গণতান্ত্রিক সংস্কার কোন পথে?
ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তার কার্যক্রমের একমাস পূর্তি উপলক্ষে সংস্কারের জন্য ছয়টি কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছে। ১ অক্টোবর ২০২৪ থেকে ওই কমিশন কাজ শুরু করে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট প্রস্তুত করবেন বলে জানানো হয়েছে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে তাদের সংস্কার কার্যক্রম শুরুর খবর পাওয়া যাচ্ছে।
শুরু থেকে আন্দোলনে থাকা সিপিবিসহ বিভিন্ন বামপন্থী, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সরকারের কাছে তাদের সংস্কারের এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে আসছিল। এই কমিশন গঠনের ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিপূর্ণভাবে রোডম্যাপের খবর পাওয়া না গেলেও একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কমিশন তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার পর প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধির সাথে আলাপ করা হবে, কর্মশালা করা হবে তারপর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে।
মনে রাখা দরকার, সংস্কার কাজের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব পালন করার কথা রাজনৈতিক দলগুলোর। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রমের লক্ষ্যকে জনগণের সামনে তুলে ধরে জনগণের সম্মতি চেয়ে এই কার্যক্রমগুলো এগিয়ে নেবে। তাই এই প্রশ্ন সামনে আসছে যে, সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপনের আগে রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলা হবে কি না। তাদের এই কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা হবে কি না।
আরও পড়ুন
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়নি। এটা মনে রাখা দরকার যে, সরকার এই সংস্কারের খসড়া তৈরি করার দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন, তারা নিয়মিত সরকার নয় অর্থাৎ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের ভোটের মাধ্যমে সম্মতি নিয়ে গঠিত সরকার নয়।
আবার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে বিপ্লব সংগঠিত করে সেই বিপ্লবে জয়ী হওয়া কোনো বিপ্লবী সরকারও নয়। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে অন্য যেকোনো সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চেয়ে তার পার্থক্য রয়েছে। সেটি হলো, শত শত মানুষের রক্তের বিনিময়ে সংগঠিত অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার।
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই হচ্ছে এই সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। এবারের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এই গণতান্ত্রিক রূপান্তর একদিনে সম্পন্ন হবে না। নানামুখী কাজের মধ্য দিয়ে এটি করতে হবে।
ইতিমধ্যে নানা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে যা সামনে এসেছে তা হলো, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদের পর ভোটের মাধ্যমেও সরকার গঠিত হলে তারা এই স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে না। দুর্নীতি লুটপাট করে। কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করে, ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে স্বৈরাচারী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চায়। যার জন্য স্বৈরাচারের ভিত্তি মূল থেকে যায়। এই ভিত্তিমূল একদিনে উপড়ে ফেলানো যায় না। তবে তা শুরু করতে হবে। এর রূপরেখা শুরুর কাজটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু করে যাক—এটাই প্রত্যাশা মানুষের।
এমনকি দেশে একটা ভালো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্যও বেশকিছু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দরকার। তাই সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বত্র সহযোগিতার কথা সবাই বিবেচনা করছে। সহযোগিতার কথা বলছে।
মনে রাখতে হবে, এটি করার জন্য ক্রিয়াশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতি ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, সরকার প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কাজ শুরু করুক। এই কাজে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুক।
সাথে সাথে নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের জন্য এখনই রাজনৈতিক দলসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের সাথে দৃশ্যমানভাবে আলোচনা শুরু করুক। কারণ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরই হচ্ছে এই সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। এবারের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতান্ত্রিক রূপান্তর। এই গণতান্ত্রিক রূপান্তর একদিনে সম্পন্ন হবে না। নানামুখী কাজের মধ্য দিয়ে এটি করতে হবে।
তার মধ্যে অন্যতম হলো, স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন সমূহ যথাসময়ে অনুষ্ঠিত করা। রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতা জনগণের কাছে যেমন নিশ্চিত করা দরকার একইভাবে সব কাজে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। এর জন্য দরকার একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ। সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতেই বিভিন্ন সংস্কার মূলক কাজ শুরু করতে হবে। এই কাজ একদিনে শেষ হবে না নিরন্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে করতে হবে।
আরও পড়ুন
