অন্তর্বর্তী সরকার যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে পারে
০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একমাস পূরণ করলো। এই সরকারের সার্জারি করার আগে সরকারের আগমনের প্রেক্ষাপট এবং সরকার গঠন পরবর্তী অবস্থা সম্বন্ধে আমাদের বুঝতে হবে।
আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি, অর্থপাচার, ঋণ পরিশোধের চাপ ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে খুবই নাজুক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিল। মুদ্রাস্ফীতি তুঙ্গে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার তুঙ্গে। এরপর অভ্যুত্থানের পর প্রথম ছয়দিন দেশে কার্যত কোনো পুলিশ ছিল না। কল্পনা করা যায়?
এরমধ্যে ঘরে ঘরে ডাকাতি বেড়েছে। হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, উপাসনালয়সহ অনেককিছুই আক্রান্ত হয়েছে। ৫–২০ আগস্ট পর্যন্ত হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৬৮। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রাথমিক হিসাব (২০ আগস্ট দেওয়া) অনুযায়ী, ৫০টির বেশি জেলায় দুই শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও মব কিলিংয়ের ঘটনা ঘটছে। এইধরনের সুযোগ যারা নিয়েছে তারা আসলে অসৎ এবং অসভ্য।
আরও পড়ুন
এখন আসুন নতুন এই অন্তর্বর্তী সরকারকে নিয়ে একটু আলোচনা করি। একটি সরকারকে মাপার জন্য এক মাস সময় কিছুই না। আবার সেই সময়টা যদি হয় অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় তাহলে তো এটা কোনো সময়ই না।
আমরা দেখেছি, ক্ষমতায় আসার পরপরই বিচার বিভাগীয় ক্যু, আনসার বিদ্রোহ ইত্যাদি সামাল দিতে হয়েছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আগের সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বাদ দিতে গিয়ে শূন্যতা তৈরি হয়েছে আর সেই সুযোগে অনেকেই একটা অরাজকতা সৃষ্টি করতে চেয়েছে এবং এখনো সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। এমন ব্যবস্থা করা যাতে, প্রথম বর্ষের সব শিক্ষার্থী আবাসিক হলে একটা সিট যেন পায়, যেখানে ন্যূনতম পড়ার জন্য একটা টেবিল থাকবে এবং ঘুমানোর জন্য একটা বিছানা থাকবে।
আগের সরকার অর্থনীতির পরপরই সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি করেছে, তা হলো শিক্ষা। একদম মূলে হাত দিয়ে সেই মূলকে তুলে ফেলতে চেয়েছিল যার সবচেয়ে বড় নিদর্শন হলো একদিকে শিক্ষা বিধ্বংসী বড় বড় মেগা প্রজেক্ট নেওয়া আর অন্যদিকে শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমানো।
এমন ব্যবস্থা করেছিল যে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারি দলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দ্বারা অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়। বিধির কী খেলা তারা সেই ছাত্রদের দ্বারাই ক্ষমতাচ্যুত হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত শিক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। এমন ব্যবস্থা করা যাতে, প্রথম বর্ষের সব শিক্ষার্থী আবাসিক হলে একটা সিট যেন পায়, যেখানে ন্যূনতম পড়ার জন্য একটা টেবিল থাকবে এবং ঘুমানোর জন্য একটা বিছানা থাকবে।
আশার কথা হলো, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন একজন যোগ্য উপদেষ্টার হাতে পড়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ও একজন যোগ্য মানুষের হাতে পড়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়েছে একজন যোগ্য গভর্নর। আমার বিবেচনা এই তিনটি জায়গা নিয়েই, তাই আমি ভালো কিছু আশা করছি এবং ইতিমধ্যেই ভালো ভালো উদ্যোগও দেখছি। তবে এই সরকার চ্যালেঞ্জেও পড়ছে।
দুঃখের বিষয় হলো, ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বরূপ দেখানো শুরু করেছে। তারা বারবার নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলছে যেন আমরা তাদের শাসন দেখিনি। এমন ভাব নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা গেলে দেশ আবার উন্নয়নে ভেসে যাবে। ওটা আর হতে দেওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন
আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন দাবি জানাচ্ছে যে, ক্যাম্পাসের আবাসিক ও একাডেমিক স্থানসমূহে সব ধরনের দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। তারা দাবি জানাচ্ছে হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচন আসুক কিন্তু সব প্রার্থীকে স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। কোনো প্যানেল হিসেবে কেউ নির্বাচনে কোনো প্রকার প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারবে না।
আমার মতে, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও এমনটা হওয়া উচিত। শিক্ষক সমিতির নির্বাচনেও প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।
এখন পর্যন্ত নতুন সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় যেইসব ভিসি নিয়োগ দিয়েছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল। তবে ভিসি নিয়োগের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষকরাই নিয়োগ পেয়েছে যা কাঙ্ক্ষিত ছিল না।
এছাড়া ভিসিরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনের অন্যান্য জায়গায় যাদের নিয়োগ দিচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দল ক্ষমতায়।
আমরা চাই আগামী অন্তত দুটি বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কোনো দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকবে না ঠিক যেমন বিশ্বের অন্যান্য সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখি। দেখা যাক না, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার গুণমান বৃদ্ধি পায় কি না।
আমরা চাই আগামী অন্তত দুটি বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কোনো দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থাকবে না ঠিক যেমন বিশ্বের অন্যান্য সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখি।
সব রাজনৈতিক দলের উচিত অন্তত দুই বছর দেশে একটু কম রাজনীতি করা। রাজনীতির নামে এইটা বদলান, ওইটা ভাঙা ইত্যাদি বন্ধ করা উচিত।
এই সরকারকে কিছু কাজ করতে দিন, কিছু মেরামত করতে দিন। এত শিক্ষিত এবং এত ভালো মানের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীসম সরকার এর আগে কখনো দেখিনি।
অধ্যাপক ইউনূসের মেধা এবং দেশে এবং গ্লোবাল গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত। এমন একটি সরকার যেখানে উপদেষ্টাদের নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে ঠিক সিঙ্গাপুরের মন্ত্রিসভার মতো ভালো কিছু আশা তো করায় যায়।
তাই রাজনীতি নাম দিয়ে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলে এই সরকারকে বিরক্ত করা বন্ধ করুন। আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত না হলেও একটি গণআন্দোলনের মাধ্যমে জনআকাঙ্ক্ষার সরকারকে একটি নির্বাচিত সরকারের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
এক মাস সময় কিছুই না। বিশেষ করে একটি অভ্যুত্থানের পরের একটি মাসের ক্ষেত্রে তো আরও না। তাই সবাইকে ধৈর্য ধারণ করার আহ্বান করছি। দেশকে ভালোবাসুন। শান্তি বজায় রাখুন।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়