করোনায় কোয়ারেন্টাইন: ভালো, মন্দ ও উৎকোচ
বাংলাদেশের বিশ্বনন্দিত ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান এবং মুস্তাফিজুর রহমান ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন। করোনাভাইরাসের অতিসংক্রমণশীল ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহ ছোবলে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে মানবিক বিপর্যয়ের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশে চলমান দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের রাশ অনেকটা টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে।
এখনকার নিয়ম অনুযায়ী ভারত থেকে বাংলাদেশে আগত সবাইকে দুই সপ্তাহের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এ দু’জন ক্রিকেটারের কোয়ারেন্টাইন শিথিল করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকট আবেদন করেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। আলোচনায় এসেছে, কোয়ারেন্টাইনের সময়কাল কি সংক্ষিপ্ত করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমরা জেনে নিবো কোয়ারেন্টাইন কী এবং কেন?
দেশে অথবা বিদেশে, সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চারপাশের অন্য সবার কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখাকে কোয়ারেন্টাইন বলা হয়। একেক রোগের জন্য কোয়ারেন্টাইনের সময়কাল একেক রকম হয়ে থাকে।
করোনার জন্য কোয়ারেন্টাইনের সময় হচ্ছে দুই সপ্তাহ। অবশ্য এর বিজ্ঞানসম্মত কারণ রয়েছে। করোনাভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করার ১ম থেকে ১৪তম দিন পর্যন্ত রোগ তৈরি করতে পারে। একে বলা হয় সুপ্তিকাল বা ইনকিউবেশন পিরিয়ড। প্রশ্ন আসতে পারে ১৪দিন আলাদা করে না-রেখে টেস্ট করার মাধ্যমে শনাক্ত করা যেতে পারে কার শরীরে করোনা আছে এবং কার শরীরে নেই। বিষয়টি এমন নয়।
করোনা প্রতিরোধে কোয়ারেন্টাইনকে এতো গুরুত্ব কেন দেওয়া হয়? কোয়ারেন্টাইন সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশ থেকে দেশে করোনাভাইরাসের প্রবেশ ঠেকাতে কোয়ারেন্টাইন ‘চীনের প্রাচীর’-এর মতো ভূমিকা পালন করে। প্রাচীনকালে চীনকে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য এই মহাপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়। পর্যটকরা এখন প্রাচীরের যে অংশ দেখতে যায় সেটা মিং রাজবংশের সময়কালে তৈরি করা।
করোনা শনাক্তের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আরটিপিসিআর পরীক্ষাটি ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী সম্পন্ন করা হলেও এক তৃতীয়াংশ রোগীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন। একে সংক্ষিপ্ত করার কোনো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নেই।
শাসকেরা ভেবেছিল প্রাচীর ডিঙিয়ে শত্রুরা তাদের দেশ আক্রমণ করতে পারবে না। প্রাচীর তৈরির একশত বছরের মধ্যে চীন তিনবার বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। তবে কোনোবারই শত্রুদল প্রহরীদের পরাস্ত করে প্রাচীর অতিক্রম করে দেশে প্রবেশ করেনি। প্রতিবার তারা প্রহরীদের উৎকোচ দিয়ে প্রাচীরের প্রধান ফটক দিয়ে দেশে ঢুকে পড়ে। এই ঘটনার সাথে কোয়ারেন্টাইন ভেদ করে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রবেশের বেশ মিল রয়েছে।
২০২০ সালের ১৪ মার্চ ইতালি থেকে ১৪২ জন যাত্রী নিয়ে একটি বিমান ঢাকার বিমানবন্দরে আসে। নিয়ম অনুযায়ী সকল যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে নেওয়া হয়। কিন্তু ইতালি ফেরত বঙ্গ-সন্তানদের হৈ-হল্লা দেখে কর্তৃপক্ষ তাদেরকে কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্রে না রেখে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।
দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে এই ঘটনাকে ধরা হয়। অর্থাৎ বাংলাদেশে করোনার ভাইরাসবাহীরা ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে প্রকাশ্যে দেশে প্রবেশ করে। অনেক বিশ্লেষক এই ঘটনাকে চীনের প্রাচীরের প্রধান ফটক দিয়ে আক্রমণকারীদের প্রবেশের সাথে তুলনা করেছেন।
