তরণী চলছে শুভ লক্ষ্যে
১৯৮১ সালের ১৭ মে। স্বাধীনতার এক দশক পূর্তির কয়েকদিন পর বাঙালিকে দ্বিতীয়বার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস নথিভুক্ত করতে হলো। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস ও ঘটনাবলীর সঙ্গে তার আত্মজা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস মিলিয়ে পড়লে আমাদের চোখের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের এক দশকের রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও উত্থান-পতনের চিত্র ভেসে ওঠে।
যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন স্বভূমিতে পা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সে স্বপ্নের মানচিত্র থেকে ছিটকে পড়েছিল বাংলাদেশ। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস আমরা জানি, কিন্তু এই জানাটুকু কেবল ইতিহাসের পৃষ্ঠায় আটকে রাখি বলেই আমরা আজও হোঁচট খাই।
অনেকেই মনে করেন, ইতিহাস কেবলই পুরনো দিনের কথা; কিন্তু এই কথার মধ্যেই যে ভবিষ্যতের বীজ লুকানো— সে কথা মানতে নারাজ। ফলে আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে যে নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের মনে আসে, আমরা যদি ইতিহাসনিষ্ঠ হই, তবে বুঝতে পারবো— এর উৎসমুখ হলো পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক সমীকরণ। এ কিন্তু বর্তমান বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা নয়, বরং অসুখের মূল কারণটি খুঁজে বের করা।
যে মানুষটির নেতৃত্বে একটি জাতি তার স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য মরণ মুখী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, যে মানুষটির মধ্যে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতিফলন ঘটেছিল বলেই তিনি জাতির পিতা; স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মাথায় তাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কেবল হত্যাকাণ্ডই নয়, এই হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দিয়ে সংসদে বিল পাস করানো হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে বঙ্গবন্ধুর সময়ে নিষিদ্ধ যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দলকে রাজনীতির সুযোগ করে দেওয়া হয়। এরপর তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রীয় মহড়া দেখি আমরা।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ যেমন, তেমনি সংকটকাল অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েমের জারি করা ‘রাজনৈতিক দলবিধি’র শর্ত অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বিপদে ফেলার জন্যই ওই বছরের ৪ আগস্ট সংশোধনীর মাধ্যমে ‘রাজনৈতিক দলবিধি’তে ১০টি উপধারা যুক্ত করা হয়, যার ১০ নম্বর উপদফাটি ছিল—‘কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিবার জন্য পরিকল্পিত হয় কিংবা এইরূপ শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিতে পারে বলিয়া সম্ভাবনা রহিয়াছে...।’
১৯৭৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সরকারি অনুমোদনের জন্য যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবেদন করে, তখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি থাকার কারণে আওয়ামী লীগকে সেদিন অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
একটু ভেঙে বললে এই ১০ নম্বর উপদফার ব্যাখ্যাটি দাঁড়ায়, পঁচাত্তর-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে বঙ্গবন্ধুর নাম বা ভাবমূর্তি ব্যবহার করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু পরিবারে জীবিত বলতে ছিলেন তার দুই সন্তান শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। তাদের নামও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, ১৯৭৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সরকারি অনুমোদনের জন্য যখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবেদন করে, তখন ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি থাকার কারণে আওয়ামী লীগকে সেদিন অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আর বঙ্গবন্ধুর পরিবারের জীবিত সদস্যদের দেশে ফেরা ঠেকাতে নানা রকম বিধি-নিষেধ ও ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছিল তৎকালীন সরকার।
ইতিহাসের এ অংশটুকু উল্লেখ করলাম কেবল এটুকু বোঝানোর জন্য যে, কী বীভৎস প্রতিহিংসা সেদিন জারি রেখেছিল জিয়াউর রহমানের সরকার, কেবল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু এই বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেও বঙ্গবন্ধুর বড় সন্তান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালের আজকের দিনে। সেদিন ছিল রবিবার এবং কালবৈশাখীর প্রচণ্ড প্রকোপ আছড়ে পড়েছিল নগরে। কিন্তু এই দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াও সেদিন মানুষের মিছিলের ঢলকে আটকাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর পদবিক্ষেপ অনুসরণ করেই সেদিন লক্ষ জনতার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন তার সন্তান শেখ হাসিনা।
১৯৮১ সালে উনি প্রবাসে থাকাকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার হাতেই নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রায় ১৫ বছর পর অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। এই ১৫ বছর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। বহুবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে বিএনপি-জামাত-ফ্রিডম পার্টি সমন্বিত একাত্তরের পরাজিত শক্তি।
১৯৮১ সালে উনি প্রবাসে থাকাকালীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তার হাতেই নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর যখন যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে, তখন আবারও নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয় আওয়ামী লীগকে। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন রাজনৈতিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড আর সন্ত্রাস চালিয়েছিল তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। কিন্তু তারপরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এগিয়ে গেছে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে।
সরকার গঠনের পর তারই নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার বিচারসহ ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দায়সমূহ একে একে সম্পন্ন করেছে।
বর্তমানে কেবল বাংলাদেশেরই নয়, গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যবস্থাই নানা ধারায় বিবর্তিত হচ্ছে। এই বিবর্তনের পথ ধরে আওয়ামী লীগও এগিয়ে চলছে দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। অন্যদিকে বাংলাদেশ গত এক দশকেই প্রবেশ করেছে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সূচকের নানা পর্যায়ে। এই ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোর জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ঐতিহাসিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ইতিহাস তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে আজ অব্দি চলমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার