সড়কে প্রাণহানি কমিয়ে আনার কি কোনো উপায় নেই?
প্রতিদিন সড়কে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। কেউ মা, কেউ বাবা, আবার কেউ হারাচ্ছেন সন্তানসহ আপনজনদের। কেউ কেউ পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। শত শত পরিবার হয়ে যাচ্ছে অসহায়। নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন, ধর্মঘট, মিছিল, সমাবেশ কত কিছুই না হলো।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে নানা কাণ্ড ঘটে গেল ২০১৮ সালে। যার মধ্যে সাড়া জাগানো বিষয়, নিরাপদ সড়কের জন্য দেশ কাঁপানো আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তৎকালীন সরকারের দিক থেকে সড়ক নিরাপদ করতে নানা আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা এখন ভিন্ন।
দেশের সড়ক-মহাসড়ক দিন দিন আরও প্রাণঘাতী হয়েছে। জনমনে আজও প্রশ্ন, আদৌ কি এই নিরাপদ সড়ক আমরা পেয়েছি? থেমেছে কি সড়কে মৃত্যুর মিছিল?
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৯২টি। এতে ৪২৬ জন নিহত এবং ৮১৩ জন আহত হয়েছে। আগস্ট মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত হয়েছিল। সেই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ১৪.১২ জন।
সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪৯৫টি। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২৪ জন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৯৫ জন। তবে সড়কে মৃত্যুর সরকারি এই হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যের পার্থক্য অনেক।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, ২০২১ সালে সড়ক দুর্ঘটনার বিআরটিএ’র হিসাবে ৫,০৮৪ জন মানুষ মারা গেলেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে দেশে মারা গেছে ৩১,৫৭৮ জন। অর্থাৎ বিআরটিএ’র তুলনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুসারে পাঁচগুণেরও বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে।
সড়কে বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়লেও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দেওয়া তথ্য অনুসারে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এটা কমে আসছে। ২০১০ সালের তুলনায় মৃত্যুর হার কমেছে অন্তত ১০৮টি দেশে যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাও।
সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক ও স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশে নেই। ফলে দুর্ঘটনার তথ্য নিয়ে ভিন্নতা দেখা যায়। বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া দুর্ঘটনার তথ্যের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে পার্থক্য থাকে প্রায় পাঁচ গুণ।
আমি পরিসংখ্যান নিয়ে টানাটানি করব না। কারণ পরিসংখ্যান ঘাটলে হতাশা আর কষ্ট ছাড়া কিছুই প্রাপ্তি নেই। আমি শুধু বলতে চাই, সড়কে প্রাণহানি কমিয়ে আনার কি কোনো উপায় নেই?
দেশে কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। পত্রিকার পাতা খুললে কিংবা টিভি চ্যানেলের সংবাদের দিকে চোখ রাখলে প্রায় প্রতিদিনই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত হওয়ার খবর।
দেশে প্রতিনিয়ত মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও এখন দুর্ঘটনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। ফলে প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে; পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হতাহতের ঘটনা।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নতুনভাবে দেশ পরিচালনা করার আগে মনে করিয়ে দিতে চাই নিরাপদ সড়কের কথা। যে সড়কের জন্য শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছে, যে সড়কের জন্য স্বজনদের হৃদয় পুড়েছে, যে সড়কের জন্য হাজার হাজার পরিবার ধ্বংস হয়েছে।
বর্তমান সরকার যদি এই বিষয়টির দিকে সুনজর না দেয় তাহলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কখনোই থামবে না। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্তমান বিদ্যমান আইন ও বিধি যথেষ্ট নয়। আইনটিতে হেলমেট পরিধানের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এর মানদণ্ড ও ব্যবহারবিধি আইনে অনুপস্থিত।
আইনে গতিসীমা লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান বর্ণিত থাকলেও গতিসীমা নির্ধারণ, এর বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা, গাইডলাইন সন্নিবেশিত হয়নি, যা বাস্তবায়ন অযোগ্য। এছাড়া যাত্রীদের সিটবেল্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা ও শিশুদের জন্য নিরাপদ বা সুরক্ষিত আসন ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আইনটিতে সংযোজন করা হয়নি। তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অতিদ্রুত একটি ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি।
আরও পড়ুন
সড়কে রোজ মৃত্যু হচ্ছে। অথচ এ সেক্টরের কারো কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। আইন থাকলেও কার্যকর হয় না সেই আইন। কারণ আইনেও এখন চলছে অঙ্কের হিসাব। তাই সুশাসন এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত করলে সব দিকেই জনগণের উন্নয়ন হবে। আর জনগণের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন।
আমাদের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়ক পরিবহন আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত। এই আইন ও বিধিমালা সড়ক নিরাপত্তা বিধিমালা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট নয়। সব ধরনের সুরক্ষা সম্পর্কিত সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য পৃথক ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে।
দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উপদেষ্টার প্রতি আমার অনুরোধ, দেশের উন্নয়ন করছেন দেশের মানুষের জন্য। কিন্তু দেশের মানুষ যদি বেঁচে না থাকে, তবে দেশের উন্নয়ন করাটা বৃথা হয়ে যাবে। তাই শ্রদ্ধার সঙ্গে বলছি, দেশে সাজানোর পাশাপাশি দেশের মানুষ বাঁচান।
সড়ক অবকাঠামো ও যানবাহনের নিরাপত্তা, দুর্ঘটনার পর উদ্ধার ও চিকিৎসা, সিট বেল্ট ও যানবাহনে শিশুদের নিরাপত্তার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করুন।
আমার বিশ্বাস, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সেক্টরকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারবে। সেই সুন্দরের অপেক্ষায় রইলাম আমি এবং আমার দেশের মানুষ।
তরিকুল ইসলাম ।। অ্যাডভোকেসি অফিসার (কমিউনিকেশন), স্বাস্থ্য সেক্টর, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন
[email protected]