সেখানেও আমরা দেখেছি যুক্তরাজ্য থেকে আসা যাত্রীদের কখনো সাতদিন, কখনো চারদিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এই সময়ের পর তারা বাড়িতে গিয়ে হোম কোয়ারেন্টাইনে না থেকে পরিবারের সবার সাথে মেলামেশা শুরু করেছে।
অনেকে আবার হোটেলে নাম লিখিয়ে দিব্যি বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সাথে বসবাস করেছে। এমন কয়েকজনকে পুলিশ ধরে আবার হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। অবশ্য এরমধ্যে করোনা বিস্তারের কাজটি তারা ‘সফলভাবে’ করে ফেলেছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর জন্য দায়ী হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা ও যুক্তরাজ্যের করোনাভাইরাসের রূপান্তরিত ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট। এ দুটি ভ্যারিয়েন্ট কিন্তু ঢাকা এবং সিলেটের বিমানবন্দর দিয়েই দেশে প্রবেশ করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার নাম সম্ভবত আমাদের কর্তৃপক্ষের নোটবুকে লেখা ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের প্রবেশ আটকানোর কোনো উদ্যোগ তারা নিয়েছে তেমনটি আমাদের চোখে পড়েনি। এ দুটি ঘটনার যৌথ ফলাফল আমরা গত এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টিকারী সংখ্যার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছি।
সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে আমরা হতবাক হয়েছি। আইন হচ্ছে-বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরবে তাদেরকে নিজ খরচে হোটেলে ১৪ দিন থাকতে হবে। ১৪ দিন পর হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ‘কোয়ারেন্টাইন সম্পন্ন হয়েছে’ মর্মে একটি সনদ প্রদান করবে। অনেক যাত্রী বিমানবন্দর থেকে হোটেলে এসে নিবন্ধন খাতায় নাম ও পরিচয় লিপিবদ্ধ করে। তারপর পছন্দমতো চা-কফি খেয়ে বাড়ি চলে যায়। তবে যাওয়ার আগে হোটেল কর্তৃপক্ষের সাথে একটি বোঝাপড়া এবং টাকা পয়সার লেনদেন হয়। তারপর ১৪ দিন শেষে পুনরায় হোটেলে এসে কোয়ারেন্টাইন সমাপ্তির সার্টিফিকেট নিয়ে যায়।
দুর্জনেরা বলে অনেকক্ষেত্রে টাকা লেনদেনের সময় তারিখ বসিয়ে অগ্রিম সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হয়। এতে ক্লায়েন্টের কষ্ট কমে যায়। এসব হোটেলের সেবার মান (মিথ্যা সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে) অতুলনীয়। কিন্তু এরকম ঘটনার কারণে সারাদেশের মানুষ কী পরিমাণ মহাবিপদে পড়তে পারে সেটা দু’পক্ষের কেউই বুঝতে পারছে না।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের তাণ্ডব চলছে। কয়েকটি রাজ্যে মানবিক বিপর্যয়ের অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের আশেপাশের রাজ্যগুলোর অবস্থা অপেক্ষাকৃত ভালো। অবশ্য ইতোমধ্যে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোকে সতর্ক করেছে। যেকোনো সময়ে এ রাজ্যগুলোতে করোনাজনিত ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। এমতাবস্থায় স্থলপথে ভারত থেকে আগত যাত্রীরা কোয়ারেন্টাইনে না থাকার জন্য বাহানা ও চালাকি করছে।
অনেকে গণমাধ্যমের সামনে এসে বলছে, ‘হোটেলের খাবার খেয়ে তাদের রোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে’। কথাটা সত্য। তবে ভারতে থাকতে তাদেরকে হোটেলের খাবারই খেতে হতো এবং সেটা খেয়ে তারা রোজা রেখেছেন। এজন্যই সিয়াম সাধনা বা সংযমের সাধনা বলা হয়।
এক্ষেত্রে চতুরতা, কৌশল এবং দুর্নীতি কেবলমাত্র করোনার বিস্তার সহায়ক ভূমিকা পালন করে। করোনার বিস্তারের সরল অর্থ হলো মানুষের মৃত্যু ও ভোগান্তির বিস্তার এবং দেশের সামগ্রিক ক্ষতি। তাই কোয়ারেন্টাইনে থাকাকালীন সময়ে যারা নানাভাবে কোয়ারেন্টাইনের শর্ত ভঙ্গ করবে তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। মনে রাখতে হবে শত উপদেশের চেয়ে একটা দৃষ্টান্ত শতগুণ কার্যকর।
ডা. লেলিন চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