বন্যা পরবর্তী সময়ে যা করণীয়
২০ আগস্ট ২০২৪ থেকে বাংলাদেশের উজানে পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারী বৃষ্টির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। এই বন্যা দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থায়ী হয় মাসের বেশি। ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারসহ দেশের পূর্বাঞ্চলের ১১ জেলা আক্রান্ত হয়।
সরকারি হিসাবে এই বন্যায় মারা গেছেন মোট ৭৪ জন, আহত হয়েছেন ৬৪ জন। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মোট ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮২১ জন। ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন ৪৫ লাখ ৫৬ হাজার ১১১ জন।
বন্যা দুর্গতদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ সাধ্যমতো ত্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু সংকটটা তৈরি হয় বন্যার পরে। বন্যা পরবর্তী সময়ে প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো বাড়িঘর ঠিকঠাক করা। এছাড়া বাড়ির বৃদ্ধ, শিশু, শারীরিক প্রতিবন্ধী বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারীর দিকে বিশেষ নজর রাখার প্রয়োজন পড়ে। টাকা, জমির দলিল, শিক্ষা সনদসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র খুঁজে তা সংরক্ষণ করাও জরুরি। এই সময় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলেই বা নিরাপদ বলার পরেই বাড়ি ফিরবেন।
আরও পড়ুন
বন্যা পরবর্তী সময়ে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় সবচেয়ে বেশি। এই সময় ওষুধ ও প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সাথে রাখা প্রয়োজন। বন্যা পরবর্তী সময়ে বন্যার পানিতে হাঁটবেন না, সাঁতার কাটবেন না বা গাড়ি চালাবেন না। কারণ ৬ ইঞ্চি পানির স্তরেও আপনি নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারেন।
বন্যায় বিপদসীমার ওপরে ওঠা পানি যখন আস্তে আস্তে নেমে আসবে ঠিক তখনই আসল যুদ্ধ শুরু হয়। সাধারণত বন্যার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে বন্যা পরবর্তী সময় মোকাবিলা করা। সে সময় বর্তমান সময়ের মতো এত মানুষও পাশে থাকে না। সবাই ত্রাণ বা সাহায্য-সহযোগিতা করে না। তখন সামাল দিতে হয় নিজেদের। মোকাবিলা করতে হয় বন্যা পরবর্তী সময়ের কঠিন পরিস্থিতিকে।
সাধারণত বন্যার চেয়েও কঠিন হয়ে থাকে বন্যা পরবর্তী সময় মোকাবিলা করা। সে সময় বর্তমান সময়ের মতো এত মানুষও পাশে থাকে না। সবাই ত্রাণ বা সাহায্য-সহযোগিতা করে না। তখন সামাল দিতে হয় নিজেদের।
বন্যার সময় আশ্রয়কেন্দ্রে অসংখ্য মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। বন্যার পানি নেমে গেলে সবাই ফেরে নিজের বাড়িতে। সেইসব ঘরবাড়ি সংস্কার করা বেশ কষ্টসাধ্য হলেও সবাই ধীরে ধীরে তা গুছিয়ে নেয়।
বন্যার সময় সড়ক, রেল যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সড়ক সংস্কার, রেললাইন পুনঃস্থাপনসহ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন পুনরায় সংস্কার করা জরুরি। এইসময় গ্যাস লাইনে লিক থাকলে বা বৈদ্যুতিক লাইন ছেঁড়া থাকলে দুর্ঘটনার ঘটনার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এইসব বিষয়ে সতর্কতা জরুরি।
বন্যা পরবর্তী সময়ে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, ত্বকের সংক্রমণ, চর্মরোগ, শ্বাসকষ্ট, মশাবাহিত রোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে, সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার জন্য নৌ অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিমের ব্যবস্থা করা গেলে ভোগান্তি কমানো যাবে।
সারভাইভাল কিটপ্যাক তৈরি করে তা ব্যবহার করতে হবে। সেখানে কমপক্ষে তিনদিনেরপর্যাপ্ত খাবার ও পানির ব্যবস্থা রাখুন। প্রত্যেকের জন্য একটি করে পোশাক, প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখুন। জরুরি তথ্যের জন্য রেডিও, স্থানীয় পরিবর্তনকারী সিস্টেম বা সরকারি নির্দেশাবলী শুনুন।
