ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বরোচিত হামলার শেষ কোথায়?
গত কয়েক দিন ধরে গাজায় আবারও ইসরায়েলিরা ভয়াবহ নারকীয় তাণ্ডবলীলা চালানো শুরু করেছে। গত সোমবার জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিনশরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাজা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের দিকে রকেট ছোড়া শুরু করে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার বিভিন্ন শহর ও নগরে ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস সদস্যদের সন্ধানে ঘরে ঘরে হামলা চালানো শুরু করেছে। ইসরায়েলিরা হামাস সংগঠনের নামে যে আক্রমণ চালাচ্ছে তাতে প্রাণ হারাচ্ছে শত শত নিরীহ জনগণ। দেখা যাচ্ছে, একজনের বিপরীতে এক-দেড়শ নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এই নারকীয় তাণ্ডবলীলার জন্য ইসরাইলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, ষষ্ঠ দিনের মতো গাজা উপত্যকায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী। তারা শনিবার সকালে গাজার একটি শরণার্থী শিবিরেও বোমা হামলা করেছে। এতে অন্তত ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের ৮ জনই শিশু। আর গত ১০ মে থেকে শনিবার পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় মোট ১৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৯ জনই শিশু। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৯৫০ জন।
ইসরায়েলি পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করছে এবং গুলিবর্ষণ করছে আর এখন বিমান হামলা শুরু করেছে। এতে তারা বলছে, তারা তাদের শত্রুদের এবং জঙ্গিদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হচ্ছে এবং নিরীহ বেসামরিক জনগণের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার জবাবে গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসও রকেট ছোড়া অব্যাহত রেখেছে। শনিবার ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলীয় শহর রামাত গান, দক্ষিণাঞ্চলের আশকেলন ও আশদোদ শহরের দিকে রকেট হামলা চালিয়েছে হামাস। এতে এক ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত হামাসের রকেট হামলায় নয় ইসরায়েলির মৃত্যু হয়েছে।
ইসরায়েলি পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করছে এবং গুলিবর্ষণ করছে আর এখন বিমান হামলা শুরু করেছে। এতে তারা বলছে, তারা তাদের শত্রুদের এবং জঙ্গিদের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হচ্ছে এবং নিরীহ বেসামরিক জনগণের ওপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে।
হামাস নামে সংগঠনটি মনে করে ভূমি সন্তানদের সরিয়ে দিয়ে দখলদার ও কৃত্রিম ইসরাইল রাষ্ট্রটির টিকে থাকার কোনো অধিকার নেই। যদিও ইসরায়েলিরা দাবি করছে, হামাস সংগঠনের বিভিন্ন আক্রমণই তাদেরকে বাধ্য করছে এই ধরনের বর্বর আঘাত হানতে। যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে হামাসের জবাবে তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিমান, জাহাজ আর স্থূল আক্রমণ করে শত শত নিরীহ মানুষ হত্যা করা শুরু করে।
নিষিদ্ধ সংগঠন হামাস, অবৈধ দখলদারির প্রতিবাদে বিভিন্ন সময় যখন রকেট ছোড়ে আর তা পড়ে সাধারণত খোলা ময়দানে। আর ইসরায়েল হামাসের জবাব দিচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করে। এই ধরনের অমানুষিক কর্মকাণ্ডের জন্য সব দেশের উচিত ছিল ইসরাইলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। বিশ্ব মুসলিম নেতাদেরও উচিত ছিল ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করা। কিন্তু দেখা যায় আরব বিশ্বসহ অন্যান্য দেশও ইসরায়েলি বর্বরতার বিপক্ষে সোচ্চার না হয়ে বরং নীরবতা পালন করছে।
প্রশ্ন হলো, সারা বিশ্ব কেন নীরব? কেন আরব বিশ্ব সহনশীল? তারা কি এই বর্বর হামলার প্রতিবাদ করতে পারে না? এখানে সন্ত্রাস নির্মূলের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন হচ্ছে মানবতার। আমরা হামাস মতাদর্শের সমর্থন করি না ঠিকই, কিন্তু গাজার নিরীহ জনগণকে কোন অপরাধে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে? এটাই সারা বিশ্ব দরবারে আমাদের প্রশ্ন।
দোষ যদি আমি করে থাকি তাহলে তার শাস্তি আমারই প্রাপ্য। আমার অপরাধের জন্য আমার পিতা-মাতা, ভাই-বোন বা আত্মীয়স্বজন শাস্তি পাবে এটা হয় না। হামাসের লোকদের নির্মূল করতে ইসরায়েলিদের এই বেপরোয়া হামলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। কোন অপরাধে নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে এর জবাব কি হামাস অথবা ইসরায়েলি সৈন্যদল দিতে পারবে?
