির সুযোগও হ্রাস পেয়েছে।
বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কিছু প্রাক্কলন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছেন যে ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.১ শতাংশ হতে পারে। এর আগে একই অর্থবছরের জন্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট প্রাক্কলিত সংখ্যা ছিল ৫.১ শতাংশ।
এসব উপাত্ত থেকে দুটো বিষয় খুব স্পষ্ট : এক, প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতারই প্রতিফলন। দুই, যদিও দেয় উপাত্তের মধ্য পার্থক্য আছে, কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক উভয়েই তাদের পূর্ব প্রাক্কলিত উপাত্তকে কমিয়ে নিয়ে এসেছেন।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে আয় এবং সম্পদের অসমতা সর্বজনবিদিত। হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কিংবা অর্থপাচারের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে অর্থ ও বিত্ত কয়েকটি মানুষ এবং পরিবারের কুক্ষিগত। মোটাদাগের উপাত্তের দিকে যদি তাকাই, তাহলে আয়ের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ যেখানে দেশের নিম্নতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয়, সেখানে সমাজের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। এর প্রথমেই রয়েছে মূল্যস্ফীতি, যা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ উচ্চমূল্যের শিকার। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সংযোগ নেই।
মানব উন্নয়নের নানান সূচকেও এমন বৈষম্য বিদ্যমান। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুর হার সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেখানে প্রতি হাজারে ৪৯, সেখানে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা প্রতি হাজারে ২৫। আঞ্চলিক বৈষম্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যায়, বরিশালে সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সিলেটে সেটা ৬০ শতাংশ।
বৈষম্য শুধু ফলাফলেই নয়, সুযোগের ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুযোগে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। শিক্ষায় সরকারি এবং বেসরকারি ধারা, বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যম, বিত্তবান এবং বিত্তহীনদের জন্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রবণতার মাধ্যমে শিক্ষা সুযোগে একটি বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে।
একইভাবে স্বাস্থ্যখাতে ত্রি-ধারা ব্যবস্থা বজায় রেখে স্বাস্থ্য সুযোগের ক্ষেত্রেও একটি বিশাল বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেবার পরিমাণ যেমন অপ্রতুল, তেমনি তার মানও খুব নিচু। সাধারণ মানুষই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুবিধা পান না।
বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা এইসব বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তবে এসব অর্থনীতির সত্ত্বেও আশা করা যাচ্ছে যে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশ এসব অন্তরায় কাটিয়ে উঠতে পারবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার চলমান উন্নতি এবং সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, বাংলাদেশ স্থিতিশীল ভিত্তির ওপরে দাঁড়াতে পারবে, যার ফলে অর্থনীতি বিষয়ে জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস আরও মজবুত হবে।
ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র