অন্তর্বর্তী সরকারের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগে বাধ্য হন। পরবর্তীতে ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়।
এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। এক মাসেরও অধিক সময় ধরে চলা এ আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানির পাশাপাশি দেশের অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হয়েছে এবং নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে।
এ ক্রান্তিকালে এবং নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থায় দেশের এবং অর্থনীতির হাল ধরেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সুতরাং অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এখন তাদের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। দীর্ঘসময় ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণ বিগত সরকারের ওপর ব্যাপকভাবে অসন্তুষ্ট ছিল যা ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করে।
সহিংসতার কারণে জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪ শতাংশে পৌঁছে। এখন সরকারকে স্বল্পমেয়াদে হলেও এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্রদের বাজার মনিটরিংয়ের কারণে শাক-সবজিসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা এতদিন এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেট এবং চাঁদাবাজিকে দায়ী করে আসছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমাতে পারে তবে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতিকে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। পাশাপাশি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং জেলা প্রশাসনের নিয়মিত বাজার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রণালয়কে সবসময় সমন্বয় করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ছাত্রদের বাজার মনিটরিংয়ের কারণে শাক-সবজিসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা এতদিন এসব পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য সিন্ডিকেট এবং চাঁদাবাজিকে দায়ী করে আসছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবাহ টেনে তোলা। দেশে চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর জন্য সংগৃহীত বড় অঙ্কের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ এবং রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন।
জুলাই মাসে আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থী হত্যা এবং ইন্টারনেট বন্ধের প্রতিবাদে প্রবাসীদের অনেকেই রেমিট্যান্স শাটডাউনের ডাক দেয়। যার কারণে জুলাই মাসে দেশে রেমিট্যান্স আসে ১.৯০ বিলিয়ন ডলার যা পূর্ববর্তী জুন মাসের তুলনায় ০.৬৩ বিলিয়ন ডলার কম।
দেশে এখন নিট রিজার্ভের পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সরকারি ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর আহ্বান এবং নানা প্রচারণা চালাতে হবে, পাশাপাশি প্রেরিত রেমিট্যান্স ওপর বিদ্যমান ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা সুবিধা অব্যাহত রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো। ব্যাংক খাতে কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে পুরো অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। বিগত কিছু বছর ধরে অর্থনীতিবিদরা ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন।
বর্তমান সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ তাদের মধ্যে অন্যতম। বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেকগুলো চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। সেই ব্যাংকগুলোর বেশকিছু এখন তারল্য সংকটে দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম এবং মৃত প্রায়। বিগত সরকার পুঁজি সরবরাহ করে সেগুলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল।
অন্যদিকে অধিকাংশ ব্যাংকে রাজনৈতিক বিবেচনায় একেবারে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় সংকট আরও তীব্রতর হয়েছে। এসব ব্যাংকগুলোর মালিকপক্ষ এবং পরিচালকদের অনেকের বিরুদ্ধে নামে বা বেনামে ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে আত্মসাৎ এবং পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি’র হিসাব মতে ১৫ বছরে শুধু ২৪টি বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বর্তমানে অনেকেই দুর্বল ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। তবে সেটা করলে ব্যাংক খাত আস্থার সংকটে পড়তে পারে বলে আমি মনে করি।
এক্ষেত্রে দুর্বল এক বা একাধিক ব্যাংককে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠিত ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করা যেতে পারে। অথবা যেসব ব্যাংকের পারফরমেন্স একেবারেই ভালো না সেগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়ে নতুনভাবে সৎ ও দক্ষ পরিচালক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। ব্যাংকগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে উক্ত ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ কার্যক্রম অত্যন্ত নিবিড়ভাবে তদারকি করতে হবে।
বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। স্বল্পমেয়াদে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর পাশাপাশি এ খাতের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো। ব্যাংক খাতে কোনো বিপর্যয় দেখা দিলে পুরো অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। বিগত কিছু বছর ধরে অর্থনীতিবিদরা ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ে বেশ সোচ্চার ছিলেন।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা এ আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ লাখ কোটি টাকারও বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা। ৬ জুন চলতি অর্থবছরের জন্য বিগত সরকারের অর্থমন্ত্রী ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। উক্ত বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ছাত্র আন্দোলনের কারণে সৃষ্ট অস্থিরতায় রাজস্ব আদায়ের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।
অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনে দুই পক্ষের সংঘর্ষের কারণে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় ৪৫০টি থানা আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পুলিশের অনেক গাড়ি এবং স্থাপনা সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে, অনেক অস্ত্র এবং গোলাবারুদ লুট হয়েছে। সুতরাং পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠন, সরকারি স্থাপনা মেরামত, মেট্রোরেল সংস্কার এবং আন্দোলনের নিহত ও আহত ছাত্র-জনতা ও পুলিশ সদস্যদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হবে। এসব কারণে চলতি অর্থবছরে সরকারের বাজেট ঘাটতি নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে।
এদিকে অর্থ উপদেষ্টা ইতিমধ্যে চলমান গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোয় অর্থ সরবরাহ অব্যাহত রাখবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যেহেতু বর্তমান অর্থবছরের আরও ১০ মাস বাকি আছে, তাই বর্তমান বাজেট কাটছাঁট করে পরিবর্তনের অনেক সুযোগ রয়েছে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ বাদ দিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে সবধরনের চেষ্টা চালাতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যয় সংকোচনের নীতি অব্যাহত রাখতে হবে।
বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ ফেরত আনা যায় কিনা সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সদ্য সাবেক গভর্নর এবং বেশকিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অর্থপাচারে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
আশার কথা হলো নতুন গভর্নর হিসেবে ড. আহসান এইচ মনসুরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশা করি তার সুযোগ্য এবং দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ফিরে পাবে।
ঝুলন ধর ।। সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়