প্রত্যাশা বেশি বলেই সমালোচনা বেশি
আজকাল নতুন নতুন শব্দের বিপুল ব্যবহার দেখছি। তালিকায় না যাই। ‘ফ্রন্ট লাইনার’-সম্মুখ সারির, শব্দটি বহুল প্রচার পায় যুদ্ধের সময়। একেবারে সামনে থেকে যারা যুদ্ধ করেন তারাই হচ্ছেন ‘ফ্রন্ট লাইনার’। পরে এর কিছুটা সর্বজনীন ব্যবহার হলো, যারাই সামনে তারাই ’ফ্রন্ট লাইনার’।
হালে করোনাকালে এই শব্দটি আবার হাজির। করোনা যুদ্ধে সবাই মাঠে। অজ্ঞাত অচেনা অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। শত্রু কোন দিক থেকে কখন, কাকে আক্রমণ করে তার কোনো ঠিক নেই, কাজেই লড়াইয়ের প্রস্তুতিও চার দিকেই। ফ্রন্ট লাইনের শাব্দিক অর্থও গেল পাল্টে, চারদিকই এখন ফ্রন্ট লাইন।
কাজ নিয়ে এতটা আলোচনা হলো না, কিন্তু যেই প্রাপ্তিযোগের প্রশ্ন এল তখনই শুরু হলো, কারা আসলে ফ্রন্ট লাইনার। ডাক্তাররা বললেন তারাই, কারণ তারাই তো একেবারে সামনে থেকে রোগীদের সেবা দেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সোচ্চার হলেন, সনাতনী যুদ্ধ নাই তো কি, আমরা তো এই যুদ্ধে মাঠে নেমেছি, লকডাউন সামলাচ্ছি, রোগী ফেলে স্বজনরা পালাচ্ছে, আমরা সব সামাল দিচ্ছি, কাজেই আমরাও তো সম্মুখ সারি থেকেই কাজ করছি। অত্যন্ত সংগত কথা।
দেশে বেসরকারি টেলিভিশন শুরুর সূচনা লগ্নে বিস্মিত হতাম বিশেষ করে ঈদের দিনে নারী সাংবাদিকদের অফিসে ডিউটি করা দেখে। পারিবারিক সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে কীভাবে তারা এই দায়িত্ব পালন করতেন সে এক বিস্ময়।
হালে দেখি ব্যাংক কর্মচারীরাও বলছেন, আরে ব্যাংক বন্ধ থাকলে অর্থনীতিই তো বন্ধ, আমরাতো ঝুঁকি নিয়ে ব্যাংক খোলা রাখছি, কাজেই.....
যাদের কথা বললাম তাদের কাজ ও দায়িত্বশীলতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।
সাংবাদিকদের কথা যখন আসে তখন সবাই তাদের ধন্যবাদ দেন, কিন্তু তারাও যে ফ্রন্ট লাইনার একথাটা কেউ জোরেশোরে যেমন বলেন না; তেমনি অন্য ফ্রন্ট লাইনারদের মতো বেঁচে থাকার প্রণোদনা বা মারা গেলে ক্ষতিপূরণ কোনোটা নিয়েই তেমন কথা হয় না। কিন্তু তাতে সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত কাজে হাল ছেড়ে বসে আছেন তেমনটি নয়।
কে, কি দেবেন সাংবাদিকরা এমন কোনো ভরসার আশায় দায়িত্ব পালন করেন না। আসলে সাংবাদিকরা ফ্রন্ট লাইনারদেরও অগ্রগামী। কোথাও কোনো কিছু ঘটলে প্রথম যাদের সেখানে উপস্থিত থাকতে হয় তারাই হচ্ছেন সাংবাদিক, ফার্স্ট রেসপন্ডেন্ট।
কোনো প্রণোদনা বা মারা গেলে কী হবে জরুরি অবস্থায় এমন প্রশ্ন করে সাংবাদিকরা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। সেটা সিডর, আইলা বা হাওরের বন্যা অথবা রানা প্লাজা ধ্বসে পড়া যাই হোক না কেন। করোনার কথাই ধরা যাক, একেবারে শুরুর দিকে পিপিই, গ্লাভস, হেডকভার বা মাস্কের জন্যতো সাংবাদিকরা বসে থাকেনি। সীমিত সামর্থ্য, সীমিত জ্ঞানে অমিত সাহস নিয়ে সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অসম এক যুদ্ধে। এই কাজটি তারা করেন শুধু ‘যুদ্ধকালীন’ সময়ে নয়, শান্তিকালীন সময়েও।
ধরা যাক, ঈদ উৎসবের কথা। শুধু প্রিন্ট মিডিয়ার যুগে সাংবাদিকরা তিনদিন ঈদের ছুটি কাটাতেন। এই তিন বা চারদিনে যেন সব খবরেরও ছুটি! সরকার নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন আর রেডিওতো কেবল বিনোদন মাধ্যম। এল নিউজ এজেন্সির যুগ, পাঠকদের কিছু হলো না, কিন্তু এজেন্সি খোলা থাকল ২৪ ঘণ্টা, সাতদিন। সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা তিনদিন পরে হেলে দুলে কিছু পুরনো, কিছু নতুন খবর দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে ছুটির আড়মোড়া ভাঙ্গতেন।