ভেজা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি থেকে দূরে থাকুন, এতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে। বাড়িতে ঢোকার আগে দেখে নিন কোনো কাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে কি না। বিদ্যুৎ অফিস থেকে বাসাবাড়ি পরিদর্শন করার আগে বিদ্যুৎ সংযোগ চালু করবেন না। সাপ ও বিভিন্ন প্রাণী আপনার বাড়িতে থাকতে পারে, তাই সতর্ক থাকুন। সম্ভব হলে গ্লাভস ও বুট পরুন।
বন্যা-দূষিত প্রতিটি ঘর পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত ও শুকিয়ে নিন। আপনার যদি কোনো বীমা থাকে তাহলে নিশ্চিত করুন যে বীমা দাবির নথি হিসেবে ছবি বা ভিডিও আছে কি না।
এবারের বন্যায় ২৩ কোটি ৬০ লাখ ২৯ হাজার ৭৪০ টাকার ফসল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৭১৮ কোটি ৫৭ লাখ ৫৬ হাজার ৬১০ টাকার ফসল। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পাকা ঘর, আধা পাকা ঘর ও কাঁচা বাড়ির সংখ্যা ২৮ হাজার ৩৮৬টি। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১ হাজার ৯৭টি ঘর।
বন্যা পরবর্তী সময়ে কৃষকদের কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। বিশেষজ্ঞদের মতামত, বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনে বাসস্থান, কৃষি, মৎস্য ও স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। কাদা বা পলি মাটিতে জন্মায় এমন বীজে কৃষকরা বেশি মনযোগী হয় বন্যা পরবর্তী সময়ে। যে ফসল কাদামাটিতে ভালো হয় সেটা দিয়েই কৃষকদের সাথে কাজ শুরু করা দরকার।
আরও পড়ুন
চলতি মৌসুমে দেশের যেসব অঞ্চল বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, সেসব এলাকায় বেশিরভাগ বীজতলায় চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেসব এলাকায় বীজতলা করার উঁচু জমি নেই সেসব এলাকায় ভাসমান বীজতলা এবং দাপোগ বীজতলায় চারা উৎপাদনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ভাসমান বীজতলার ক্ষেত্রে কচুরিপানা ও মাটি দিয়ে কলার ভেলায় ভাসমান বীজতলা করা যেতে পারে। দাপোগ বীজতলার ক্ষেত্রে বাড়ি উঠান বা যেকোনো শুকনো জায়গায় কিংবা কাদাময় সমতল জায়গায় পলিথিন, কাঠ বা কলা গাছের বাকল দিয়ে তৈরি চৌকোনা ঘরের মতো করে প্রতি বর্গমিটারে দুই থেকে তিন কেজি অঙ্কুরিত বীজ ছড়িয়ে দিতে হবে। এভাবে করা বীজতলা থেকে ১৪ থেকে ১৫ দিন বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে হবে।
অনেক কৃষক কিস্তি নিয়ে চাষাবাদ করে। বন্যাদুর্গত এলাকার কৃষকরা তাদের ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি নিয়েছে তাদের উদ্দেশে ফারুক-ই-আজম বলেন, সবার মতামতের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বিষয়টি বিবেচনা করে তিন মাসের জন্য কিস্তির টাকা স্থগিত করা হয়েছে। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত কৃষকদের কিস্তির টাকা দিতে হবে না।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ।
এটি কৃষকদের জন্য মঙ্গলজনক। তবে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ব্রি ও বিনা উদ্ভাবিত স্বল্প জীবনকালীন জাত যেমন ব্রি-ধান ৩৩, ব্রি-ধান ৫৭, ব্রি-ধান ৬২, ব্রি-ধান ৭১, ব্রি-ধান ৭৫, বিনাধান-৭ এবং বিনাধান-১৭ সরাসরি রোপণ করা যেতে পারে।
তবে বন্যা উপদ্রুত কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে স্বল্প জীবনকালীন জাত এই মুহূর্তে চাষ করা যাবে না।
আগামী রবি-ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি-ফসল, বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুরসহ দেশের সব বন্যা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী আসছে রবি মৌসুমের সবজি চারা সরবরাহ করা।
পাশাপাশি পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বসতবাড়িতে সবজি চাষ করার লক্ষ্যে পরিবার প্রতি বন্যা পরবর্তী বিভিন্ন জাতের সবজি সরবরাহ করা। মনে রাখতে হবে, বন্যা পরবর্তী প্রান্তিক কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি।
সমীরণ বিশ্বাস ।। কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ
[email protected]