আমরা এক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশা করি। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার রক্তের মধ্য দিয়ে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, তা এক মাসে হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষের লাগাতার সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই প্রাথমিক বিজয় অর্জিত হয়েছে। পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। এই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন বিষয়ের সংস্কার এবং নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা সবার।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা, হস্তক্ষেপ মুক্ত করা এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগের দাবি অনেকদিনের। একই সাথে সখ্যানুপাতিক পদ্ধতির প্রবর্তনসহ নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কারে করে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আলোচনা করতে হবে।
আমরা এ বিষয়ে বিকল্প প্রস্তাবনা ৯০ দশকের থেকেই নানাভাবে উত্থাপন করেছি। ২০০৭-২০০৮ সালে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের আলোচনায় লিখিতভাবে বিকল্প প্রস্তাবনা সমূহ হাজির করা হয়েছিল। এরপর থেকে একাধিকবার নির্বাচন কমিশন, রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের বিভিন্ন মহলে এই প্রস্তাবনাগুলো দেওয়া আছে।
সম্প্রতি অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ নানা মহল থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আরও দাবি উত্থাপিত হয়েছে। ধৈর্য ধরে আলোচনার মধ্য দিয়ে এইসব দাবির যৌক্তিকতা বিচার বিবেচনা করে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিশ্চিত করা দরকার।
এটা কোনো দুরূহ কাজ বলে মনে হয় না। বর্তমান সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সৎ ইচ্ছা থাকলে, ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকার মধ্য দিয়ে যতটুকু খবর এসেছে অনেক বিষয়ে ঐক্যমত্য হওয়া যাবে বলে মনে হয়। প্রয়োজন হলো এ ধরনের কাজ যে খুবই জরুরি এই কথাই সামনে এনে আলোচনা শুরু করা দরকার। এই আলোচনা শুরু করতে পারলেই আগামী নির্বাচনের একটা পরিকল্পনা দেখা যাবে।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে, আমরা যত সহজে এই কাজগুলোর কথা বলছি তত সহজ নয়। দীর্ঘদিন ধরে অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আমাদের চিন্তাকে অসাড় করে রেখেছে। এছাড়া পতিত স্বৈরাচার, সাম্প্রদায়িক অপশক্তিসহ ঘাপটি মেরে থাকা বিরাজনীতিকরণের শক্তি এই কাজকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে। এসব অতিক্রম করেই আমাদের এগিয়ে যাওয়া দরকার।
সম্প্রতি অন্যান্য রাজনৈতিক দলসহ নানা মহল থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আরও দাবি উত্থাপিত হয়েছে। ধৈর্য ধরে আলোচনার মধ্য দিয়ে এইসব দাবির যৌক্তিকতা বিচার বিবেচনা করে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার নিশ্চিত করা দরকার।
সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, এসব কাজে জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাই জনগণের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা এবং তার সমাধানকে গুরুত্ব না দিয়ে, সমাধান না করে এসব আলোচনাও সফল হবে না।
সাম্প্রতিক সময়ে নানা বিষয় আলোচনা হলেও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বহুল আলোচিত দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট ভাঙা যায়নি। দেশের কৃষি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমানো এবং উৎপাদক সমবায় ক্রেতা সমবায় গড়ে তুলে কৃষক-ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা ও উৎপাদিত পণ্যের দামে স্বস্তি আনার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। এর থেকে উত্তরণেও এখনো যথাযথভাবে নির্দেশনা দেখা যাচ্ছে না।
বিভিন্ন জায়গায় ‘মব জাস্টিস’-এর নামে অরাজকতা দেখা যাচ্ছে। এই আন্দোলনে কোনো দল বিজয়ী না হলেও বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দলের আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। এই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকাদের, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারকদের তৎপরতা চোখে পড়ছে।
মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মন্দির, মাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনার ওপর আঘাত, কিছু জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ভাঙচুর চলছে। চাঁদাবাজি দখলবাজির হাত বদল হচ্ছে। সমন্বয়কারীদের কার্যক্রমে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এসব বিষয়ে সর্বত্র সরকারের দৃঢ় অবস্থান দেখা যাচ্ছে না। যা সাধারণ মানুষকে হতাশ করছে। আর অপশক্তিকে সাহস জোগাচ্ছে।
এই সুযোগে কোনো কোনো মহল মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ধূলিসাৎ করে দিতে চাইছে। এসব বিষয়ে সতর্ক থেকেই গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে সামনে রেখে এগিয়ে যেতে হবে। বামপন্থী নেতাকর্মীদের এসব অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াতে হবে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্য বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে তার নিজেদের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সংগঠকদের উদ্যোগী ভূমিকায় এ কাজকে অগ্রসর করতে পারে।
সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের শক্তির ভারসাম্যের ওপর দাঁড়িয়ে যদি এখনকার সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়া যায় তাহলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের পক্ষে সংস্কার প্রস্তাব ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশা করা যাবে।
আর শক্তি ভারসাম্য অন্যদিকে জোরালো হলে তারা তাদের কাজ সম্পন্ন করতে চাইবে। এছাড়া এই সময়ে নানা অপতৎপরতাও সামনে চলে আসবে। বিরাজনীতিকরণের অপশক্তির তৎপরতা বাড়বে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শ্রেণিপেশার মানুষের সাথে আলোচনা শুরু করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের ধারা এগিয়ে নেওয়া এবং নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যেই দৃশ্যমান কার্যক্রম অগ্রসর করতে হবে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স।। সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
[email protected]