সব পাল্টে গেল বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন সংবাদমাধ্যমের যুগে। এখন পৃথিবীও ঘুমায় না, মানুষ তাৎক্ষনিক সবকিছু জানতে চায়। কাজেই চার প্রহর জেগে থাকতে হয় সংবাদমাধ্যম আর সাংবাদিকদের।
নিজের হয়তো বেতন বোনাস হয়নি কিন্তু ঝলমলে ঈদ বাজারের উজ্জ্বল কেনাকাটার খবরে সবাইকে তুষ্ট রেখে নিজে সন্তুষ্ট থাকেন একজন সাংবাদিক। এই চিত্র কষ্ট কল্পিত নয়।
দেশে বেসরকারি টেলিভিশন শুরুর সূচনা লগ্নে বিস্মিত হতাম বিশেষ করে ঈদের দিনে নারী সাংবাদিকদের অফিসে ডিউটি করা দেখে। পারিবারিক সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করে কীভাবে তারা এই দায়িত্ব পালন করতেন সে এক বিস্ময়।
ঈদের দিনে বাবা, মা, ভাই, বোন, কেউ কেউ স্বামী সন্তানকে বাসায় রেখে, শ্বশুর-শাশুড়ি, এমনকি পাড়া-পড়শির হাজার প্রশ্নের পাহাড় ঠেলে একজন কন্যা-বধূ কীভাবে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতেন; সেই অভিজ্ঞতা কেবলমাত্র তারাই বলতে পারবেন। সংবাদপত্রে রাতের পালায় ডিউটি করা আর উৎসবের দিনে পরিবারের বাইরে এসে পেশাগত দায়িত্ব পালনের এই সংস্কৃতি বদলের পথ যারা তৈরি করেছেন তাদের স্যালুট।
নারীদের কথা বিশেষভাবে বলা হলেও দৃশ্যত সাংবাদিকরা আসলে পথ চলেন এমন নানা চ্যালেঞ্জের হাত ধরেই। কেউ তাকে ফ্রন্ট লাইনারের স্বীকৃতি বা প্রণোদনা দিক বা না দিক তাতে কিছুই যায় আসে না। ঘরেরও নয় পরেরও নয় সাংবাদিকরা আছেন মাঝখানে।
একজন মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই তাকে ঘরের দায়িত্ব পালন করতে হয়, ঘরকে বাদ দিয়ে তো সুস্থ জীবন প্রবাহিত হয় না। আবার সাংবাদিকের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পুরোটা জুড়েই আছেন এমন ‘পর’- যারা আসলে তার আপনের চাইতে বেশি আপন। সাংবাদিকের সকল কাজই হচ্ছে এই ‘আপন’দের জন্য।
একজন সাংবাদিক নিজে হয়তো অভুক্ত কিন্তু এই ‘আপন’দের তথ্য ক্ষুধা মেটাতে তিনি ছুটছেন অবিরত। নানা সীমাবদ্ধতায় সন্তানের শিক্ষা হয়তো বাধাগ্রস্ত কিন্তু সঠিক তথ্য দিয়ে জাতিকে শিক্ষিত করে তোলার দায়টি সাংবাদিকের। নিজের ব্যক্তিগত আনন্দ-বিনোদনকে বিসর্জন দিয়ে দেশের মানুষকে বিনোদন দেওয়ার দায়িত্ব তার কাঁধে। নিজের হয়তো বেতন বোনাস হয়নি কিন্তু ঝলমলে ঈদ বাজারের উজ্জ্বল কেনাকাটার খবরে সবাইকে তুষ্ট রেখে নিজে সন্তুষ্ট থাকেন একজন সাংবাদিক। এই চিত্র কষ্ট কল্পিত নয়।
দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল একসময় সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল। তখন এক জরিপে সেই বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংবাদিকরা বলেছিলেন, হত্যা, হুমকি, খুন, গুম যাই হোক না কেন তারা সাংবাদিকতা ছেড়ে দেবেন না।
এটাই হচ্ছে সাংবাদিকতার অন্তর্নিহিত জীবনী শক্তি। সাংবাদিকদের নিয়ে অনেক প্রশ্ন একারণেই যে, তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি, নির্ভরতা অনেক বেশি। যাদের কাছে প্রত্যাশা বেশি তাদের সমালোচনাও বেশি। মানুষের আস্থার কারণেই সাংবাদিকতা টিকে থাকবে; প্রকৃত সাংবাদিকরা সব চ্যালেঞ্জর সাথে লড়াই করেই এগিয়ে যাবেন। সময়ে- দুঃসময়ে, উৎসবে- আনন্দে সাংবাদিকরা ব্যক্তি পরিবারের চাইতে বৃহত্তর সমাজের ‘আপনজন’দের পাশেই থাকেন। এটাই পেশাদারিত্ব।
মনজুরুল আহসান বুলবুল ।। এডিটর ইন চিফ, টিভি টুডে