করোনায় ঈদযাত্রা: আনন্দের নাকি শঙ্কার?
নিদারুণ মনোকষ্ট নিয়ে ফেরির বিপুল লোকারণ্যে হিট স্ট্রোকে কয়েকজনের মৃত্যু ও অসুস্থতার খবর শুনলাম। মনটা অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হলো। বাড়ি যাওয়ার আকুতি-তীব্রতা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায় সহজেই। কিন্তু, যে মায়ার টানে ছুটে যাওয়া, সেই ভালবাসার খাতিরেই এবার দূরে থাকা প্রয়োজন ছিল।
করোনার সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির সময়, এবারের ঈদে বাড়ি না যাওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সেজন্যই গণপরিবহন বন্ধ করা হলো, দফায় দফায় সতর্ক করা হলো, সব প্রচেষ্টায় বিফল। ঈদযাত্রার যে ঢেউ নামতে দেখলাম ফেরি থেকে, তাতে বুঝে গেছি করোনার পরবর্তী ঢেউ ঠেকানোর কোনো সুযোগ সম্ভবত আমাদের হাতে আর নেই।
যাত্রীদের নিজেদের কষ্ট, নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু যাদের জন্য বাড়ি ফেরা, তাদের জন্য কি আমাদের এই ঈদযাত্রা মঙ্গল বয়ে আনছে? নাকি আমাদের ভালবাসার মানুষগুলোকেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছি আমরা?
যারা গায়ে গায়ে ঠেলাঠেলি করে ফেরিতে ঈদযাত্রা করেছেন তাদের মাধ্যমে ভাইরাসটা ছড়িয়ে যাবে সারাদেশে। তখন আমার-আপনার সকলের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। তাই আপনার এই স্বাস্থ্যবিধি পরিপন্থী ঈদযাত্রা আমাদের সকলের দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির শুরুতেই ‘লকডাউন’ দিয়ে সবকিছু শক্ত হাতে বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ ছিল বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে হলো এক ‘ঢিলেঢালা লকডাউন’ জাতীয় কিছু একটা। অফিস-আদালত সব খোলা, প্রাইভেট গাড়ি চলবে কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ।
একসময় দোকানও খুলে দেওয়া হলো ‘ঈদ শপিং’-এর জন্য। আতঙ্কিত হয়ে দেখলাম সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে কেনাকাটায়। মাস্ক নেই, স্বাস্থ্যবিধির বালাই নেই। এরপর খুলে দেওয়া হলো ঢাকার ভেতরের গণপরিবহন। এরপর এল ঈদযাত্রার সেই আত্মঘাতী ঢেউ। এক্ষেত্রেও দেখতে পাই এক সমন্বয়হীনতার চিত্র।
গণপরিবহন বন্ধ রেখে ফেরি চলাচল উন্মুক্ত করা হলো। পায়ে হেঁটে, ফেরিতে চড়ে, গায়ে গায়ে লাগিয়ে লাখ লাখ মানুষ নিজ গ্রামে যাওয়ার পরে মোতায়েন করা হলো বিজিবি। এরপর আবার ফেরি চলাচলের অনুমতি দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন। কেন এই সিদ্ধান্তহীনতা?
ভারতে মহামারির ভয়াবহতা দেখে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের সুযোগ পেয়েছিলাম। জন গুরুত্বসম্পন্ন যেকোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারকে আপসহীন হতে হবে। সরকারের কোনো কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমানতা প্রকাশিত হলে জনগণ সেই সিদ্ধান্তকে আর গুরুত্ব দেয় না। এ কারণেই, লকডাউন সফল হয়নি, কেউ মাস্ক পরে না, ইচ্ছামতো ঘোরাঘুরি করে, ফেরিতে গাদাগাদি করে ঈদে বাড়ি যায় আবার ফিরে আসে।
করোনার মতো ভয়াবহ মহামারির প্রতিরোধ নাগরিকদের ব্যক্তি সচেতনতার ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। সরকারকেই সঠিক সিদ্ধান্ত সময়ের আগে নিয়ে, শক্ত হাতে সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে।
জনগণ যখন কথা শুনবেই না পণ করেছে, তখন সরকারকেই এর বিহিত করতে হবে। ভারতের মহামারি থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে। পর্যাপ্ত করোনা হাসপাতাল, অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, প্রয়োজনীয় এম্বুলেন্স, এমনকি অধিক সংখ্যায় মৃতের সৎকারের প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থাপনা কি হবে তা এখনই গুছিয়ে আনা প্রয়োজন। আরও ডেডিকেটেড হাসপাতাল ও চিকিৎসক প্রয়োজন হলে এখনই অধিক সংখ্যায় প্রস্তুত রাখা জরুরি।
মাস্ক, পিপিই, ওষুধ, হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা, ভেন্টিলেটর—কত কিছু প্রয়োজন। কোনো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা যেন আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে। সেই সাথে করোনা রোগী বাদে অন্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা চালিয়ে নেওয়ার জন্যও সুষ্ঠু ও বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনা এখনই প্রয়োজন।
বাড়ি ফেরা লোকজন এই দু-চার দিন পরেই আবার একইভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে ফিরবে। তাদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কী হবে এখনই ঠিক করা দরকার। একটি বিষয় স্পষ্ট করে অনুধাবন করা প্রয়োজন, করোনার মতো ভয়াবহ মহামারির প্রতিরোধ নাগরিকদের ব্যক্তি সচেতনতার ওপর ছেড়ে দেওয়া যায় না। সরকারকেই সঠিক সিদ্ধান্ত সময়ের আগে নিয়ে, শক্ত হাতে সেটার বাস্তবায়ন করতে হবে। এটাই এখন সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
দুর্যোগের মধ্যেও ঈদ আসে। অনেক শঙ্কার ভেতরেও ঈদ তার নিজস্ব আনন্দ নিয়েই আসবে। এ আনন্দ যেন শঙ্কায় পরিণত না হয়, এই পবিত্র মাসে এইটাই চাওয়া।
ডা. নুজহাত চৌধুরী ।। অধ্যাপক, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়