গাজার ইতিহাস সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লীগ অব নেশনসের ম্যান্ডেট অনুযায়ী গাজা ফিলিস্তিনের একটি অংশ হয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার সময় মিসর এলাকাটা দখল করে। তখন পাশের এলাকার ফিলিস্তিনিরা গিয়ে সেখানে আশ্রয় নেয়। তারা এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখনো জাতিসংঘের শরণার্থী শিবিরে বাস করে।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে গাজা ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। সেখানে প্রায় আট হাজার ইহুদি বসতি স্থাপন করে। তবে ২০০৫ সালে সব ইসরায়েলি সেনা আর বসতি স্থাপনকারী গাজা ত্যাগ করে। সেই সময় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজা নিয়ন্ত্রণে নেয়। পরের বছর নির্বাচনে জিতে হামাস গাজা ও পশ্চিম তীরে সরকার গঠন করে। হামাস ও ফাতাহ মিলে একটি ঐক্যের সরকারও হয়। তবে ফাতাহর নেতা প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনি পার্লামেন্ট ভেঙে দিলে আবার অনৈক্য দেখা দেয়।
ইসরায়েলিরা দাবি করছে, হামাস সংগঠনের বিভিন্ন আক্রমণই তাদেরকে বাধ্য করছে এই ধরনের বর্বর আঘাত হানতে। যার ফলে দীর্ঘদিন ধরে হামাসের জবাবে তারা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিমান, জাহাজ আর স্থূল আক্রমণ করে শত শত নিরীহ মানুষ হত্যা করা শুরু করে।
২০০৭ সালের জুন মাসে হামাস অভিযোগ করে, ফাতাহর বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় হামাসকে সহিংসতা পরিহার করে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি তোলে, না হলে তাকে বয়কট করা হবে বলে ঘোষণা দেয়। এখন স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মনে হয় এ সংকটের কোনো সমাধান নেই।
যদিও এ বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে হামাস ও ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত শুক্রবার টুইটারে এক পোস্টে গুতেরেস লিখেছেন, ‘ঈদের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি গাজা ও ইসরায়েলে তাৎক্ষণিকভাবে সহিংসতা প্রশমন ও বন্ধের আবেদন জানাচ্ছি।’ তিনি আরও লেখেন, ‘অনেক নিরীহ বেসামরিক নাগরিক ইতোমধ্যে মারা গেছেন। এই সংঘর্ষ পুরো অঞ্চলে কেবল উগ্রবাদ ও চরমপন্থা বাড়িয়ে তুলবে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। প্রতিদিন আক্রমণের রূপ ভয়াবহ হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে দিনের পর দিন ইসরায়েলি নারকীয় তাণ্ডবলীলা বেড়েই চলেছে।
অপর দিকে ইসরায়েলি হামলার জবাব দিতে হামাস চুপচাপ বসে থাকবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের সামরিক শাখা আল কাসেম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু ওবায়দা বলেছেন, ‘আল্লাহর সাহায্যে আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ছয় মাস যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রেখেছি।’ ১৫ মে হামাসের রকেট হামলায় এক ইসরায়েলি নিহতের পরপরই ভিডিও বার্তায় তিনি এমন ঘোষণা দিয়েছেন। আবু ওবায়দা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘গাজার বিভিন্ন আবাসিক ভবনে নির্বিচারে বোমা হামলা চালিয়ে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইসরায়েলের জন্য শিগগিরই ভয়াবহ পরিণতি অপেক্ষা করছে।’
তাহলে কি এভাবেই প্রতিনিয়ত শত শত নিরীহ মানুষ প্রাণ দিতে থাকবে? এই মৃত্যু খেলা কি চলতেই থাকবে? বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কি কিছুই করার নেই? আজ ফিলিস্তিনিদের জন্য আমরা কিছু না করতে পারলেও তাদের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা তো করতে পারি। সৃষ্টিকর্তাই পারেন সে দেশে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনতে। আর বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোরও যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত ইসরায়েলিদের এই বর্বর হামলার প্রতিবাদে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ করা।
মাহমুদ আহমদ ।। গবেষক ও কলামিস্ট